সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত ৫৫৬৬ কোটি টাকা
গত এক বছরে সুইস ব্যাংক বাংলাদেশিদের জমানো টাকার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে এর পরিমাণ ছিল প্রায় ৪ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা।
গত বছরের চেয়ে জমানো টাকার পরিমাণ এক বছরে বেড়েছে এক হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০১৫ সালের তুলনায় বাংলাদেশিদের আমানতের পরিমাণ ১৯ শতাংশ বেড়েছে।
বৃহস্পতিবার সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে। সুইজারল্যান্ডের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে তথ্য নিয়ে এ প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৫ সালে এ আমানতের পরিমাণ ছিল চার হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে ৪ হাজার ২৮৩ কোটি, ২০১৩ সালে তিন হাজার ১৪৯ কোটি এবং ২০১২ সালে ১ হাজার ৯৯১ কোটি, ২০১১ সালে বাংলাদেশি নাগরিকদের সুইস ব্যাংকে জমানো টাকার পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২২২ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি বছরই জমানো টাকার পরিমাণ বেড়ে চলছে।
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে অর্থ জমা রাখার ক্ষেত্রে বিদেশি নাগরিকদের আস্থা ক্রমেই কমে আসছে। ফলে গত কয়েক বছর ধরে সুইস ব্যাংকে বিদেশিদের আমানতের পরিমাণ কমছে। এই অবস্থার মধ্যেও বাংলাদেশি নাগরিকদের আমানতের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলেছে।
সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিকভাবে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ আইন কঠোর করায় বিশ্বব্যাপী এখন কালো টাকার প্রবাহ কমতে শুরু করেছে। আইনের কারণে সুইস ব্যাংকসহ বিভিন্ন দেশের সরকার ও ব্যাংক পাচার করা সম্পদের তথ্য সরকার করছে। ইতোমধ্যে সুইস ব্যাংকও বিভিন্ন দেশকে তাদের দেশের ব্যাংকগুলোতে পাচার করা অর্থের তথ্য দিতে শুরু করেছে। এরইমধ্যে তারা আমেরিকা ও কানাডাকে তথ্য দিয়েছে।
সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত দুই দশক ধরে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশি নাগরিকদের টাকা পাচারের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। মাঝে-মধ্যে দুই এক বছর তা কমলেও গড়ে বেড়েছে। গত ২০১৬ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলঅদেশি নাগরিকদের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা বা ৬৬ কোটি ২৫ সুইস। সুইজারল্যান্ডের মুদ্রার নাম সুইস ফ্রাঁ। বর্তমানে প্রতি সুইস ফ্রাঁ সমান বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮৪ টাকা। আবার এক সুইস ফ্রাঁ সমান ১.০৪ ডলার। গত বছর প্রতি সুইস ফ্রাঁ সমান ছিল ৮৮ টাকা। ফলে ওই এক বছরে তাদেরে মুদ্রার মান কমেছে। এ কারণে টাকার হিসাবে পাচার করা অর্থের পরিমাণও কম বেশি হয়।
গত ২০১৫ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকার পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা (বর্তমান মুদ্রা বিনিময় হারে ৪ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা), ২০১৪ সালে ৪ হাজার ৪৫২ কোটি, ২০১৩ সালে ৩ হাজার ২৭৩ কোটি, ২০১২ সালে ২ হাজার ১৪ টাকা, ২০১১ সালে ১ হাজার ৩৪০ কোটি, ২০১০ সালে ২ হাজার ৭৩ কোটি, ২০০৯ সালে ১ হাজার ৩১৯ কোটি, ২০০৭ সালে ২ হাজার ১৩৯ কোটি, ২০০৫ সালে ৮৫৬ কোটি, ২০০২ সালে ২৭৫ কোটি, ১৯৯৯ সালে ৩৮৭ কোটি এবং ১৯৯৬ সালে ৩৩৭ কোটি ছিল সুইস ব্যাংকে।
সুইস ব্যাংকে টাকা পাচারের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত এবং পাকিস্তানের পরেই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান।
তবে কোনো বাংলাদেশি তার নাগরিকত্ব গোপন রেখে টাকা জমা করলে তার তথ্য এই প্রতিবেদনে নেই। একইসঙ্গে অন্যান্য সম্পদ ও চিত্রকলা জমা রাখলে তার হিসাবও এতে নেই। তবে সামগ্রিকভাবে ২০১৬ সালে মোট আমানতের পরিমাণ কমেছে। আমানতের রাখার ক্ষেত্রে এ বছরও প্রথম অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্য।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবার্হী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন, সুইস ব্যাংক কীভাবে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে সেটি আমাদের জানা নেই। টাকা পাচার রোধে বাংলাদেশ ব্যাংক সময় কাজ করছে। এখনো করে যাচ্ছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি পাচার করা টাকার কোনো সন্ধান পেলে সেগুলো ফিরিয়ে আনতে।
এদিকে, গত দুই দশকের মধ্যে ২০১৬ সালেই বাংলাদেশি নাগরিকদের সবচেয়ে বেশি আমানত জমা হয়েছে সুইস ব্যাংকে।
সুইস ব্যাংক প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে উন্নত দেশগুলো থেকে সুইচ ব্যাংকের সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৫১ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা। (প্রতি সুইচ ফ্রা ৮৪ টাকা ০২ পয়সা হিসাবে)।
২০১৫ সালে এর পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৬৩ হাজার ২৭০ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০১৬ সালে উন্নত দেশগুলোর আমানতের পরিমাণ আরো কমে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৮২ হাজার ৫২৬ কোটি টাকায়।
ইউরোপের দেশগুলো থেকে ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে আমানতের পরিমাণ কমলেও ২০১৬ সালে বেড়েছে। ২০১৪ সালে সুইচ ব্যাংকের ইউরোপের দেশগুলোর আমানতের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে কমে দাঁড়ায় ১ লাখ ৯০৮ কোটি টাকা। আর ২০১৬ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ২৫২ কোটি টাকায়।
অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলো ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে সুইচ ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ বাড়লেও কমেছে ২০১৬ সালে। হিসাব অনুসারে ২০১৪ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সুইচ ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৩০১ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে ছিল ৯ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ১৪১ কোটি টাকা।
অথচ বাংলাদেশের আমানতের পরিমাণ বেড়েছে। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে অর্থ জমানোর পরিমাণ ১৯ শতাংশ বেড়েছে।
দীর্ঘ সময় ধরে ধনীদের অর্থ গোপনে জমা রাখার জন্য বিখ্যাত সুইজারল্যান্ড। ৮০ লাখ মানুষের এ দেশটিতে ব্যাংক আছে ২৬৬টি। বিশ্বের বড় বড় ধনীরা অর্থ পাচার করে দেশটিতে জমা রাখে। ব্যাংকগুলোও কঠোর গোপনীয়তায় তা রক্ষা করে।
আগে সুইস ব্যাংকে জমা টাকার কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করা হতো না। এমন কি আমানতকারীর নাম ঠিকানাও গোপন রাখা হতো। একটি কোড নম্বরের ভিত্তিতে টাকা জমা রাখা হতো। কিন্তু ২০০২ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী টাকা পাচার রোধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ব্যাপকভাবে কার্যকর হওয়ার পর সুইস ব্যাংক এ রিপোর্ট দিচ্ছে।
ওই সময়ে সুইস ব্যাংকগুলোয় সঞ্চয় কমার তালিকায় রয়েছে ফিলিপাইন, কাতার, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, সোমালিয়া, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, মিয়ানমার, মালয়েশিয়ার নাম।
এমএ/এমএমএ/এসআর