পাচার হওয়া বাংলাদেশিদের দুঃসহ জীবন


প্রকাশিত: ১২:৪৯ পিএম, ১৪ মে ২০১৫

উপকূল থেকে ৮০০ অভিবাসী বহনকারী দুটি নৌকা সাগর থেকেই ফিরিয়ে দিয়েছে মালয়েশিয়া। ধারণা করা হচ্ছে, এদের মধ্যে বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা থাকতে পারে। ৫ থেকে ৬শ’  করে অভিবাসী বহনকারী দুটি নৌকা বৃহস্পতিবার সকালে উপকূলে ভিড়তে চাইলে সাগর থেকেই ফিরিয়ে দেয় মালয়েশিয়ান নিরাপত্তা বাহিনী।

নৌকা দুটিকে ফেরত দেওয়ার বিষয়টি জানিয়ে মালয়েশিয়ার উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়ান জুনাইদি বলেছেন, লংকাবি দ্বীপে প্রায় দেড় হাজার অবৈধ অভিবাসী উদ্ধারের পর পেনাংয়ের উত্তরাঞ্চলীয় উপকূলে ৫শ’ অভিবাসী বহনকারী একটি নৌকা পাওয়া যায়। এখন আসলে আমরা কি করতে পারি?

তিনি বলেন, যারা আমাদের সীমান্ত ভেঙে ঢুকতে চাইছে তাদের সঙ্গে আমরা এখনও ভালো আচরণ করছি। এখনও তাদের সঙ্গে মানবতাবোধ দেখিয়ে আচরণ করছি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এভাবে অবৈধ অভিবাসীর ঢল সামলাতে হবে।

মালয়েশিয়ান এ উপমন্ত্রী বলেন, আমাদের এখন এই বার্তাই স্পষ্ট দিতে হচ্ছে যে, এই ধরণের অভিবাসীদের আমরা গ্রহণ করতে পারছি না।

উল্লেখ্য, গত বুধবার বিকেলে পেনাংয়ের জলসীমায় ৫শ` অভিবাসী বহনকারী একটি নৌকা দেখতে পায় স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনী। এরপর লংকাবি দ্বীপের উপকূলে পাওয়া যায় সাড়ে ৩শ` অভিবাসীবাহী আরেকটি নৌকার। রাতভর কোনোটিকেই উপকূলে ঘেঁষতে না দিয়ে বৃহস্পতিবার সকাল হতেই সাগরে ফিরিয়ে দেয় মালেশিয়ার প্রশাসন।

এর আগে গত রোববার ইন্দোনেশিয়ার আচেহ উপকূলে ম্যানতাং পুনতংগামী দুটি নৌকা থেকে ৬শ` রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে স্থানীয় কোস্টগার্ড ও পুলিশ। এরপর সোমবার মালয়েশিয়ার লংকাবি দ্বীপের সমুদ্র সৈকতের কাছ থেকে তিনটি বড় নৌকায় আরো এক হাজার ১৮ অভিবাসীকে উদ্ধার করে স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনী। উদ্ধার ওই অভিবাসীদের মধ্যে ৫শ` ৫৫ জনই বাংলাদেশি।

এদিকে কুয়ালালামপুরসহ বিভিন্ন শহরে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী অনেক বাংলাদেশি দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছেন। বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাদের দুঃসহ যাত্রা ও জীবনের কথা।

কক্সবাজারের কলাতলী চন্দ্রিমা এলাকার আবদুর রশিদ জানান, পাচারকারী চক্রের প্রলোভনে পড়ে গত জানুয়ারিতে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে জাহাজে ওঠেন তিনি। দীর্ঘ যাত্রায় জাহাজে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। জাহাজে ঘুমানোর জায়গাও ছিল না। গাদাগাদি করে বসে থাকতে হয়। জাহাজে ৬শ` থেকে এক হাজার যাত্রী হলে তাদের নিয়ে থাইল্যান্ডের দিকে যাত্রা করে পাচারকারীরা। জাহাজে সারাদিনে এক কাপ পানি দেওয়া হয়। একদিন পর পর দেওয়া হয় সামান্য কিছু খাবার। সশস্ত্র পাচারকারীদের কাছে প্রতিবাদ সাহস কারো থাকে না।
 
তিনি আরো বলেন, জাহাজে কয়েকজনকে মরতে দেখেছেন। তাদের লাশ সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
রসিদ জানান, ১৬ দিন পর থাইল্যান্ডের উপকূলে একটি জঙ্গলে যাত্রীদের তুলে দেওয়া হয়। তাদের রাখা হয় গোপন আস্তানায়। সেখানে শুরু হয় মুক্তিপণের জন্য অবর্ণনীয় নির্যাতন। এতে অনেকে মারা যান। তাদের স্থান হয় গণকবরে।

ঘটনা বর্ণনাকারী রশিদ এখন ক্রাচে ভর দিয়ে ভিক্ষা করেন কুয়ালালামপুর শহরের মসজিদ জামেক এলাকায়। তিনি আরো জানান, জাহাজে কয়েকশ` লোকের মধ্যে দীর্ঘ সময় বসে থাকতে হয়েছে। এর ওপর পাচারকারীদের হাতে চরম নির্যাতন এবং অনাহারে-অর্ধাহারে অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেকে। দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন তিনি। পাচারকারী চক্র তাকে ফেলে রেখে যায় মালয়েশিয়ার একটি পাহাড়ি এলাকায়। মুক্তিপণ দিয়ে বেঁচে গেলেও বিনা চিকিৎসায় রশিদ পঙ্গু হয়ে যান।

চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি গ্রামের আবদুল জব্বারও ভিক্ষা করেন মসজিদ জামেক এলাকায়। তিনি বলেন, সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া গেছেন। দালাল চক্রের হাতে ৩ লাখ টাকা দিয়ে থাইল্যান্ডের বন্দি ক্যাম্প থেকে মুক্তি পেয়েছেন ৫৫ দিন পর।

গুরুতর অসুস্থ সেলিম বেঁচে থাকার জন্য এখন কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছেন কুয়ালালামপুর শহরে। চিকিৎসা করার কোনো সুযোগ নেই তার। তিনি জানান, অবৈধভাবে মালয়েশিয়া আসার পথে অনেক বাংলাদেশি এবং মিয়ানমারের রোহিঙ্গার করুণ মৃত্যু দেখেছেন তিনি। অনেকে চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন শহরে ভিক্ষা করছেন। এসব লোক দেশে ফেরার চেষ্টা করলেও সে সুযোগ নেই। কারণ তাদের হাতে কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। নেই ফেরার জন্য বিমান ভাড়ার টাকা।

রশিদের সঙ্গে বসেই ভিক্ষা করছিলেন রোহিঙ্গা তরুণ সেলিম। মিয়ানমারের মংডু এলাকার বাসিন্দা সেলিম জানালেন তার পাচার হওয়ার করুণ কাহিনী। টেকনাফের সাবরাং এলাকা দিয়ে রাতের আঁধারে জোর করে তাকে নৌকায় তুলে দেয় পরিচিত কিছু লোক। থাইল্যান্ডের বন্দিশিবির থেকে জীবন নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারবেন কখনও ভাবেননি। শেষ পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় থাকা তার এক আত্মীয় মুক্তিপণের আড়াই লাখ টাকা পাঠালে বেঁচে যান তিনি। আহত অবস্থায় তাকে ফেলে দেওয়া হয় মালয়েশিয়া উপকূলে। এক বাংলাদেশির সেবা ও চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হলেও সেলিম হাঁটতে পারেন না। বেঁচে থাকার জন্য কুয়ালালামপুর শহরে ভিক্ষাবৃত্তিকেই বেছে নিয়েছেন তিনি।

সেলিম আরো জানান, থাইল্যান্ডের জঙ্গলে যে বন্দিশিবিরে প্রায় এক মাস কাটিয়েছেন, সেখানে আরো ৪ শতাধিক মানুষ বন্দি রয়েছে। তাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশি তরুণ। মুক্তিপণের জন্য তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চলছে। নির্যাতনে কারো মৃত্যু হলে মরদেহ পুঁতে ফেলা হয়।

মালয়েশিয়ার পেনাং শহরে নরসিংদীর তরুণ আবদুল আমিন বলেন, পাচারকারীরা টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে তাকে বোটে তুলে দেয়। সেখান থেকে জাহাজে আরো ছয় শতাধিক যাত্রীর সঙ্গে প্রথমে তাদের নেওয়া হয় থাইল্যান্ডের একটি উপকূলে।

আমিন জানান, পনের দিন পর জাহাজের হতভাগ্য যাত্রীদের যখন উপকূলে নামানো হয়, তখন তাদের কারো হাঁটার শক্তি ছিল না। জাহাজে বসে থাকতে থাকতে তাদের পা শক্ত হয়ে গেছে। থাইল্যান্ডে তাদের একটি বন্দিশিবিরে রাখা হয়। এরপর চলে চরম নির্যাতন। আমিনের পরিবার আড়াই লাখ টাকা তুলে দিয়েছে দালাল চক্রের হাতে। এরপর তাকে মালয়েশিয়ার একটি উপকূলে পৌঁছে দেওয়া হয়। ছয় মাস পার হলেও আমিন এখনও হাঁটতে পারেন না।

মালয়েশিয়ায় এক বছর কারাভোগ করেছেন কক্সবাজারের রামু উপজেলার কাউয়ারকোপ ইউনিয়নের লট উখিয়ার ঘোনা এলাকার আমির হোসেনের ছেলে মোহাম্মদ ফোরকান। তিনি জানান, গত বছর জানুয়ারিতে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় যাত্রা করেছিলেন। থাইল্যান্ডে নিয়ে তার ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। দালালের হাতে ৮০ হাজার টাকা তুলে দেওয়ার পর মালয়েশিয়া নিয়ে তুলে দেওয়া হয় পুলিশের কাছে। এক বছর কারাভোগ শেষে সম্প্রতি তিনি দেশে ফিরেছেন।

অবৈধ পথে মালয়েশিয়ায় যাওয়া আরো অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। অবৈধ অভিবাসীদের বেশিরভাগই মালয়েশিয়ায় কোনো কাজ পান না। অনেকে রয়েছেন জেলে।

এদিকে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর`র তথ্য মতে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে প্রায় ২৫ হাজার বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা মানব পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে, লাশ হয়েছেন অনেকে।

সম্প্রতি মানব পাচারকারীদের হাতে জিম্মি হয়ে বাংলাদেশিসহ অভিবাসীদের প্রাণ হারানোর ঘটনায় পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় চলছে তোলপাড়। বিদেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে জনসাধারণের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়া এই দালালদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে এরই মধ্যে কড়া পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে বিভিন্ন দেশ। কিন্তু প্রশাসনের কড়া পদক্ষেপের মধ্যেই ইন্দোনেশিয়া উপকূলে দফায় দফায় অভিবাসী উদ্ধারের খবর আসছে।

সাগর পথে মালয়েশিয়াগামী মানব পাচার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের উপায় খুঁজে বের করতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে আলোচনায় ডাকছে মালয়েশিয়া।

বর্তমানে কয়েক হাজার অবৈধ অভিবাসীবাহী নৌকা মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে অবস্থান করছে। তাদের উপকূলে ভিড়তে বাধা দিচ্ছে দেশ দুটির উপকূল রক্ষী বাহিনী। খাদ্য ও পানির অভাবে ইতোমধ্যেই অসুস্থ পড়েছেন নারী ও শিশুসহ অনেক অভিবাসী।

এসব অবৈধ অভিবাসীর মধ্যে অধিকাংশই মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম। দেশটির সরকারকর্তৃক তারা ব্যাপকভাবে নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার। এসব কারণে অনেকটা মরিয়া হয়েই দেশত্যাগে বাধ্য হয় তারা। আর এ সুযোগটিই নিয়ে নিচ্ছে মানব পাচারকারীরা।

মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব দাতু আলাই ইবরাহীম দ্যা স্টারকে বলেছেন, সাগরপথে মানব পাচারের পুনরাবৃত্তি রোধে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা বসবে মালয়েশিয়া।

এছাড়া থাইল্যান্ডকেও আলোচনার জন্য ডাকা হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মানব পাচারের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে থাইল্যান্ডও সংশ্লিষ্ট। কারণ এসব পাচারকৃত অভিবাসীদের বেশিরভাগকেই থাই সীমান্ত দিয়ে মালয়েশিয়ায় ঢোকানো হয়।

এসএইচএস/আরএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।