লোডশেডিং কমলেও বেড়েছে পানির ভোগান্তি
রমজানে লোডশেডিং থেকে রক্ষা পেলেও পানি সংকট কাটছে না রাজধানীবাসীর। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পানি সংকট ছিল। গরম বাড়তে থাকায় রাজধানীতে এ সমস্যা আরও প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। পানির সমস্যা নিয়ে প্রতিদিনই ভিড় বাড়ছে ওয়াসার আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে। অনেক সময় বিক্ষোভসহ ভাঙচুরও চালিয়েছেন বিক্ষুব্ধ জনতা।
ভুক্তভোগরীরা বলছেন, খাওয়া থেকে শুরু নিত্য ব্যবহারের পানিও বাইরে থেকে কিনে নিতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে কিনতে গেলেও প্রয়োজন অনুসারে পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে ওয়াসাসহ সংশ্লিষ্টদের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতেও দেখা যায়নি।
জানা গেছে, রাজধানীজুড়েই পানির সংকট চলছে। তবে কোথাও কোথাও এ সংকট তীব্র। রমজানের প্রথমদিন রোববার রোজা রেখে পানির অভাবে চরম ভোগান্তিতে পড়ে মানুষ। রান্না, গোসল, অজু ও পান করাসহ নিত্য প্রয়োজনীয় কাজে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বারবার ওয়াসার সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে অভিযোগ করেও কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে ওয়াসাও পানির চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। অভিযোগ রয়েছে, জনতার বিক্ষোভ ও জবাবদিহিতার ভয়ে অনেক সময় সংস্থাটির আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তারা অফিসে যান না। এমনকি তাদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনও বন্ধ থাকে প্রায়ই।
ভুক্তভোগীরা জানান, পানির অভাবে অনেক সময় নগরবাসীকে নির্ভর করতে হয় ময়লাযুক্ত পুকুর, ডোবা ও জলাশয়ের উপর। অনেকেই দূর-দূরান্ত থেকে পানি এনে সাংসারিক কাজ-কর্ম সারেন। কিছু কিছু এলাকায় ভাড়াটিয়ারা বাড়ি ছেড়ে অন্য এলাকায় চলে যাচ্ছেন এমন খবরও পাওয়া গেছে।
রাজধানীর বনশ্রী আবাসিক এলাকায় কয়েক মাস ধরে ওয়াসার পাইপলাইনে কাজ চলছে। কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই এলাকায় প্রায়ই পানি সংকট দেখা দিচ্ছে। তবে গত এক সপ্তাহ ধরে আবাসিক এলাকাটির বেশ কয়েকটি ব্লকে কোনো পানি মিলছে না।
ওয়াসার গাড়ি কিংবা ভিন্ন পন্থায় পানি কিনে চলতে হচ্ছে এলাকার লাখো বাসিন্দাকে। দিন দিন এ সংকট আরো তিব্র আকার ধারণ করছে। প্রয়োজনীয় পানি না পেয়ে কয়েকদিন ধরে দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে সেখানকার জনজীবন। তবে এ ক্ষেত্রে কিছুই করার নাই বলে `সাফ` জানিয়ে দিয়েছে রাজধানীর অন্যতম প্রধান নাগরিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানটি।
স্থানীয় বাসিন্দা ও সাংবাদিক তোফাজ্জল হোসেন রুবেল জাগো নিউজকে বলেন, `বনশ্রীতে পানি পরিস্থিতি ভয়াবহ। গত কয়েকদিন ধরে পানি নেই। কেউ কোনো কেয়ারই করছে না। অতিরিক্ত দাম দিয়েও ওয়াসার গাড়ি ভর্তি পানি পাওয়া যায় না। জনজীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে এখানে।`
এ বিষয়ে বনশ্রী এলাকায় বাস্তবায়িত প্রকল্পের পরিচালক ও ঢাকা ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাহমুদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘পুরো বনশ্রী এলাকায় আমরা নতুন পাইপ লাইন সংযোগের কাজ করছি। তবে এতে পানি সরবরাহে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’
পানি সংকটের জন্য লোডশেডিংকে দায়ী করেন তিনি। তার ভাষ্য, `তীব্র গরমের কারণে ওয়াসার নলকূপগুলোতে পানি কম পাওয়া যাচ্ছে। যে কারণে সরবরাহও কমে গেছে।`
এদিকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, সারা দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে রোববার। যা চাহিদার চেয়েও বেশি। তাই নগরীতে লোডশেডিং অনেকটা কমেছে।
মগবাজার এলাকার বাসিন্দারা জানান, গত কয়েক মাস ধরে মগবাজার ওয়্যারলেস এলাকায় পানির সংকট চরমে। পাইপ লাইনে যেটুকু পানি আসে তাও দূষিত। বিষয়টি ওয়াসা কর্তৃপক্ষের জানা থাকলেও স্থায়ী কোনো সমাধান নেয়া হচ্ছে না। তবে এলাকাবাসীকে পানি দিতে প্রতিদিন গাড়ি সার্ভিসের মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে ছয় হাজার লিটার পানি সরবরাহ করছে ওয়াসা।
একই অবস্থা, রাজধানীর অভিজাত এলাকা উত্তরা মডেল টাউনের ১৩ ও ১৫ নম্বর সেক্টরেও। মিরপুরের মনিপুর এলাকাতেও পানির সমস্যা গত এক বছর ধরে। রাজধানীর গোড়ান, খিলগাঁও, কদমতলা, আহমেদবাগ, রাজারবাগ, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, তাঁতীবাজার, চাঁদনীঘাট, নারিন্দা, পানিটেলা, রামপুরা, বাড্ডা, শান্তিনগর, নয়াপল্টন, ফকিরাপুল, মাদারটেক, বাসাবো, কুসুমবাগ, মুগদা, মানিকনগর, গোপীবাগ, জিয়ামাঠ,আজিমপুর ও নিউ ইস্কাটন, লালমাটিয়া, গণকটুলী, ওয়ারী, মৈশুটি, বনগ্রাম, আরমানিটোলা, লক্ষ্মীবাজার, বাংলাবাজার, শাঁখারীবাজার, বাড্ডা, নবাবপুর, ধোলাইখাল, ইসলামপুর, বংশাল, জোয়ারসাহারা, কুড়াতলী,পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা, মেম্বারবাড়ি মিরপুর-১, ২, পল্লবী, ইব্রাহীমপুর, মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ী রোড, শ্যামলী রিং রোডসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাতেও বিরাজ করছে পানির সংকট।
রাজধানীর খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা শহীদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই আসে এই যায়। এই হলো পানির অবস্থা। কখন আসবে আর কখন যাবে সেটা বলা মুশকিল। তাই দুটা ড্রাম কিনে সেগুলো ভর্তি করে রাখি। এর পরও অনেক সময় পানি শেষ হয়ে যায়। কিন্তু পানি আসে না। কোনো অভিযোগ করেও প্রতিকার পাওয়া যায়নি।`
`বাড়িওয়ালা নির্দিষ্ট সময় করে পানি দেয়, প্রয়োজন কী আর এভাবে মানে। সকাল ও গভীর রাত ছাড়া পানিই পাওয়া যায় না,` বলছিলেন ফকিরাপুলের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম।
পানি সংকটের বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান জানান, ওয়াসার ৮৬ শতাংশ পানি আসে ভূগর্ভ থেকে। বাকি ১৪ শতাংশ পানি আসে নদী থেকে। গভীর নলকূপ ও ভূগর্ভ থেকে পানি উত্তোলন এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে দিন দিন ঢাকায় পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। গভীরতা বেড়ে যাওয়ায় ওয়াসার নলকূপগুলো পানি পাচ্ছে না। যে কারণে দেখা দিচ্ছে পানি সংকট।
তবে রাজধানীতে নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহ করতে নানা ধরনের বড় বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে ওয়াসা। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, বর্তমানে ওয়াসার সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার,পদ্মা (যশলদিয়া) পানি শোধনাগার, ঢাকা এনভায়রনমেন্টালি সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই প্রজেক্ট,ওয়েলফিল্ড নির্মাণ (১ম পর্ব) প্রকল্প চলছে।
`এর মধ্যে সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার ফেজ-২ প্রকল্পে দৈনিক সাড়ে ২২ কোটি লিটার পানি উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে। ৩৫০৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত পদ্মা (যশলদিয়া) পানি শোধনাগারে দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার পানি উৎপাদন হবে। ২০১৯ সালের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ হবে।`
ঢাকা ওয়াসার এমডি বলেন, এডিবির অর্থায়নে ১ হাজার ৭৩৪ কোটি ১ লাখ টাকা ব্যয়ে ঢাকা শহরের সব পানির লাইন স্থাপন ও পুনর্বাসনের কাজ চলমান রয়েছে। তবে এই মুহূর্তে পানির সংকট নিয়ে কিছু করার নেই। এসব প্রকল্পের কাজ শেষে হলে রাজধানীতে পানি সমস্যা আর থাকবে না।
তবে নগরবাসী বলছেন, পানি সমস্যা সমাধানে ঢাকা ওয়াসার নজর বড় বড় প্রকল্পের দিকে হলেও চলমান সংকট নিরসনে কোনো উদ্যোগ নেই সংস্থাটির। এ নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা।
এদিকে পানি সরবরাহের দায়িত্ব ওয়াসার হলেও সম্প্রতি গেন্ডারিয়ায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে পানির দাবিতে বালতি ও কলসি হাতে মিছিল করেছেন স্থানীয়রা। এ সময় ওই এলাকায় `জনতার মুখোমুখি` শীর্ষক অনুষ্ঠানে মেয়র সাঈদ খোকনও উপস্থিত ছিলেন।
ওই সময় ঢাকা ওয়াসাকে `ব্যর্থ সংস্থা` আখ্যা দিয়ে পানি সমস্যা নিয়ে সংস্থাটির প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
এমএসএস/এমএমএ