পোশাক খাত অস্থিতিশীল করতে ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র’
বেশকিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিদেশি রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে দেশের তৈরি পোশাক খাত অস্থিতিশীল করে তোলার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে তারা বেশ তৎপর বলেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দেয়া ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে তিনটি বিদেশি সংস্থার পাশাপাশি ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন ও সুইডিশ রাষ্ট্রদূতের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড সন্দেহজনক বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ট্রেড ইউনিয়নসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য শ্রমিক নেতাদের দিকনির্দেশনা দেয়ারও অভিযোগ আনা হয়েছে।
ওই দুই দেশের রাষ্ট্রদূত ও সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা ঢাকায় বিভিন্ন সময় শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে এসব নির্দেশনা দেন বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ইউনিয়নের পৃষ্ঠপোষকতায় লালিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো গার্মেন্টস সেক্টরে সন্দেহজনক কর্মতৎপরতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্প্রতি বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে আশুলিয়ার গার্মেন্টস সেক্টরে যে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠেছিল তা সরকারের সঠিক দিকনির্দেশনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট মহলের মাধ্যমে সফলতার সঙ্গে মোকাবেলা করা হয়। কিন্তু ওই ঘটনার পর থেকে এ দেশের গার্মেন্টস কারখানা ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন এনজিও (বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা) ও লেবার (শ্রমিক) ইউনিয়নের বিদেশি প্রতিনিধিদের তৎপরতা বৃদ্ধি পায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এ দেশের পোশাক শিল্পে ফের আন্দোলন-সংগ্রাম উসকে দিতে বিদেশিরা কাজ করছে বলে আভাস পাওয়া গেছে। এতে গার্মেন্টস শিল্পে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
গত ১০ এপ্রিল এ গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, বাণিজ্য সচিব ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা সচিব বরাবর পাঠানো হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকারকে চাপের মুখে ফেলতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ হিসেবে মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পৃষ্ঠপোষকতায় লালিত ব্যক্তিরা ও প্রতিষ্ঠানসমূহের গার্মেন্টস সেক্টরে সন্দেহজনক কর্মতৎপরতা লক্ষ্য করা যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১০ মার্চ মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট আশুলিয়ায় বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের শাখা অফিসে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। সেখানে তিনি অধিক হারে ট্রেড ইউনিয়ন অনুমোদন দেয়াসহ বর্তমানে শ্রমিকদের মজুরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা আরও বৃদ্ধির প্রয়োজন আছে বলে মন্তব্য করেন। অযথা শ্রমিক ছাঁটাই, হয়রানি ও গ্রেফতার বন্ধ এবং নির্যাতিত শ্রমিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের বিষয় তুলে ধরেন। এছাড়া আশুলিয়ার ঘটনায় রুজুকৃত মামলায় গ্রেফতার গার্মেন্টস শ্রমিকদের আইনি ও আর্থিক সহায়তা দেয়ারও আশ্বাস দেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
একইভাবে ঢাকায় সুইডেনের রাষ্ট্রদূত জোহান ফ্রিসেলের বিরুদ্ধে ট্রেড ইউনিয়ন করার পক্ষে জোরাল বক্তব্য দেয়ার অভিযোগ আনা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের ৮ মার্চ তিনি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনে আয়োজিত আলোচনা সভায় কিছু তরুণ শ্রমিক নেত্রীর অভিজ্ঞতার কথা শুনে বিস্মিত হন। তার দেশের ট্রেড ইউনিয়ন খুবই শক্তিশালী জানিয়ে ফ্রিসেল বলেন, ‘ট্রেড ইউনিয়ন একধরনের মানবাধিকার। আমি বিশ্বাস করি, ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে।’
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টির চেষ্টাকারী হিসেবে তিনটি আন্তর্জাতিক সংস্থার নাম এসেছে। সেগুলো হলো- ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্লোবাল ইউনিয়ন, দ্য সলিডারিটি সেন্টার ও দ্য ওয়ার্ল্ড ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত ৬ মার্চ রাজধানীর গুলশানে দ্য সলিডারিটি সেন্টারের পরিচালক জেফ বক ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্লোবাল ইউনিয়ন কাউন্সিলের নেতাদের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সলিডারিটি সেন্টারের পরিচালক বাংলাদেশে কতটি ট্রেড ইউনিয়ন রয়েছে, বাকিগুলো কোন কোন সংগঠন করেছে- এ ব্যাপারে তথ্য নেয়ার তাগিদ দেন। এর মধ্যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্লোবাল ইউনিয়ন কাউন্সিলের পক্ষ থেকে ২৪৬টি ট্রেড ইউনিয়ন করার কথা বলা হয়।
এছাড়া তিনি আইএলও’র বিভিন্ন কার্যক্রমের ব্যাপারে সার্বিক খোঁজ-খবর নেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দ্য সলিডারিটি সেন্টারের কান্ট্রি ডিরেক্টর গত ৬, ১১, ১২ ও ১৯ জানুয়ারি গুলশানে সংস্থাটির অফিসে ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে সম্প্রতি আশুলিয়ার মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গ্রেফতার শ্রমিক নেতাদের জামিনের বিষয়টি মনিটরিং করার পাশাপাশি তাদের জামিনে আইনজীবী নিয়োগ ও আর্থিক সহযোগিতার কথা উল্লেখ করেন।
সভায় মজুরি বৃদ্ধির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে শ্রমিক নেতাদের দিকনির্দেশনাও দেয়া হয়।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্লোবাল ইউনিয়নের রিজিওনাল সেক্রেটারি (সাউথ এশিয়া) অপূর্ব কাইয়ার (ভারতীয়) গত ২৩-২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে অবস্থান করেন। এ সময় তিনি ধানমন্ডিতে বিলসের অফিসে ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিল নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে গার্মেন্টস পরিস্থিতি বিশেষ করে আশুলিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। পাশাপাশি গার্মেন্টস শিল্পে আরও ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের তাগিদ দেন।
দ্য ওয়ার্ল্ড ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের বিষয়ে গোয়েন্দারা জানান, গত ৩-৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে অবস্থানকালে সংস্থাটির সেক্রেটারি জর্জ মাভরিকস হোটেল এশিয়া’র বেনকুয়েট হলে এফিলিয়েটস (অনুমোদিত) সংগঠনগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এছাড়া ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি ডিআরইউতে ফেডারেশনের নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এমনভাবে এসব ইউনিয়ন করতে হবে, যাতে তারা আন্দোলন করে অধিকার আদায় করতে পারে।’
৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চে আয়োজিত সভায় গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য উপযুক্ত মজুরি ও কর্মপরিবেশ সুন্দর রাখার পাশাপাশি ঐক্যবদ্ধভাবে শক্তিশালী ইউনিয়ন গঠনের মাধ্যমে আন্দোলন করে অধিকার আদায়ের কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে ঢাকাস্থ মার্কিন জানায়, আন্তর্জাতিক শ্রম মান অনুযায়ী শ্রম অধিকার রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশকে দেয়া সমর্থন অব্যাহত রাখছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার বিশ্বাস করে প্রতিটি শ্রমিকের তার কর্মস্থল বেছে নেয়ার অধিকার আছে। শ্রম অধিকার সকল রাজনীতির ঊর্ধ্বে।
তবে ঢাকার সুইডিশ দূতাবাসের মন্তব্য জানতে ই-মেইল করা হলে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
জেপি/এমএআর/পিআর