রামু’র স্বর্গপুরী উৎসবে অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার প্রত্যয়
বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার সাবেক সভাপতি, রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্যক্ষ ও সমাজ সেবায় একুশে পদক পাওয়া পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের বলেছেন, সংসার জীবন প্যাঁচঘরের মতো অত্যন্ত জটিল এবং চক্রময়। এই জটিলতা ও জীবন চক্রকে অত্যন্ত ধৈর্য’র সাথে অতিক্রম করে সঠিক লক্ষে পৌঁছাতে হয়। ধৈর্য হারালে চলবে না। আমরা বাংলাদেশি হিসেবে একই অঞ্চলভূক্ত মানুষ। আমরা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সুন্দর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ দেখতে চাই।
শুক্রবার বিকেল থেকে রামুর উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বনবিহারে শুরু হওয়া স্বর্গপুরী উৎসব ও ব্যুহচক্র মেলার আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
বিকেলের সূর্য পশ্চিমে হেলে সারি সারি সাজানো বাগানে ফেলেছে আলোর ছটা। এ আবহে কেউ গাইছে আবার কেউ নৃত্যরত। এখানে কোনো রকম দুঃখ কাউকে স্পর্শ করতে পারে না। এই হলো স্বর্গের কল্পিত রূপ। কোনো লোক চাইলেই বহু আকাঙ্খিত এ স্বর্গে পৌঁছাতে পারে না। সংসার চক্রে ঘুরতে ঘুরতে জীবদ্দশার ভালো কর্মের প্রভাবে একপর্যায়ে মানুষ স্বর্গে আরোহণ করতে সক্ষম হয়, আবার পুনর্জন্মগ্রহণ করে মর্ত্যলোকে ফিরে আসে। এমনি ভাবেই ঘুরতে ঘুরতে প্রাণীকুল এক সময় নির্বাণ সুখ লাভ করে।
এ ধারণা থেকেই কক্সবাজারের রামু উপজেলার উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বনবিহারে কৃত্রিম স্বর্গ তৈরি করে দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালায় স্বর্গপুরী উৎসব ও ব্যুহচক্র মেলা উদযাপন করা হয়ে আসছে।
ভোরে প্রভাতফেরী সহকারে বুদ্ধপূজা, সকালে ভিক্ষুসংঘের পিণ্ডদান, জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, অষ্টপরিস্কারসহ মহা সংঘদান, ধর্ম দেশনা, অতিথি ভোজন, দুপুরে স্বর্গপুরী উদ্বোধন, দলীয় সঙ্গ নৃত্য, বিকেলে ব্যুহচক্র প্রদক্ষিণ ও আলোচনা সভা, সন্ধ্যায় বিহারের প্রয়াত অধ্যক্ষ প্রজ্ঞামিত্র মহাথের’র নির্বাণ সুখ ও দেশ-জাতি এবং বিশ্বশান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনার মাধ্যমে দিনব্যাপী স্বর্গপুরী উৎসব সম্পন্ন করা হয়।
রাতে চলে সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান। সম্প্রীতির তীর্থ ভূমি রামুর উত্তর মিঠাছড়ি গ্রামের স্বর্গপুরী উৎসব হাজারো বৌদ্ধ নারী-পুরুষের পাশাপাশি বিভিন্নধর্মের লোকজনের অংশ গ্রহণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয় এটি।
রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্যক্ষ, সমাজ সেবায় একুশে পদক প্রাপ্ত পণ্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় স্বর্গপুরী উৎসব বিহারের সাবেক অধ্যক্ষ প্রয়াত প্রজ্ঞামিত্র মহাথের’র প্রতি উৎসর্গ করা হয়। সভায় বন্ধুপ্রতিম দেশ নেপালে সংঘঠিত প্রলয়ংকরী ভূমিধ্বসে নিহতদের জন্য পূণ্যরাশী দান করেন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা।
রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের আবাসিক পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু’র মঙ্গলাচরণ ও সঞ্চালনায় আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন রামু সেনানিবাসের মেজর এম এ ফখরুল ইসলাম খান।
বক্তব্য রাখের রামু উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রিয়াজ উল আলম, ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাহমুদুল করিম, রামু ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. আবদুল হক, কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, বিটিভি কক্সবাজার সংবাদ প্রতিনিধি জাহেদ সরওয়ার সোহেল, রামু প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি খালেদ শহীদ ও গর্জনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বনবিহারের অধ্যক্ষ সারমিত্র মহাথের। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন, বিহার পরিচালনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নীতিশ বড়ুয়া। শিল্পী রাজিব বড়ুয়ার পরিচালনায় অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করেন স্থানীয় শিল্পীরা।
উত্তর মিঠাছড়ি বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক করুণাশ্রী থের, প্রজ্ঞামিত্র ভিক্ষু-শ্রামণ প্রশিক্ষণ ও সাধনা পরিবেণ পরিচালক শীলমিত্র থের প্রমুখ ভিক্ষু সংঘ অনুষ্ঠানে ধর্ম দেশনা করেন।
অনুষ্ঠানে পঞ্চশীল প্রার্থনা করেন, উদযাপন পরিষদের উপদেষ্টা কল্যাণ বড়ুয়া।
বিহার সূত্র জানায়, ১৯৬৭ সনে রাখাইন সম্প্রদায় বৌদ্ধ বিহারটি প্রতিষ্ঠা করেন। কালের বিবর্তনে রাখাইন সম্প্রদায় এলাকা থেকে চলে গেলে এ অঞ্চলে বসবাসকারী বড়ুয়া বৌদ্ধরা বিহার রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছেন। অনেক বছর ধরে গ্রামবাসীর উদ্যোগে বিহার অধ্যক্ষের পরিচালনায় বিহার প্রাঙ্গনে ব্যুহচক্র মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল। বিহারে তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রজ্ঞামিত্র মহাথের ১৯৮২ সন থেকে ওই ব্যুহচক্র মেলাকে স্বর্গপুরী নামে উৎসবে রূপান্তর করেন। এরপর প্রতিবছর ব্যুহচক্র মেলা ও স্বর্গপুরী উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বিগত সময়ে কয়েক বছর স্বর্গপুরী উৎসব আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। এ বছর ৩০তম স্বর্গপুরী উৎসব কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলা, বান্দরবানের লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি, চট্টগ্রামের পটিয়া, রাউজান, রাঙ্গুনীয়া ও খাগড়াছড়িসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বৌদ্ধদের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী এ উৎসবে যোগ দিয়েছেন।
উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বনবিহার পরিচালনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নীতিশ বড়ুয়া বলেন, বিগত বছরের ধারাবাহিকতায় এবারেও সুষ্ঠ-সুন্দর আয়োজনে যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদায় স্বর্গপুরী উৎসব সম্পন্ন হয়েছে। দিনব্যাপী এ উৎসব এখন আর বৌদ্ধদের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। সকল ধর্মালম্বী লোকজনের অংশগ্রহণে উত্তর মিঠাছড়ি গ্রামের স্বর্গপুরী উৎসব বর্তমানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উৎসবে রূপ নিয়েছে। শতাধিক বৌদ্ধ ভিক্ষু ও শ্রামনের অংশগ্রহণে বহুগুণ মর্যাদায় বৃদ্ধি পেয়েছে এ উৎসব। তিনি উৎসব আয়োজনে সহযোগিতার জন্য স্থানীয় প্রশাসনসহ জাতি-ধর্ম সর্বস্তরের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
উল্লেখ্য, অনুষ্ঠানে একুশে পদক পাওয়ায় পণ্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের ও রামু উপজেলা পরিষদের নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান রিয়াজ উল আলমকে সংর্বধনা প্রদান করা হয়।
এমএএস/আরআইপি