স্বজন হারানোর স্মৃতি এখনও উপকূলবাসীকে তাড়ায়


প্রকাশিত: ০৪:৩৭ এএম, ২৯ এপ্রিল ২০১৫
ফাইল ফটো, জলোচ্ছ্বাসে মানুষের সাথে নিথর হয়ে পড়ে আছে অগণিত পশু। এসবের মাঝেই হারিয়ে যাওয়া আপনজনদের খুঁজছে এক সর্বহারা।

`আমার মেয়ে ও তার বড় ছেলেটা অসুস্থ ছিলো। দেখতে যাওয়ার জন্য খবর পাঠিয়েছিল। (২৬ এপ্রিল’৯১) বৃষ্টির কারণে যাওয়া হয়নি। কথা দিয়েছিলাম বৃষ্টি থেমে গেলে যাবো। ২৯ এপ্রিলের জলোচ্ছ্বাস বৃষ্টি থামিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আমার মেয়ে-নাতি সবার হৃদয় স্পন্দনও থামিয়ে দিয়েছিল। তাদের লাশটি পর্যন্ত আর দেখা হয়নি।` কক্সবাজার সদর উপজেলার উত্তর গোমাতলীর নিজ বাড়িতে বসে ভয়াল ২৯ এপ্রিল রাতে স্বজন হারানোর সেই স্মৃতি বলতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন নুরজাহান বেগম (৬৭)।

শুধু তিনি নন, উপকূলের শত শত মানুষ আপনজনদের হারিয়ে এখনো স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। দু’যুগ সময় পিছনে ফেলে এসেছেন তারা। কিন্তু হারানোর বেদনা তাদের কখনো নিস্তার দেয় না। উপকূলবাসীর স্বজন হারানোর সেই ভয়াল ২৯ এপ্রিল আজ। এ দিনে ভারাক্রান্ত মনে উপকূলবাসী তাদের হারানো স্বজনদের স্মরণ করে। কেউ মিলাদ পড়িয়ে কেউবা ছিন্নমূলদের মাঝে খাবার বিতরণ করে।
 
জানা যায়, ১৯৯১ সালের এই দিনে স্মরণকালের সেই ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের দ্বীপাঞ্চলসহ উপকূলীয় এলাকা তছনছ হয়ে গিয়েছিল। রাতের অন্ধকারে মুর্হুতের মধ্যে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল উপকূলীয় এলাকা।

ক্ষতিগ্রস্তদের মতে, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল আবহাওয়া বিভাগ উপকূলীয় এলাকায় ৯নং সতর্কতা সংকেত জারি করলেও অজ্ঞতার কারণে লোকজন অন্যত্র না গিয়ে মহা দুর্যোগের শিকার হয়। রাত ১০টার পর ১০ থেকে ২০ ফুট উচ্চতায় সাগরের পানি মুর্হুতেই ধেয়ে এসে লোকালয়ে প্রবেশ করে। জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবলীলায় ওই রাতে অনেক পরিবারই হারায় তার আপনজনদের।

সরকারি হিসাব মতে, ভয়াল এ ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় ১৯ জেলার ১০২টি থানা ও ৯টি পৌরসভার ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ জন নিহত, ১২ হাজার ১২৫ জন নিখোঁজ, ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫৪ জন আহত হয়। মাছ ধরার ট্রলার, নৌকা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, গাছ-পালা, চিংড়ি ঘের, স্কুল-মাদ্রাসা, পানের বরজ, লাখ লাখ গবাদি পশু, ব্রিজ, কালভার্ট ভেঙে প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। তাই ২৪ বছর পরও অতীতের স্মৃতি চিহ্ন মুছে ফেলতে পারেনি উপকূলবাসী।

জেলা প্রশাসনের ত্রাণ ও পুর্নবাসন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালের ১২ জুন জেলার ব্যবহারের অনুপযোগী ১৫৪টি কেন্দ্র দ্রুত সংস্কার এবং জেলায় নতুন করে আরও ২৭৭টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। এরই ভিত্তিতে ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে ২১২টি নতুন সাইক্লোন সেল্টার নিমার্ণের প্রক্রিয়া শুরুর তোড়জোড় হলেও শেষ পর্যন্ত তা আর আলোর মুখ দেখেনি। তবে সরকারি অর্থায়নে ইতোমধ্যে আট উপজেলায় ১২টি নতুন সাইক্লোন সেল্টার নির্মাণাধীন রয়েছে। কিন্তু সংস্কার বিষয়ে নতুন কোন বরাদ্দ কিংবা নির্দেশনা আসেনি।  

জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোর সংস্কার ও অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা এবং নতুন করে আরও কেন্দ্র স্থাপনের জন্যও উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ চলছে।

শুধু সাইক্লোন সেল্টার নয়, জেলার উপকূলের ২৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে চরম ঝুঁকিতে। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে মহেশখালী, পেকুয়া, সদর উপজেলা এবং টেকনাফের বেশ কয়েকটি উপকূলীয় বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে গিয়েছিল। ওই ভাঙা বাঁধ এখনো পরিপূর্ণ মেরামত হয়নি। ফলে উপকূলের লাখো মানুষ এখনো ঝুঁকি নিয়ে বাস করছেন।

এদিকে দিবসটি যথাযথভাবে পালনের লক্ষ্যে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচী হাতে নিয়েছে ২৯ এপ্রিল’১৯৯১ স্মৃতি পরিষদ, সেভ দ্যা ন্যাচারসহ নানা সংগঠন। সকালে শোক শোভাযাত্রা, মিলাদ ও নিহত এবং নিখোঁজদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত এবং দরিদ্রদের মাঝে খাবার বিতরণ করা হবে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি।

এসএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।