নারী যাত্রীদের প্রশ্ন আমরা কি পশু?
গাজীপুর-যাত্রাবাড়ী রুটের তুরাগ বাস। কানায় কানায় পূর্ণ যাত্রী নিয়েও আরও যাত্রী নিতে নতুনবাজার মোড়ে থামল বাসটি। মানুষের ফাঁক গলে তিনজন নারী কোনো রকম বাসটিতে উঠলেন, যাদের একজনের কোলে মাত্র কয়েক মাসের এক শিশু।
মানুষের চাপে চিড়েচ্যাপটা অবস্থা তখন তার। গগণবিদারী চিৎকার করে শিশুটি কাঁদলেও দীর্ঘ অপেক্ষার পর কোনো রকমে উঠতে পারায় বাসটি থেকে নামতে চাইলেন না তার মা। তবে তাকে থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন।
কিছু দূর যেতেই নির্ধারিত নারী আসন ফাঁকা হওয়ায় তিনজন নারী বসার সুযোগ পেলেন। কিন্তু চালকের পাশে ইঞ্জিন কাভারে বড় একটি বাড়তি চাকা রাখায় উল্টো দিকে জানালার পাশের নারী সিটগুলোতে কোনোভাবে বসা গেলেও পা রাখা যাচ্ছিল না। ফলে বাচ্চাটি ঠিকমতো কোলে নিতে পারছিলেন না মা।
গরমে তখনও কাঁদছে শিশুটি। এবার গাজীপুরগামী যাত্রী সেই মা ক্ষোভে চিৎকার করে উঠলেন, আমরা কি মানুষ না? আমরা কি পশু? এভাবে বসা যায়? একে তো ইঞ্জিনের উপরে সিট, কয়েকগুণ গরম হয়ে আছে। তার উপর এমনভাবে পায়ের কাছে চাকা রাখা আছে বসা যায় না। পশুর যাতায়াতেও এমন অবস্থা থাকে না।
তার অনবরত চিৎকারে এবার বিরক্ত হলেন চালকের আসনে থাকা ব্যক্তি। একটু আগেও যিনি হেলপারকে বারবার বলছিলেন, ‘পাতলা পাতলা নারী তুলবি বাসে। খবরদার মোটা মেয়ে মানুষ তুলবি না। তার এই আপত্তিকর কথা শুনে দু’জন নারী যাত্রী মৃদু প্রতিবাদ জানালেও তা কানে তোলেননি সেই ড্রাইভার। স্টপেজে স্টপেজে গাড়ি থামিয়ে একই নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছিলেন সহকর্মীদের।
শিশুটির মায়ের অভিযোগে বিরক্ত হয়ে ড্রাইভার বলে ওঠে, ‘এত চিৎকার করলে এমন কষে ব্রেক করব, নামার জন্য কেঁদেও কুলিয়ে উঠতে পারবে না।’ এবার শিশুটির নিরাপত্তার কথা ভেবেই বোধ হয় চুপ হয়ে যান সেই মা। কোন রকমে কষ্ট করে সন্তানকে বুকে চেপে বসে থাকেন তিনি।
এই প্রতিবেদককে ওই মা বলেন, আমরা গরীব মানুষ। প্রয়োজনে শিশু সন্তানকে নিয়ে বের হতে বাধ্য হয়েছি। কোন বাসেই মহিলা তুলতে রাজি হয় না। পুরুষ বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তবু আমাদের তোলে না। অনেক কষ্টে এই বাসে উঠতে পারলেও এভাবে বাচ্চাকে কষ্ট দিতে মন সায় দেয় না।
এরা আমাদের মানুষ মনে করে না। করলে এভাবে এত খারাপ জায়গায় মহিলা আসন করত না। এখানে উঠে বসা কষ্ট, ইঞ্জিনের গরমে সিদ্ধ হয়ে যেতে হয়। আবার খারাপ কথাও শোনায়।
এই আলাপের সূত্র ধরে বাসটির আরেক যাত্রী কলেজ ছাত্রী সানজিদা জুই জাগোনিউজকে বলেন, লোকাল বা সিটিং কোন সমস্যা নয়। সমস্যা এদের মনে। প্রতিদিনকার চলাচলে কতবার যে বাস ড্রাইভার বা কন্ডাক্টরদের কাছে নিজের সম্মান খোয়াতে হয়, হিসেব কষেও তা বের করা যা না।
তাঁরও অভিযোগ নারী আসনের স্থান নিয়ে। যেখানে উঠে বসাটাই কষ্টকর সেটা কেন নারীদের জন্যই নির্ধারিত থাকবে?
অফিস ফেরত যাত্রীদের ক্ষোভটা আরও বেশি। কয়েকজন নারী যাত্রী জানান, বিকেল পাঁচটার পর বাসে উঠতে রীতিমত হিমশিম খেতে হয়। কখনও কখনও ঘণ্টা পার হলেও বাসে ওঠা যায় না। মূলত বাসে উঠতে পারব কিনা সেটা নারী আসন ফাঁকা থাকার উপর নির্ভর করে না, এটা নির্ভর করে বাস চালক, হেলপার বা কন্ডাক্টরের ইচ্ছের উপর।
একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা জান্নাত আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ভিড় ঠেলে বাসে ওঠা সত্যি ভীষণ কষ্টকর। ভিড় থাকলে উঠতেও চাই না। কিন্তু যখন দেখি নির্ধারিত মহিলা আসনগুলোতে পুরুষ বসিয়ে বলা হচ্ছে, সিট নাই, মহিলা তুলিস না তখন সত্যি আত্মসম্মানে লাগে।
শুনছি নিয়মিত অভিযান চলছে, কিন্তু কোন বাসে নারী যাত্রী না থাকলে কখনও প্রশ্ন করা হয়েছে কি, কেন নারী যাত্রী নেই?
সকালে এবং বিকেলে বিশেষায়িত নারী বাস সার্ভিস বাড়ানোর দাবি জানান তিনি।
জেপি/ওআর/এমএস