ভাসছে হাওর, ধান উৎপাদন কমবে ২৫ শতাংশ


প্রকাশিত: ০৩:৫৭ পিএম, ০৯ এপ্রিল ২০১৭
ছবি : জাগো নিউজ

আকস্মিক পাহাড়ি ঢল ও অসময়ের অতিবৃষ্টিতে ভেসে গেছে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ধানের ভাণ্ডারখ্যাত বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চল। তলিয়ে গেছে কৃষকের লাখ লাখ হেক্টর বোরো ধানের জমি। এক মণ ধান কেটে বাড়িতে তুলতে পারেননি কৃষকরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জে এক লাখ ৭১ হাজার ১১৫ হেক্টর জমির ধান পানিতে ডুবে গেছে। এ অবস্থায় এ বছর ২৫ শতাংশ ধানের কম উৎপাদন হবে।

স্থানীয় কৃষক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এবার চৈত্র মাসের প্রথম দিকে হঠাৎ পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টির কারণে নেত্রকোনার ডিঙ্গাপোতা, হাইল, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরসহ কিশোরগঞ্জের বড় বড় হাওর তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জেই তলিয়ে গেছে এক লাখ ৩০ হাজার হেক্টর ধানের জমি।

নেত্রকোনায় খালিয়াজুড়ি ও মোহনগঞ্জের ৩৮ হাজার ১১৫ এবং কিশোরগঞ্জে ২০ হাজার হেক্টর ধানের জমি পানিতে ডুবে গেছে। ফলে ওই তিন জেলায় দুই কোটি পাঁচ লাখ মন ধান কৃষকের ঘরে তুলতে পারছেন না।

অধিদফতরের কর্মকর্তা কৃষিবিদ আইয়ুব আলী জানান, দেশের উৎপাদিত ধানের ২৫ শতাংশ হাওর এলাকা থেকে আসে। এর মানে এবার ২৫ শতাংশ ধান উৎপাদিত হবে না। এতে আর্থিক ক্ষতি হবে প্রায় দুই হাজার ৫৩ কোটি টাকা। এছাড়া স্থানীয়দের মধ্যে অভাব-অনটন তো লেগেই থাকবে, কারণ এ ধানের উপরই ওখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে।

খালিয়াজুড়ি থানার বোয়ালি এলাকার আবদুল আলীম নামের এক কৃষক জাগো নিউজকে জানান, অসময়ের বন্যায় তার ২০ একর (১ একর=১০০ শতাংশ) হাওরাঞ্চলের ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। তার জমিতে লাগানো ধানে ফুল ধরেছিল।

Haor

সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার হাইল হাওরপাড়ের শুনই গ্রামের রতন মিয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার সব শেষ অইয়া গেছে। এক্কেবারে পথে বইস্যা গেছি গা। অনেক বান (দুর্যোগ, বন্যা) দেখছি, এইবারের লাহান আর দেখছি না।’

‘ধান মাত্র গোছায় (বড়) হইইছে, ঘাসের মতো। ফাকনা (পাকা) অইলে পানির নিচেতো তুলা যাইতো। হারাবছর পোলা-পাইনরে লইয়া, কিতা খাইয়াম’- বলেন পঞ্চাষোর্ধ্ব এ কৃষক।

চার সন্তানের জনক কৃষক রতন মিয়া জানান, পাহাড়ি ঢলে তার ৩০ বিঘা জমির সবটুকুই ডুবে গেছে।

শুধু রতন কিংবা আবদুল আলীম-ই নয়, তাদের মতো ‘শোকের মাতম’ চলছে পুরো হাওরাঞ্চল জুড়ে। জানা যায়, হাওরাঞ্চলে সাধারণত একটা ফসলই হয়। বছরের আট মাস পানির নিচে থাকে হাওর। বৈশাখ-জৈষ্ঠ্যে বোরো ধান ঘরে তোলার পর মাছ কিংবা নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন হাওরের বুকে গড়ে উঠা দ্বীপের মতো গ্রামগুলোর নিম্নবিত্ত বাসিন্দারা।

ডিঙ্গাপোতা হাওরের গ্রাম জালালপুরের বাসিন্দা ও বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা মিজানুর রহমান রাসেল বলেন, এ বন্যায় কৃষকের ফসল তলিয়ে যাওয়ায় তাদের স্বপ্নও ভেস্তে গেছে। আগে দেখেছি, পানিতে হাওর ডুবে গেলেও ধান পাকা থাকে। তখন পানির তল থেকে হলেও কিছু না কিছু ধান কেটে আনা যেত। এবার ধানক্ষেতে থোর আসেনি। এমন বিপর্যয় আর দেখিনি।

স্থানীয়দের অভিযোগ, হাওরের নদীগুলো খনন না করা এবং প্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণ না করায় অসময়ের পানিতে তলিয়ে গেছে হাওর।

একই অভিযোগ করা হয় রোববার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত ‘হাওর অ্যাডভোকেসি প্ল্যাটফর্ম’ আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনেও। এতে সংগঠনটির যুগ্ম আহ্বায়ক শরিফুজ্জামান জানান, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ, বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়া, অনেক বাঁধের কাজ শুরু না হওয়া, সংস্কারের উদ্যোগ না নেয়া, অপ্রয়োজনীয় জায়গাতে বাঁধ নির্মাণসহ সংশ্লিষ্টদের বিভিন্ন অনিয়মের কারণে হাওর তলিয়ে গেছে।

তিনি বলেন, গত ১১ থেকে ১৩ মার্চ সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওর পরিদর্শন করে বাঁধ সংস্কারের কাজে অব্যবস্থাপনা চোখে পড়েছে।

Haor

সংবাদ সম্মেলনে ভাটির বাংলা থেকে উঠে আসা খ্যাতনামা তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তফা জব্বার বলেন, ‘একটি জেলাতেই (সুনামগঞ্জ) যদি বছরে ৫৯ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়ে থাকে, তাহলে বলব না টাকার কোনো অভাব ছিল।’

‘বিষয়টা খুব স্পষ্ট যে, দুর্নীতির মধ্য দিয়েই টাকাগুলো আত্মসাত করা হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ঠিকাদার পর্যন্ত, তাদের মাধ্যমে টাকাগুলো লুটপাট হচ্ছে।’

এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জের মিটামইনের বাসিন্দা সাংবাদিক টিটু দাস জাগো নিউজকে বলেন, হাওরে অনেক বিল আছে। এসব বিলের সঙ্গে খালগুলো যুক্ত। অসময়ে বন্যার পানি ভারত থেকে বাংলাদেশে আসে। পাহাড়ি ঢলে সুরমা, কুশিয়ারা, ঝুনুসহ অন্যান্য নদী দিয়ে পানি বাংলাদেশে নেমে আসে। বর্তমানে এসব নদী পাহাড়ি ঢলের পানি বহনের ক্ষমতা নেই। সবগুলো নদী ভরাট হয়ে গেছে।

‘তাই নদীতে পানি এলেই তা দুই পাশের হাওরে ছড়িয়ে পড়ে। এ জন্য নদী খনন জরুরি। এ সমস্যার সমাধান জরুরি, কারণ পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা নিত্যবছরই’- বলেন তিনি।

হাওর থেকে উঠে আসা মোস্তফা জব্বার বলেন, হাওরগুলো তলিয়ে যাওয়ায় এবার দেশে ধান উৎপাদন ২৫ শতাংশ কম হবে। ওই অঞ্চলের দুই কোটি মানুষ তাদের নিজেদের খাওয়া-দাওয়া পুরো এক বছর জোগাড় করতে পারবে না। এবার হাওরে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতর সৃষ্টি হবে।

এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

এমএমএ/এমএআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।