আমার মেয়েকে ওরা মাইরা ফ্যালছে : হৃদির মা


প্রকাশিত: ০৪:১২ এএম, ০২ এপ্রিল ২০১৫

“আমার মেয়েকে ওরা মাইরা ফ্যালছে। এক সপ্তাহ আগে ওই বিমানটিরই চাকা ব্লাস্ট হয়েছিল। আর ওই বিমানে ক্রটি না সেরে আমার মেয়েকে দিয়ে ট্রেনিং করিয়েছে। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই।”  বুধবার দুপুরে রাজশাহী বিমানবন্দরে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত তামান্না রহমান হৃদির মা এ কথা বলেন।

মেধার স্বাক্ষর হিসেবে হৃদি পেয়েছিল গোল্ড মেডেল। ও লেভেল এবং এ লেভেল পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ তামান্না রহমান হৃদির স্বপ্ন ছিল বেসামরিক পাইলট হবে। কিন্তু কে জানত আমার সে হৃদি পাইলট হতে গিয়ে এভাবে নিহত হবে, এভাবে আক্ষেপ করতে থাকেন হৃদির মা।


রাজধানীর নিকুঞ্জ-২ এর ১২ নম্বর রোডের ২০ নম্বর বাসটিতেই বাবা ড. আনিসুর রহমান, মা রেহানা ইয়াসমিন ও একমাত্র ভাই আসিফ রহমান শুভের সাথের থাকতেন হৃদি।

রাজধানীর ‘বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল টিউটোরিয়াল’(বিআইটি) প্রতিষ্ঠান থেকে ও লেভেল এবং এ লেভেল কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে তামান্না রহমান হৃদি বাবা-মাকে বলেছিলেন পাইলট হওয়ার স্বপ্নের কথা। মা-বাবা ডাক্তার বানানোর কথাতেও রাজি হয়নি হৃদি।

পাইলট হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই ২০১৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ‘বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমি’তে ভর্তি হন হৃদি। অন্যসব পাইলটের মতো ট্রেনিং শুরু করেছিলেন তিনিও।

গ্রাউন্ড প্রশিক্ষণ শেষ করে হৃদি শুরু করেছিলেন ফ্লাইং প্রশিক্ষণও। গত মঙ্গলবার প্রশিক্ষণার্থী বৈমানিক হিসেবে হৃদি অত্যন্ত সফলতার সাথে প্রশিক্ষক ছাড়াই রাজশাহীর আকাশও ঘুরে বেড়িয়েছেন।

আর ১২০ ঘণ্টা ট্রেনিং করলেই পাইলট হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হতো যে হৃদির সেই হৃদিই কিনা পারলেন না। লালিত স্বপ্ন বুকে নিয়েই গত বুধবার (১ এপ্রিল) দুপুরে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে পুড়ে মারা যান হৃদি।


গত বুধবার রাতে হৃদিদের নিকুঞ্জের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, চারিদিকে নীরবতা। বাড়িভর্তি মানুষ দেখা গেলেও সাড়া শব্দ নেই। বাড়ির ড্রইং রুমে মানুষের ভিড়েও নিস্তব্ধতা লক্ষ্য করার মতো।

তামান্নার আকস্মিক মৃত্যুই যে সবাইকে শোকস্তব্ধ করেছে তা আর বলার কিছু নেই। হৃদির মা রেহানা ইয়াসমিন শোকে পাথর হয়ে ড্রইং রুমে বসে আছেন। পাশের সোফায় বাবা ড. আনিসুর রহমান। কারো মুখে কোনো কথা নেই। ভাইয়ের আসিফের চোখে-মুখে স্পষ্ট ছোট বোন হারানোর যন্ত্রণা।

হৃদির সাথে সর্বশেষ কখন কথা হয়েছে জানতে চাইতেই হাউমাউ করে কান্না শুরু করেন মা রেহানা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, “সকাল সাড়ে ১১টায় কথা হয়েছে। তখন জানতে চেয়েছিলাম ট্রেনিং কখন? হৃদি জানায়, দুপুর দেড়টায়?”

তিনি বলেন, দুপুরের রোদে ট্রেনিং করার কী দরকার, দেড়িতে কি ট্রেনিংয়ে হয় না, হৃদি বলে মা, “আর তো কটা দিন, ট্রেনিং শেষ হলেই পাইলট হয়ে ফিরবো।”

তিনি বলেন, আমি সিভিল এভিয়েশনকে অনুরোধ করবো বিমান দুর্ঘটনার তদন্ত কমিটি গঠন করে সুষ্ঠু তদন্ত করা হোক। কারণ খুঁজে বের করা হোক। তদন্ত না করা হলে মামলা করবেন বলেও জানান তিনি।

তিনি বলেন, সুষ্ঠু তদন্ত না হলে এধরনের ঘটনার পুনারাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে। তখন হয়তো অন্য মায়ের বুক খালি হবে। অনাকাঙ্খিত মৃত্যুতে হৃদির স্বপ্ন পুরণ না হওয়ার আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, আর কারো মায়ের সন্তান যে পাইলট হওয়ার স্বপ্ন না দেখেন।

নিহত হৃদির মামা লিয়াকত হোসেন মিয়া জাগোনিউজকে বলেন, বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর হৃদিরকে স্থানীয় জনসাধারণ উদ্ধার করতে চাইলেও তাদের অনুমতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু আধাঘণ্টা পর উদ্ধার অভিযান শুরু করে কর্তৃপক্ষ।

এছাড়া দুর্ঘটনার পরপরই আহত প্রশিক্ষক ক্যাপ্টেন সাইদ কামালকে উদ্ধার করা হলেও তার ভাগ্নি তামান্নাকে তাৎক্ষণিক উদ্ধার না করায় বিমান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।

মৃতদেহের ময়নাতদন্তের মূল কপি না দিয়ে তাদের ফটোকপি দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন মামা লিয়াকত। তিনি বলেন, কিছুদিন আগেই হার্টের অপারেশন করা হয়েছে হৃদির মায়ের। এতো বড় দুর্ঘটনার খবর তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।

হৃদির মৃত্যুতে রাতে শোকাহত পরিবারকে সান্ত্বনা আসেন হৃদির প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমি’র সভাপতি ক্যাপ্টেন শাহাব আহমেদ বীর উত্তম ও প্রশিক্ষক আতিউর রহমান।

তামান্নার প্রশিক্ষক আতিউর রহমান বলেন, ফ্লাইং ক্লাবে মা রেহেনাই নিয়ে আসতো হৃদিকে। আর মাত্র কিছু দিন গেলেও হৃদি পাইলট প্রশিক্ষণ শেষ হতো।

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীতে ময়নাতদন্ত শেষে হৃদির মরদেহ ঢাকার বাসায় আনা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বাদ জোহর জানাজা শেষে হৃদির দাফন সম্পন্ন করা হবে।

অপরদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ‘বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমি অ্যান্ড সিভিল এভিয়েশনের সেসনা-১৫২ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুই দিনের মধ্যে কমিটিকে রিপোর্ট দাখিলের জন্য বলা হয়েছে।


বুধবার রাতে হযরত শাহ মখদুম বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক সেতাফুর রহমান তদন্ত কমিটি গঠনের তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, সিভিল এভিয়েশনের গ্রুপের ক্যাপ্টেন নাজমুল আনামকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে।

বুধবার বিকেল ৫টা ১০ মিনিটে বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ হেলিকপ্টারযোগে কমিটির সদস্যরা রাজশাহীতে পৌঁছান। তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। রানওয়ের পাশে থাকা স্থানীয় অধিবাসীদের সাথেও কথা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

সিভিল এভিয়েশনের সিনিয়র সাব-স্টেশন অফিসার ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক জানান, তদন্ত কমিটি গঠনের পরপরই তারা কাজ শুরু করেছেন।

অপরদিকে একই দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত প্রশিক্ষক ক্যাপ্টেন সাইদ কামালের শরীরের ৬০ শতাংশ পুড়ে গেছে।

বুধবার বিকেলেই বিমানে করে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে ঢাকায় পাঠানো হয়। তিনি বর্তমানে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

জেইউ/এআরএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।