হ্যাপি ও রুবেল : সামাজিক মাধ্যম থেকে গণমাধ্যম!

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩:০৬ পিএম, ১১ মার্চ ২০১৫

শেরিফ অাল সায়ার

যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ নির্বাচনে সবাই নিশ্চিত বারাক ওমারা অাবারো জয়ী হতে যাচ্ছেন। কিন্তু কোনো গণমাধ্যম অানুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে পারছে না। কারণ তাদের কর্তাব্যক্তিরা এখনও জয়ের খবর নিশ্চিত করেনি। এমন সময় হুট করেই বিস্ময়কর ভাবে টুইট করে নিজের বিজয়ের কথা ঘোষণা করলেন খোদ বারাক ওবামা। সঙ্গে সঙ্গেই টুইটবার্তার সূত্র ধরে ওবামার বিজয়ের কথা বিশ্বব্যাপি গণমাধ্যমগুলো প্রচার করা শুরু করে।

এই হলো সোশ্যাল মিডিয়া। সোশ্যাল মিডিয়া - মানে হচ্ছে সামাজিক মাধ্যম। বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপি এই মাধ্যম শক্তিশালী হয়ে উঠছে। এই ওয়েবের ভেতর থেকে এভাবেই তৈরি হচ্ছে সংবাদ। ওই সংবাদ অাবার মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ছে তারই মাধ্যমে। অর্থাৎ বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির সময়ে সংবাদ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও সবচেয়ে জোড়ালো ভূমিকা রাখছে সোশ্যাল মিডিয়া।

অাবার অনেক সময় দেখা যায় সংবাদের ভুলকে শুধরে দেয় সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারকারীরা। সোশ্যাল মিডিয়ার বিতর্কের মুখে একপেশে সংবাদ প্রকাশ থেকেও বিরত থাকে বড় বড় গণমাধ্যম। এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। গতবছর লন্ডনের পার্লামেন্ট স্কয়ারে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে। ওই সময় প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম বিবিসি সংবাদ প্রকাশ করে, যার মধ্যে ছবিতে দেখানো হয় শিক্ষার্থীরা পাথর নিক্ষেপ করছে। ওই সংবাদ প্রকাশের পরপর সোশ্যাল মিডিয়ার উত্তাপ ছড়াতে থাকে। অসংখ্য মানুষ টুইট করে এই ছবি প্রকাশের বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেন। অনেকেই বিবিসির নিউজ এডিটরকে উদ্দেশ্য করে লেখেন, অাপনারা কেন এমনটা দেখাচ্ছেন যে শিক্ষার্থীরা পাথর ছুড়ছে? সত্যিকথা হলো ওই সময় বহু শিক্ষার্থী গিটার বাজিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। এই ছবি কোনওভাবেই পার্লামেন্ট স্কয়ারের অাসল চিত্র উপস্থাপন করছে না।

তাদের এই টুইটে বিস্ময়করভাবেই নিউজ এডিটর এসে কমেন্ট বা মন্তব্য করলেন। তিনি বলে বসলেন, “অামরা নিউজ চ্যানেল, অামাদের সুন্দর ছবির প্রয়োজন।” অর্থাৎ একজন নিউজ এডিটর পাঠকের মন্তব্যকে গ্রহণ করে সেটার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছেন এবং এক পর্যায়ে বলে জানিয়ে দিলেন, অামাদের কাজ সংবাদ উপস্থাপন করা। কাউকে উপস্থাপন করা অামাদের কাজ নয়। অামাদের কাজ ঘটনাকে সুন্দর করে তুলে ধরা এবং তার সঙ্গে ঘটনার ছবি উপস্থাপন করা।

নিউজ এডিটরের বক্তব্য নিয়েও ব্যাপক বিতর্ক চলে সোশ্যাল মিডিয়া জগতে। কারণ, সঠিকচিত্র বিবিসি প্রচার করেনি। তারা ছবি দিয়ে বোঝাতে চেয়েছে শিক্ষার্থীরা সহিংস। অথচ বেশিরভাগ সময় জুড়ে তাদের অহিংস অান্দোলনকে প্রচার করেনি বিবিসি।

প্রিয় পাঠক, কথা বলছি সামাজিক মাধ্যম থেকে কি করে একটি তথ্য সংবাদ হয়ে ওঠে। সম্প্রতি সবচেয়ে অালোচিত বিষয় হচ্ছে হ্যাপি ও রুবেল। দু`জনকে অামার নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। সরাসরি প্রসঙ্গে চলে যাওয়াই শ্রেয়। যার মাধ্যমে অামরা বুঝতে পারবো কিভাবে সোশ্যাল মিডিয়া সংবাদ উৎপাদন করে। হ্যাপি-রুবেলের বিষয়টি কেস স্ট্যাডি হিসেবে নেওয়া হলো। এমন অারও অনেক উদাহরণ টানা যায়। যেমন, মাহমুদুর রহমান মান্নার ফোনালাপ ফাঁস নিয়েও অালোচনা করা যেত।  কিন্তু ক্রমাগত হ্যাপির স্ট্যাটাসকে সংবাদমাধ্যমের ব্যবহার করার বিষয়টির কারণেই এই ইস্যু নিয়ে অালোচনা করা।

ফোনালাপ প্রকাশ
রুবেল-হ্যাপি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি অালোচিত-সমালোচিত হয়েছে। প্রথমত একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল হ্যাপি-রুবেলের একটি মোবাইল অালাপ প্রচার করে। মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়। শুধু তাই নয়, বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম- বিশেষ করে প্রিন্ট এবং অনলাইন মিডিয়াগুলো সেই ফোনালাপ কম্পোজ করে প্রকাশ করেছে। টিভি মিডিয়ায় প্রকাশ ছাড়াও অারও একটি ফোনালাপ ইউটিউবে প্রকাশ পায়।

হ্যাপির স্ট্যাটাস নির্ভর সংবাদ
এখন তো হ্যাপির স্ট্যাটাসই যেন হয়ে উঠেছে সংবাদ। বিশেষ করে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের খেলার দিনই সংবাদে জায়গা করে নিয়েছে। সবশেষ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলার দিন ম্যাচ শুরুর দিকে হ্যাপি স্ট্যাটাস দিলেন রুবেলকে উদ্দেশ্য করে। লিখলেন “গুডলাক”। জনপ্রিয় দৈনিক মানবকণ্ঠ এটিকে সংবাদ অাকারে হাজির করে। শুধু তাই নয়,  রুবেলের প্রথম উইকেট পাওয়ার পর হ্যাপি স্ট্যাটাস দিয়েছেন, "ইয়েস!! আই অ্যাম ভেরি হ্যাপি। গট উইকেট!!! ওয়েল ডান বাবু। কিপ ইট আপ।"

রুবেল দ্বিতীয় উইকেট পাওয়ার পর হ্যাপি জানায়, "ওএমজি!!! এগেইন (আবার)!!! থ্যাংকস আল্লাহ!! লাভ ইউ।"

এভাবেই তিনটি স্ট্যাটাস নিয়ে একটি সংবাদ উৎপাদন করে দৈনিক মানবকণ্ঠসহ বেশ কয়েকটি অনলাইন সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করেছে।  

মামলা নিয়ে স্ট্যাটাস তারপর সংবাদ
যেই মামলা করা হয়েছে অাদালতে সেই মামলার বিষয়েও কথা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। মুখ্য মহানগর হাকিমের (সিএমএম) আদালতে হ্যাপির মামলার আইনজীবী কুমার দেবুল দে ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে লেখেন, বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে, একজন পেশাজীবী হিসাবে হ্যাপির পক্ষে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলাম। বাংলাদেশের এহেন সফলতায় রুবেলের বিপক্ষে মামলায় লড়ার আমার আর ইচ্ছে নেই এবং তাই হ্যাপির আইনজীবী হিসাবে এখুনি নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিলাম। এ মামলা পরিচালনার জন্য হ্যাপি অন্য কোনো আইনজীবী নিয়োগ দিলে তাতে কোনো আপত্তি থাকবে না। এখন থেকে আমি আর হ্যাপির আইনজীবী নই। শুভেচ্ছা বাংলাদেশ ক্রিকেট দল!!!! বাংলাদেশ দল ভালো খেলছে। ভালো খেলুক। রুবেল চাপমুক্ত থাকুক। তাকে চাপমুক্ত রাখতেই আমার এ সিদ্ধান্ত।

মুহূর্তেই এই সংবাদও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। অার সংবাদমাধ্যমগুলো সংবাদ তৈরি করে ফেলেন এই স্ট্যাটাস নিয়েও। শুধু তাই নয়, এই সংবাদকে অারও পোক্ত করার জন্য হ্যাপির মন্তব্যও যুক্ত করেন অনেকে। এই সংবাদ শুধু অনলাইন মিডিয়া নয় টেলিভিশন মাধ্যমেও প্রচার করা হয়।

নাসির জামশেদ অতঃপর হ্যাপি
অন্যের দেওয়া স্ট্যাটাসগুলো থেকেও বারবারও যেন সামনে নিয়ে অাসা হয়েছে হ্যাপিকে। যেমন, বাংলাদেশ এবং ক্রিকেটার রুবেল হোসেনকে নিয়ে কটূক্তি করে টুইট করেন পাকিস্তানি ক্রিকেটার নাসির জামশেদ। তার টুইটার বার্তায় রুবেলকে `ফুলটাইম ক্রিমিনাল` বলে গালি দেওয়া হয়।

নাসির জামশেদ তার টুইটার বার্তায় লিখেন, `রুবেল হোসেনের বোলিংয়ে ইংল্যান্ড ধ্বংস হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে একটি ধর্ষণ মামলা চলমান। এই ছেলে একজন ফুলটাইম ক্রিমিনাল, পার্ট টাইম ক্রিকেটার।`

এই টুইটের খবর প্রথম ফেসবুকে শেয়ার করা শুরু করে অনেকে। তারপর সংবাদমাধ্যমগুলো প্রচার পাওয়ার পর অারো বেশি অাকারে ছড়িয়ে যায়। অন্যদিকে এই ইস্যুতে যেহেতু রুবেলকে ফুলটাইম ক্রিমিনাল বলা হয়েছে এজন্য অাবারও অনেক সংবাদমাধ্যম জানতে চায় হ্যাপির মতামত। অনলাইন পত্রিকা বাংলা ট্রিবিউন ভিন্ন অ্যাঙ্গেলে সংবাদ পরিবেশন করেন। যেখানে ওই সংবাদের ভেতর জামশেদের টুইট বার্তার বিষয়ে হ্যাপির বক্তব্য যুক্ত করে বলা হয়, `বাংলাদেশ ও রুবেলকে নিয়ে পাকিস্তানি ওই ক্রিকেটারের কথা বলার কোনও অধিকার নেই। আর রুবেল বিষয়ে আমি যেহেতু সংশ্লিষ্ট, তাই বলব এটা একদমই ভুল বলেছেন তিনি।`

হ্যাপি তার মামলা ও রুবেল প্রসঙ্গে অারও বলেন, `আইনত শারীরিক সম্পর্ক তৈরির পরে কেউ যদি প্রতিশ্রুতি না রাখে, তাহলে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হয়। আমার মামলায় তাই ধর্ষণ বিষয়টি এসেছে। এর অর্থ এই নয়, রুবেল ধর্ষণ করে বেড়ায়। কিন্তু পাকিস্তানি ওই ক্রিকেটার কথাটা বাজেভাবে বলেছেন।`

হ্যাপি-রুবেল বিষয়ে অন্যের স্ট্যাটাস
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যাবহারকারীদের স্ট্যাটাস নিয়েও বিশেষ সংবাদ তৈরি করেছে কোনো কোনো অনলাইন সংবাদমাধ্যম। যেমন, জাগো নিউজকে দেখা গেছে ১৯ জনের স্ট্যাটাস নিয়ে সংবাদ উপস্থাপন করেছে। যার শিরোনাম ছিল “ফেসবুকে রুবেলকে নিয়ে সবাই হ্যাপি”।

এভাবেই সামাজিক মাধ্যমের ছড়িয়ে পড়া তথ্যকে সংবাদে রূপ দেয় সংবাদমাধ্যমগুলো। তবে এক্ষেত্রে মানুষের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করা তথ্য এভাবে গণমাধ্যমে প্রকাশ করা কতটুকু সঠিক তা নিয়েও হতে পারে বিতর্ক। তবে এটিও ঠিক বর্তমান সময়ে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে উঠেছে সংবাদ সংগ্রহের নতুন সোর্স। এটি এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে দাঁড়িয়ে নতুন অনেক তথ্য নিয়ে সংবাদ তৈরি করা সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতার বিষয় হলো, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়া থাকা তথ্য মূল সোর্স হতে পারে না। এই তথ্যকে যাচাই করতে হবে। যেমন, ধরা যাক হ্যাপির স্ট্যাটাস নিয়ে যতগুলো মাধ্যম সংবাদ পরিবেশন করেছেন তাদের কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেনি এটিই তার অাসল ফেসবুক অাইডি কি না! কারণ ফেসবুকে নাজনিন অাক্তার হ্যাপি নামে সার্চ দিলে একাধিক প্রফাইল পাওয়া যায়। তার মধ্যে কোনটি হ্যাপির? এই নিয়েও যথেষ্ঠ সন্দেহ রয়েছে। কিংবা কোনো সংবাদমাধ্যম এই স্ট্যাটাস তার কিনা এসব বিষয়ে প্রশ্ন করেনি। অর্থাৎ সন্দেহ থেকেই যায়। এর মানে সামাজিক মাধ্যমে পাওয়া খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ করার অাগে সব তথ্য নিশ্চিত করেই প্রকাশ করা উচিত বলে মনে হয়।
 
একই সঙ্গে এই ধরণের সংবাদ পরিবেশনের ভেতর ছিল বিনোদনের ইঙ্গিত। ফেসবুকে যা নিয়ে হাসি-ঠাট্টাও হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার বক্তব্য নিয়ে একজন নারীকে এসবের মাধ্যমে হেয়-প্রতিপন্ন করারও প্রয়াসও লক্ষ্য করা যায় সংবাদগুলোতে। কোনো সংবাদ কি এভাবে উপস্থাপনযোগ্য কিনা এই নিয়েও ব্যাপক অালোচনার জন্ম দেওয়া যেতে পারে। অাপাতত ওই বিতর্ক অামরা রেখে দেই সামনের জন্য। তখন অামরা দেখবো এটি অাদৌ সংবাদ হওয়ার যোগ্য ছিল কিনা!

- ব্লগার ও গল্পকার

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।