সাত খুনে নারায়ণগঞ্জের গডফাদাররা জড়িত: আইভি
নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাত হত্যাকাণ্ডে এই অঞ্চলের ‘গডফাদাররা’ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত বলে মন্তব্য করেছেন সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী।
সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় আইভী এ কথা বলেন। এর আগে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি সেলিনা হায়াত্ আইভীর বক্তব্য নিয়েছে। সচিবালয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান শাহজাহান আলী মোল্লার কক্ষে বেলা পৌনে ১১টা থেকে দুপুর সোয়া ১২টা পর্যন্ত এ বক্তব্য নেওয়া হয়।
এসময় তিনি এ মামলার প্রধান আসামি সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূর হোসেনকে ভারত থেকে ফিরিয়ে এনে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করারও দাবি জানান।
আইভী বলেন, নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের পেছনে প্রত্যক্ষ হোক আর পরোক্ষভাবে হোক, গডফাদাররা জড়িত।
গডফাদার কারা—সাংবাদিকেরা জানতে চাইলে আইভী বলেন, নারায়ণগঞ্জের গডফাদার কারা সেটা শুধু নারায়ণগঞ্জবাসী না, সারা বাংলাদেশই জানে।
তদন্ত কমিটি কী জানতে চেয়েছে—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে আইভী বলেন, সাত খুনের ঘটনায় নিহত নজরুল ইসলাম সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর। হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি নূর হোসেনও কাউন্সিলর ছিলেন। তাঁদের সম্পর্কে তদন্ত কমিটি জানতে চেয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে আইভী পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, ‘এখনো নারায়ণগঞ্জে কি স্বস্তি এসেছে? ত্বকী হত্যা, চঞ্চল হত্যা, ছাত্রলীগ নেতা মিঠুকে হত্যা কারা করেছে, সেটা কী জানতে পেরেছে? তাহলে কীভাবে বলব নিরাপদ।’
এ সময় আইভী নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন কি না, তা আবার জানতে চাইলে আইভী বলেন, যখন একটা শহরের জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, সেখানে আমার কথা আলাদা করে বলার কিছু নেই। তবে আমি ভয়ে ভীত নই। মানুষ মরে একবার। মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না। যখন মৃত্যু আসবে, তখন মরে যাব।
এই সরকারের আমলে সাত খুনের বিচার হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে নারায়ণগঞ্জের মেয়র আইভী বলেন, এই সরকারের আমলেই তিন কর্মকর্তা (র্যাব কর্মকর্তা) গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই সরকারের আমলেই তদন্ত এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার চাইলে বাকিরাও গ্রেপ্তার হবে।
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, অপেক্ষা করেন। মূল কারিগররাও বের হয়ে আসবে।
হত্যাকাণ্ডে আইভীর ঘনিষ্ঠ কেউ জড়িত— নারায়ণগঞ্জের সরকারি দলের সাংসদ শামীম ওসমানের এমন অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে আইভী বলেন, আমার ঘনিষ্ঠ কেউ এমনকি আমি জড়িত থাকলেও ধরা হোক। এমনকি আমার সন্তান হলেও ধরেন। বাঁচাতে আসব না।
পরে তদন্ত কমিটির প্রধান শাহজাহান আলী মোল্লা সাংবাদিকদের বলেন, তদন্তের অগ্রগতি হচ্ছে। তিনি বলেন, সেলিনা হায়াত্ আইভী নারায়ণগঞ্জের মেয়র। তাঁর কাছে অধীনস্ত কাউন্সিলরদের সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে এ ধরনের ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে, এ জন্য কী করা উচিত, এ ব্যাপারে তাঁর মতামত নেওয়া হয়েছে।
আইভী বিশেষ কিছু বলেছেন কিনা- এই প্রশ্নে তদন্ত কমিটির প্রধান বলেন, এটা তদন্তের বিষয়। যেটুকু বলা যায় সেটুকু আমরা আপনাদের বলেছি।
মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তদন্ত কমিটির কর্মকর্তারা ভারতে যাবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অপেক্ষা করুন, দেখবেন।
তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, আগামীকাল মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সরকারি দলের সাংসদ শামীম ওসমানের বক্তব্য নেওয়া হবে।
এর আগে গত ১৭ জুলাই র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসানকে চার ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
উল্লেখ্য, গত ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহীম অপহৃত হন। পরে ১ মে তাদের লাশ ভেসে ওঠে শীতালক্ষ্যা নদীতে।
অপহরণের ঘটনার পরপরই নজরুলের পরিবারের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে একটি মামলা করা হয়। নূর হোসেন র্যাবকে ৬ কোটি টাকা দিয়ে সাতজনকে হত্যা করিয়েছেন বলে নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম অভিযোগ করেন।
শুরুতে অভিযোগ অস্বীকার করে সংবাদ মাধ্যমে বক্তব্য দিলেও অপহৃতদের লাশ উদ্ধারের পর লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান নূর হোসেন। পরে দুই সহযোগীসহ তিনি পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার হন।
র্যাবের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠার পর র্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন এবং লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এমএম রানাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়। গ্রেপ্তার হওয়ার পর কয়েক দফায় জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডে নিজেদের দোষ স্বীকার করে আদালতে তারা জবানবন্দিও দেন।
এই খুনের ঘটনা আগে থেকেই জানতেন বলে সে সময় র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধেও অভিযোগ ওঠে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
আর গত ২৫ মে নারায়ণগঞ্জের সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) মনোজ কান্তি বড়াল এবং ওই সময়ের পুলিশ সুপার নুরুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদ করে করা হয়।
সাত খুনের ঘটনায় র্যাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ অন্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ তদন্তে হাই কোর্টের নির্দেশে গত ৭ মে এই তদন্ত কমিটি করে সরকার।
এই তদন্ত কমিটি এ পর্যন্ত ৩৫০ জনের বেশি মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, যাদের মধ্যে র্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তারাও আছেন। আগামী ৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আদালতে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের কথা রয়েছে এই তদন্ত কমিটির।