বন্ধুবেশে অভিজিতের পিছু নিয়েছিল ঘাতকরা


প্রকাশিত: ০৫:৩৯ এএম, ০১ মার্চ ২০১৫
ফাইল ছবি

লেখক ও ব্লগার ড. অভিজিৎ রায় আমেরিকা থেকে দেশে ফেরার পর থেকে তার পেছনে ওতপেতে ছিল ঘাতক দল। অভিজিতকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রেখেছিল তারা। কখন কোথায় যায় অভিজিৎ। হত্যার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বন্ধুবেশে পিছু নিয়েছিল ঘাতকরা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বইমেলায় প্রবেশ ও বের হয়ে আসা পর্যন্ত অভিজিৎ ও তার স্ত্রীর আশপাশেই দেখা গেছে সন্দেহভাজন দুই যুবককে।

টিএসসির পাশে বসানো ক্লোজ সার্কিট টেলিভিশনের (সিসিটিভি) ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও থেকে পাওয়া গেছে এমন দৃশ্য। লেখক ও ব্লগার ড. অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে সিসিটিভির এই ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করেছে পুলিশ।

পুলিশ বলছে, অভিজিৎ রায়কে যারা হত্যা করেছে তারা গ্রন্থমেলা থেকেই তার পিছু নিয়েছিল। গ্রন্থমেলার ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ দেখেই অভিজিত হত্যাকারীদের সনাক্ত করা সম্ভব।

ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন বইয়ের স্টলে অভিজিৎ ও স্ত্রী রাফিদা আহমেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলতে দেখা গেছে দুই যুবককে। প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী ভিডিওতে তাদের চিত্র থাকলেও হত্যাকাণ্ডের ঠিক আগে থেকে সন্দেহভাজন ওই দু’জনকে আর দেখা যায়নি।

সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহের পর ইতোমধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছে র‌্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, বাসায় থাকতে অভিজিৎ রায়ের ফোনে কয়েকবার কল আসে একটি মোবাইল নাম্বার থেকে। হত্যাকাণ্ডের পর ক্রাইম সিন হিসেবে মোবাইলফোন জব্দের পর ওই নাম্বারটি চেক করতে গিয়ে বন্ধ পাওয়া গেছে ওই নাম্বারটি।

তবে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জঙ্গি গোষ্ঠী আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে প্রাধান্য দিয়েই তদন্ত চলছে। এদিকে শনিবার দুপুরে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের ফ্রাঙ্ক, গিবসন ও ইতি’র সমন্বয়ে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল অভিজিতের পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দিতে গিয়েছিলেন।

তারাও পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বলেন, প্রয়োজনে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) তদন্তে সহযোগিতা করবে।

অভিজিতের বাবা অজয় রায় জানান, শুক্রবার তার কাছে এফবিআইয়ের পক্ষ থেকে ফোন করা হয়েছিল। তারা এই ঘটনা ‘টেকওভার’ করতে সহযোগিতা করবে বলে জানায়।

অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় শাহবাগ থানায় পরদিন শুক্রবার অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা (মামলা নম্বর-৫১) দায়ের করেন তার বাবা ড. অজয় রায়। ডিবির পরিদর্শক ফজলুর রহমান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ পেয়েছেন।

প্রথমে মামলাটি মহানগর পুলিশ তদন্ত করলেও পরে অধিকতর তদন্তের স্বার্থে মামলাটির তদন্ত ভার ডিবিকে দেওয়া হয়।

গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলন চত্বরের উল্টো পাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন ফুটপাতে কুপিয়ে জখম করা হয় ‘মুক্তমনা’ ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায় ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান অভিজিৎ। গুরুতর আহত অবস্থায় রাফিদাকে পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অভিজিৎ হত্যার ঘটনাটি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানালেও শনিবার রাত পর্যন্ত খুনিদের কাউকে শনাক্ত বা গ্রেফতার করতে পারেননি।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, একুশে গ্রন্থমেলার বাংলা একডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অংশে স্থাপিত মোট ৭০টি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছেন ডিবির কর্মকর্তারা।

সিসিটিভির ফুটেজ নিবিড়ভাবে পর্যালোচনার পর গোয়েন্দা পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, অভিজিতকে পরিকল্পিতভাবে যে হত্যা করা হয়েছে সে বিষয়ে ডিবি পুলিশ নিশ্চিত।

তিনি বলেন, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে, খুনিদের একজনের গায়ে সাদা শার্ট ও অপর একজনের গায়ে কালো কোট জাতীয় কিছু ছিল। তাদের বয়সও ২৭ থেকে ৩৫ এর মধ্যে।

ফুটেজকে কাজে লাগিয়ে অভিজিতের হত্যাকারীদের শনাক্ত করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি। গোয়েন্দা পুলিশের ওই কর্মকর্তা জানান, রাজীব হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অপরাধে গ্রেফতারকৃত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ ছাত্রের কাছ থেকে সেসময় ৮ জনের একটি হিটলিস্ট উদ্ধার করা হয়েছিল। ওই হিটলিস্টের চার নম্বরে ছিল অভিজিতের নাম।

অভিজিৎ রায় দেশে ফিরেছেন সে তথ্য তাদের কাছে ছিল না। দেশে ফেরার বিষয়টি জানলে পুলিশ অবশ্যই নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিতো বলেও দাবি করে তিনি বলেন, অভিজিতের খুনের দায় স্বীকারকারী আনসারুল্লাহ বাংলা-৭ সংগঠনটির বিষয়ে পর্যবেক্ষণ চলছে।

আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে ঘিরেই তদন্ত : মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রগুলো বলছে, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে ঘিরেই আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত চলছে।

২০১৩ সালে ব্লগার রাজীব হায়দারকে হত্যা ও আসিফ মহিউদ্দিনের ওপর হামলার ঘটনাসহ বিভিন্ন ব্লগারকে হত্যার হুমকি দেয়ার ঘটনাগুলো একই সূত্রে গাঁথা বলে জানিয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এরই ধারাবাহিকতায় ব্লগার অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) হাসান আরাফাত জাগোনিউজকে বলেন, একাধিক বিষয়কে সামনে রেখে তদন্ত চলছে। খুনিদের চিহ্নিত ও গ্রেফতারে আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। তার পিছু নেয়া লোকজনের মধ্যে খুনিদের কেউ ছিল কি না তা শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।

হত্যাকাণ্ডের তদন্তে এফবিআইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে কিনা জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম বলেন, এফবিআইয়ের কাছে সহযোগিতা চাওয়া হয়নি। তারা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছেন।

এদিকে গুরুতর আহত অভিজিতের স্ত্রী রাফিদার অবস্থার উন্নতি হচ্ছে বলে জানিয়েছে তার পরিবারের সদস্যরা। পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) থেকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়েছে।

বই প্রকাশকারীকে হুমকি : অভিজিতের বই প্রকাশকারী সংস্থা শুদ্ধস্বরের মালিক আহমেদুর রশীদ টুটুলকেও হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। শনিবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় তিনি এ সংক্রান্ত একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।

বিষয়টি নিশ্চিত করে মোহাম্মদপুর থানার ওসি আজিজুর রহমান জানিয়েছেন বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

অভিজিৎ হত্যার নিন্দা ও বিচারের দাবি বিভিন্ন মহলের : অভিজিৎ রায় হত্যার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল প্রগতিশীল ছাত্রজোট, শিক্ষক, সুশীল সমাজ ও পেশাজীবী মহল।

অভিজিৎ হত্যার বিচার ও ক্যাম্পাসসহ সারাদেশে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করেছে প্রগতিশীল ছাত্রজোট।

শনিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলন থেকে এ ঘোষণা দেন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হাসান তারেক।

ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ, ভাষা আন্দোলন ও প্রগতির পক্ষে থাকার কারণেই অভিজিৎ হত্যা। দোষীদের গ্রেফতার দাবি করেন তিনি।

জেইউ/বিএ/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।