হত্যার দু`দিন পেরিয়ে গেলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে খুনীরা


প্রকাশিত: ০৭:০৩ পিএম, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

‘মুক্তমনা’ ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ড. অভিজিৎ রায় খুন হওয়ার পর দু’দিন পেরিয়ে গেলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে খুনীরা। মহানগর পুলিশের তদন্তে দুইদিনেও খুনীরা ধরা না পড়ায় শনিবার বিকেলে মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে। কিন্তু শনিবার রাত অবধি কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি ডিবি পুলিশ।

ঢাকা মহানগর পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অভিজিৎ হত্যায় কাউকে গ্রেফতার করতে না পারায় অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, খুনীরা ডেসপারেট। জনসম্মুখে খুন করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে গেছে। তাদের ধরতে গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে জোর প্রচেষ্টা চলছে।

গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলন চত্বরের উল্টো পাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন ফুটপাতে কুপিয়ে আহত করা হয় ‘মুক্তমনা’ ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় অভিজিতের। বন্যার চিকিৎসা চলছে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে।

অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় শাহবাগ থানায় পরদিন শুক্রবার অজ্ঞাতসংখ্যক ব্যক্তিকে আসামী করে মামলা(মামলা নম্বর-৫১) দায়ের করেন বাবা ড. অজয় রায়।

অধিকতর তদন্তের স্বার্থে শনিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের কাছ থেকে মামলাটির তদন্ত ভার ডিবিকে দেওয়া হয়।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগের সহকারী কমিশনার (এসি, রমনা) মো. আরাফাত।

তিনি বলেন, ডিবি পুলিশের হাতে অভিজিৎ হত্যা মামলার তদন্তের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তদন্ত কাজ শুরু হয়েছে। তবে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেই অভিজিৎ খুন হওয়ার দুই ঘণ্টা পর দায় স্বীকার করে একটি টুইটার এ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট দিয়েছিল ‘আনসার বাংলা সেভেন’ নামে একটি জঙ্গী সংগঠন। টুইটারে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে পোস্ট করা বার্তায় সংগঠনটি অভিজিৎ রায়কে হত্যার ঘটনায় সন্তোষ প্রকাশ করে।

অভিজিৎ রায়কে হত্যার পর টুইটারে ‘হ্যাঁ, আমরা পেরেছি’ বলে উল্লাস করে সংগঠনটি। এ ছাড়া ‘আজ মহান দিন’ উল্লেখ করে ‘বাংলাদেশে আজ বিশাল এক সফলতা অর্জিত হয়েছে’ বলেও টুইটারে উল্লেখ করে ‘আনসার বাংলা-৭’ নামের ওই সংগঠনটি।

টুইটারে অভিজিৎ রায়ের মাথা ধরা হাতে স্ত্রীর রক্তাক্ত ছবি দিয়ে লেখা হয়, অভিজিৎ রায় ‘ইসলামের শত্রু’। ৩/৪ বছর ধরে সে (অভিজিৎ) ‘টপ টার্গেটে’ ছিল।

এঘটনার পর ২ দিন পেরিয়ে গেলেও তদন্তে কার্যত কোনো অগ্রগতি হয়নি।

এব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা জোনের সহকারী কমিশনার শিবলী নোমান বলেন, ‘আনসার বাংলা সেভেন নামে একটি গ্রুপের এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকারের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অভিজিত হত্যার রহস্য উদঘাটন ও খুনীদের ধরতে ডিবি পুলিশের পাশাপাশি কাজ করছে র‌্যাবও।

র‌্যাবের লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইং-এর পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘ব্লগার অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা কাজ করছে।

নিহতের পরিবারের দাবি উগ্রপন্থী ধর্মভিত্তিক সংগঠনের সদস্যরা এ খুন করতে পারে। ব্লকে লেখালেখির কারণে অভিজিৎকে টার্গেট করা হয়েছিল বলে মনে করেন বাবা অজয় রায়।

তিনি হত্যাকাণ্ডের জন্য ‘উগ্র জঙ্গিবাদীদের’ দায়ী করে তিনি জানতে চান, “অভিজিৎকে খুন করেছে বলে যারা দায় স্বীকার করে টুইট করেছে তারা কেন ধরা পড়ছে না।” বিলম্ব হলে ড. হুমায়ুন আজাদ হত্যার মতো তার ছেলের বিচারও পাবেন না বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

মুক্তমনা সাধারণ জনগণ ও ঢাবি কর্তৃপক্ষ বলছেন, নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটির সুযোগ নিয়েই খুনীরা হামলা চালিয়েছিল অভিজিতের ওপর।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এম আমজাদ আলী বলেন, ‘খুনীরা অভিজিৎকে টার্গেটে পরিণত করতে সফল হয়েছে। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি ব্যর্থ।

সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের দফতর সম্পাদক নাসির উদ্দিন প্রিন্স বলেন, হুমায়ুন আজাদ স্যারের মতোই একই ভাবে মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীই তাকে হত্যা করেছে।’

পুলিশও জঙ্গিবাদীদের দিকে আঙুল তুলেছে, কিন্তু শাহবাগ থানা থেকে মাত্র আড়াইশ গজ দূরত্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে কীভাবে হামলার ঘটনা ঘটছে, সদুত্তর দিতে পারে নি পুলিশ।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্ত সূত্রে জানা যায়, একইভাবে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদকে বইমেলা থেকে বের হওয়ার পর ঠিক একই ভাবে আঘাত করা হয়েছিল। এর কিছুদিন পর তিনি মারা যান।

এদিকে, ব্লগারদের ওপর হামলার প্রথম ঘটনা ঘটে ২০১৩ সালের ১৪ জানুয়ারি। সেদিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে হামলার শিকার হন ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন। মারাত্মক আহত হলেও তিনি বেঁচে যান।

একইভাবে ব্লগার রাজীব হায়দারকে ২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজধানীর পল্লবীতে নিজ বাসার সামনে হত্যা করা হয়েছিল।

রাজীব হত্যায় গ্রেফতার হওয়া আসামিদের জবানবন্দি ও পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে ব্লগার আসিফের ওপর হামলায়ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম জড়িত ছিল।

অন্যদিকে, গত বছরের ১৫ নভেম্বর বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফিউল ইসলামকে হত্যার পর ‘আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ-২’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপের অ্যাকাউন্ট থেকে স্ট্যাটাস দিয়ে দায় স্বীকার করা হয়।

তবে অভিজিৎ হত্যার ২দিন পরও নিরুত্তর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যদিও তারা বলছেন প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।

এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলেন, বাইরে থেকে সব ঘটনা একই রকম মনে হলেও আসলে প্রতিটি ঘটনার ভিন্ন রকম পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে। ভিন্ন রকম গোষ্ঠী আছে।

তিনি বলেন, ‘আমরা কাজ করছি, সময় ধরে বলা যাবে না। তবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব এর পেছনে যারা জড়িত, তাদের খুঁজে বের করতে।’

ঘটনাস্থলের আশপাশে থাকা পুলিশ সদস্যদের গাফিলতি ছিল কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

উল্লেখ্য, অভিজিৎ ও স্ত্রী রাফিদা যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। অভিজিৎ ‘মুক্তমনা’ ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও লেখক। ‘কুসংস্কার ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে’ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৭ সালে জাহানারা ইমাম পদক পায় মুক্তমনা।

অভিজিৎ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পাস করার পর সেখানে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন।

আট বছর আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানকার একটি প্রতিষ্ঠানের সফটওয়্যার প্রকৌশলী তিনি।

২০০৮ সালে তিনি রাফিদাকে বিয়ে করেন। এ বছর ১৬ ফেব্রুয়ারি স্ত্রীকে নিয়ে দেশে ফেরেন। আগামী মাসে স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা ছিল।

দুই ভাইয়ের মধ্যে অভিজিৎ বড়। ‘একুশে গ্রন্থমেলায়’ অভিজিৎ-এর তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বইয়ের প্রকাশনা উপলক্ষে সস্ত্রীক তিনি ১৬ ফেব্রুয়ারি দেশে আসেন।


জেইউ/এসআরজে

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।