এবারের বইমেলা
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
১. এবারের বইমেলাটা অন্যরকম। আগে কখনো টানা অবরোধ হরতালে বইমেলা হয়নি। প্রথম প্রথম আমার একটু সন্দেহ ছিল, মানুষজন বইমেলায় আসবে কি না। অবরোধ কিংবা হরতাল পালন করার জন্য মানুষজন বইমেলা বয়কট করবে, সেটা কখনোই ভাবিনি। কিন্তু পেট্রোল বোমা, ককটেলের ভয়ে লোকজন মেলায় এসে স্বস্তি পাবে কি না, সেটা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। দেখা গেল, এ দেশের মানুষের পেট্রোল বোমা আর ককটেলের জন্যে যেটুকু ভয়, বইয়ের জন্যে ভালোবাসা তার থেকে অনেক বেশি। আমি সিলেটে থাকি, শুক্র-শনিবার বইমেলায় আসতে পারি। এবারে ছুটি নিয়ে পুরো সপ্তাহের জন্যে ঢাকা চলে এসেছিলাম বইমেলায় যাবার জন্যে। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে, এই বইমেলার কোন জিনিসটি আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে, আমার উত্তরটি হবে খুবই সহজ। আমি বলব, সেটি হচ্ছে বইমেলায় উপস্থিত এই দেশের অতি বিচিত্র মানুষ। মেলায় থাকা অবস্থায় ঘড়ির কাঁটা যখন রাত ৮টার কাছাকাছি পৌঁছায়, তখন আমি আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কাউকে জিজ্ঞেস করি, ‘কী হলো? ৮টা বেজে যাচ্ছে , এখনো কিছু ঘটল না?’
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলে, ‘ঘটবে! নিশ্চয়ই ঘটবে।’ এবং সত্যি সত্যি ব্যাপারটি ঘটে। আশপাশে কোনো জায়গায় বিকট শব্দ করে একটা ককটেল ফাটে। আমি মেলার শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী কিংবা মধ্যবয়স্ক মানুষের দিকে তাকাই এবং সবিস্ময়ে আবিষ্কার করি একটি মানুষেরও একটু ভ্রু পর্যন্ত কুঞ্চিত হয়নি। দেখে মনে হয়, তারা সেই বিকট শব্দটি শুনতেই পায়নি! যে যার মতো মেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, কথা বলছে, বই দেখছে। ভয় দেখানোর জন্যে বোমা ফাটানোর পরও যদি কেউ বিন্দুমাত্র ভয় না পায়, তাহলে বোমাবাজদের জন্য তার থেকে বড় ট্র্যাজেডি আর কী হতে পারে?
তার পরও মেলাটি নিয়ে আমার ভেতরে একটা দুঃখবোধ আছে। আমার পরিচিত অনেকেই ঢাকার বাইরে থাকে। তাদের মাঝে অনেকেই লেখক, কেউ নতুন লেখক, কেউ অনেকদিন থেকে লিখেছে। বইমেলা এলে তারা দল বেঁধে বইমেলায় আসে। এবারে তাদের অনেকেই বই মেলায় আসতে পারেনি। নিজের বই বের হয়েছে, বইয়ের স্টলে সেই বইটি দেখতে পারেনি। অবশ্য এটা নিয়ে দুঃখ করলে সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে- যখন এসএসসি পরীক্ষার জন্যে হরতালে ছাড় দেয়া হয় না, তখন বইমেলা দেখতে আসার জন্যে হরতালে ছাড় দেয়া হবে, সেটি আশা করার মতো উৎকট রসিকতা আর কী হতে পারে?
২. পুরোনো লেখালেখি ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখলাম, বছরের এই সময়টাতে গত বছর ঠিক একইভাবে আমি বইমেলার ওপর একটা লেখা লিখেছিলাম। লেখার দুটো বিষয় আলাদাভাবে চোখে পড়ল। গতবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসে আমার খুব আশা ভঙ্গ হয়েছিল, কারণ আমি লিখেছিলাম, বই মেলাটিকে মোটেও বইমেলা মনে হয়নি, মনে হয়েছে শুধু বই বিক্রি করার জন্যে গাদাগাদি করে দাঁড়া করানো কিছু বইয়ের স্টল! ঘিঞ্জি স্টলের ভেতর মানুষজন ঘেঁষাঘেঁষি করে হাঁটাহাঁটি করছে। এবারে মেলায় এসে আমার সেই দুঃখ দূর হয়েছে। বিশাল এলাকা নিয়ে বইয়ের মেলা, সুন্দর স্টল, তার চাইতেও সুন্দর প্যাভিলিয়ন এবং তার চাইতেও সুন্দর হচ্ছে ঘুরে বেড়ানোর জন্যে ফাঁকা জায়গা। হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে গেলে বসার জন্যে বাঁশের তৈরি বেঞ্চ। তার সাথে যদি চা, কফি খাওয়ার জন্যে একটি দুটি স্টল থাকত, তাহলে আমার কোনো দুঃখ থাকত না।
গত বছর আমার আরো একটি খুবই গুরুতর বিষয় নিয়ে দুঃখ ছিল, সেটি হচ্ছে বাথরুমের অভাব। পরিষ্কার বাথরুমের প্রয়োজনীয়তার ওপর বিশাল একটা বক্তৃতা দিয়ে আমি লিখেছিলাম : ‘বাংলা একাডেমির বইমেলার বাথরুমের মতো কুৎসিত, জঘন্য, অপরিষ্কার, অস্বাস্থ্যকর জায়গা পৃথিবীর আর কোথাও নেই!’ শুধু তা-ই নয়, কোনো একজন বিখ্যাত মানুষের উদ্ধৃতি দিয়ে আমি বলেছিলাম, ‘যে জাতি যত সভ্য তাদের বাথরুমের সংখ্যা তত বেশি এবং তাদের বাথরুম তত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন!’ এবারের বইমেলায় গিয়ে আমি আবিষ্কার করলাম, এক বছরে আমরা অনেক বেশি সভ্য জাতি হয়ে গেছি, এই বইমেলায় ঝকঝকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন তকতকে বাথরুমের সারি। প্রকৃতির ডাকে যাদের বাথরুমে যেতে হয়েছে তাদের কাছে বইয়ের স্টলে সাজানো বইয়ের সারি থেকে সেই বাথরুমের সারি কম দৃষ্টিনন্দন মনে হয়নি!
৩. বইমেলায় অনেক স্টল ছিল আমি সেগুলোর ভেতর থেকে শুধু একটা স্টলের কথা আলাদা করে বলি। স্টলটির নাম স্পর্শ এবং সেই স্টলের বইগুলো অন্যরকম। অন্যান্য স্টলের বইয়ের মতো সেগুলো চোখে দেখে পড়া যায় না, সেগুলো স্পর্শ করে পড়তে হয়, কারণ বইগুলো ব্রেইলে লেখা। যারা চোখে দেখতে পায় না তাদের জন্যে আলাদাভাবে এই বইগুলো ছাপতে হয়। ছয়টি একটু উঁচু হয়ে থাকা ফুটকি দিয়ে ব্রেইল লেখা হয়। যারা দেখতে পায় না তারা ব্রেইলে লিখতে পড়তে শেখে। একটা বই তাদের পড়ে শোনালে তার বিষয়বস্তুটা শুনতে পারে, বুঝতে পারে কিন্তু তাতে তাদের লেখাপড়া শেখা হয় না, বানান শেখা হয় না, বাক্য গঠন শেখা হয় না। তাই যেসব ছেলেমেয়ে চোখে দেখতে পায় না, তাদের লেখাপড়ার জন্যে ব্রেইল বই দরকার। আমাদের দেশের দৃষ্টিহীন ছেলেমেয়েরা এক দিক থেকে খুব দুর্ভাগ্যের শিকার, তাদের জন্যে যথেষ্ট দূরে থাকুক, প্রয়োজনীয় ব্রেইল বইও নেই।
দুই বছর আগে বইমেলায় আমার কিশোর উপন্যাস একই সঙ্গে ছাপা বই এবং ব্রেইল বই হিসেবে বের হয়েছিল। আমার কাছে সেই ব্রেইল বইয়ের দুটি কপি রয়ে গিয়েছিল। আমি সেই বই দুটি উপহার হিসেবে সেই স্টলে নিয়ে গিয়েছিলাম। স্টলে গিয়ে দেখি, সেখানে বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে স্কুলের পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে, তারা সবাই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কিন্তু সবাই স্কুলের ছাত্রছাত্রী। আমি বাচ্চাকাচ্চাদের জন্যে লিখি, এই বয়সি ছেলেমেয়েরা অনেকেই আমার লেখা পড়েছে। ব্রেইলে আমার বই একটির বেশি দুটি আছে কি না আমার জানা নেই, তাই এই ছেলেমেয়েগুলো আমার কোনো বই পড়েছে কি না সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম না। কিন্তু আমি খুবই অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম ছেলেমেয়েগুলোর কাছে আমার পরিচয় দেয়া মাত্রই তারা আমাকে চিনতে পারল এবং আমাকে পেয়ে খুব খুশি হয়ে উঠল। বেশ অনেকক্ষণ নানা বিষয় নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা হলো। তারা আমাদের খুব সুরেলা গলায় গান গেয়ে শোনাল।
দেখতে দেখতে ছোট স্টলের সামনে বেশ ভিড় জমে গেল। সাংবাদিকেরা নোট বই এবং ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল এবং কোথা থেকে জানি একটা টেলিভিশন চ্যানেলও তাদের ক্যামেরা নিয়ে হাজির হলো। আমি তখন অনেকদিন থেকে যে স্বপ্নটা লালন করে এসেছিলাম, সেটা ঘোষণা করে এলাম। সবাইকে সাক্ষী রেখে বলে এলাম, এখন থেকে যখনই আমি কিশোর-কিশোরী বা ছেলেমেয়েদের জন্যে কিছু লিখব, প্রকাশককে পাণ্ডুলিপি দেবার আগে তাদের জন্যে একটা শর্ত জুড়ে দেব- একই সাথে সেই বইটি ব্রেইলেও বের করতে হবে। অন্য যারা কিশোর-কিশোরী বা ছেলেমেয়েদের জন্যে লিখেন, তাদের সবাইকেও একই কাজ করতে বলব। তাহলে দেখতে দেখতে আমাদের দেশের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের জন্যে ব্রেইল বইয়ের বিশাল একটা ভাণ্ডার গড়ে উঠবে। সবাই যদি এগিয়ে আসে, তাহলে পরের বছর বই মেলায় হয়তো ‘স্পর্শ’ প্রতিষ্ঠানটি ছোট একটি স্টল নিয়ে কুলাতে পারবে না। ব্রেইল বইয়ের বিশাল ভাণ্ডারের জন্যে মস্ত একটি প্যাভিলিয়ন নিতে হবে!
আমি যখন ছেলেমেয়েগুলোর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি তখন তারা বলল, ‘স্যার, একটা অটোগ্রাফ!’ আমি ব্রেইলে অটোগ্রাফ দিতে পারি না- তাই সাধারণ কাগজে সাধারণ কলমে অটোগ্রাফ দিয়ে এসেছি। তারা সেটা পেয়েই যথেষ্ট খুশি। এই বয়সটাই মনে হয় আসলে খুশি হওয়ার বয়স।
৪. বাইমেলায় গেলেই সবারই নানা ধরনের অভিজ্ঞতা হয়, আমার ধারণা, আমার অভিজ্ঞতাটা অন্য অনেকের অভিজ্ঞতা থেকে বেশি চমকপ্রদ। যেমন আমি একটি বই না কিনেই বইয়ের বিশাল বোঝা নিয়ে বাসায় ফিরি। নতুন লেখকেরা আমাকে তাদের বই উপহার দিয়ে যান, সব বই আমার পড়া হয় না কিন্তু বইগুলি আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি এবং প্রায় সময়েই আমার নিজের প্রথম বইয়ের কথা মনে পড়ে যায়। আমি আমার প্রথম বইটি হাতে নিয়ে যে উত্তেজনা অনুভব করেছিলাম এই নতুন লেখকেরাও নিশ্চয়ই সেই একই উত্তেজনা অনুভব করেন। কিছু কিছু বইয়ের পেছনের কাহিনি অবিশ্বাস্য। যেমন একটি মেয়ে ভিড়ের ভেতর আমাকে তার নিজের হাতে লেখা একটি বই দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। বাসায় এসে বইটি খুলে দেখি তার গ্রামে সবাই তাকে ‘খারাপ মেয়ে’ হিসেবে অপবাদ দেওয়ার চেষ্টা করছে। সেই অপবাদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে সে তার জীবনের ইতিহাসটুকু লিখে বই হিসেবে ছাপিয়ে প্রকাশ করে ফেলেছে! বই লেখার এই কাহিনি দিয়েই নিশ্চয়ই একটি বই লিখে ফেলা যায়।
বই মেলায় গিয়ে আমি যেসব বই উপহার পাই, তার একটা অংশ থাকে আমাকে উৎসর্গ করা বই। এই বছরটি সেই হিসেবে আমার জন্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই বছর আমার ঢাকা কলেজের শিক্ষক প্রফেসর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ থেকে শুরু করে অষ্টম শ্রেণির একটা ছাত্রীর লেখা বই আমাকে উৎসর্গ করা হয়েছে। কতজনের এত বড় পরিসরের মানুষজনের কাছ থেকে বই উৎসর্গ পাওয়ার সৌভাগ্য হয়?
৫. বইমেলাতে সবকিছুই যে ভালো তা নয়, কিছু কিছু খুব খারাপ ঘটনা ঘটে, মানি ব্যাগ, মোবাইল অদৃশ্য হয়ে যাওয়া তার মাঝে একটি। আমি অবশ্য সেটাকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। পকেটমারা সম্ভবত পৃথিবীর আদিমতম পেশাগুলোর একটি। আমার মা যখন হজে গিয়েছিলেন, সেইখানে তার পকেট মেরে দিয়েছিল। আমার সাদাসিধে মা লজ্জায় বহুদিন সেই ঘটনার কথা আমাদের বলেননি। শুনেছি, হজের সময় প্লেন ভরে এই দেশের অনেক বিখ্যাত পকেটমার মক্কায় পকেট মারতে যায়! কাজেই বইমেলায় ভিড়ের মাঝে কিছু পকেট মার উপার্জন করার জন্যে আসবে না, সেটা তো হতে পারে না। লেখক, প্রকাশক, চিংড়ি মাছের মাথা বিক্রেতা, চুড়িওয়ালি, পাইরেটেড বই বিক্রেতা, নতুন লেখকদের ফাঁকি দেয়া প্রকাশকরূপী প্রতারক, ককটেল ফাটানোর সাবকন্ট্রাক্ট নেয়া ছিন্নমূল তরুণ সবাই যখন কিছু অর্থ উপার্জন করে নিচ্ছে তখন পকেটমাররা বাকি থাকবে কেন?
তবে বইমেলার (কিংবা অন্য যেকোনো মেলার) যে বিষয়টি আমাকে খুব কষ্ট দেয় সেটি হচ্ছে ভিড়ের সুযোগ নিয়ে কিছু পুরুষ যখন মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করে। একটা সময় ছিল যখন মেয়েরা দাঁতে দাঁত চেপে এগুলো সহ্য করেছে- আজকাল করে না। ভিড়ের কারণে সব সময় তারা মানুষটিকে ধরতে পারে না, কিন্তু যদি ধরতে পারে তাহলে তার কপালে বড় ধরনের দুঃখ থাকে। এই বইমেলাতেই ‘ঢিশুম’ শব্দ শুনে দেখি একটি কমবয়সি মেয়ে একজন তরুণের নাকে ঘুষি মেরে দিয়েছে। তারপর ঘুরে অন্য আরেকজনের নাকে আরেকটি ঢিশুম! (এই বইমেলাতেই আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের নয় ছাত্রীকে একটা বই উৎসর্গ করেছি- আমি ছাত্রীদের কথা দিয়েছিলাম, যারা প্রথম ব্ল্যাক বেল্ট পাবে, আমি তাদেরকে একটা বই উৎসর্গ করব! আমি আমার কথা রেখেছি। কাজেই মেয়ে দেখলেই যাদের হাত নিশপিশ করে তারা সবাধান- কখন একজন ব্ল্যাক বেল্টের হাতে পড়ে তুলোধুনা হয়ে যাবে কে বলবে?)
যা-ই হোক, মন খারাপ করা একটা বিষয় দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই না। একটা মজার ঘটনা বলে লেখা শেষ করি। আজকাল পাঠকেরা লেখকদের কাছ থেকে অটোগ্রাফ নেয়ার জন্যে খুবই আগ্রহী। যারা সত্যিকারের লেখক তাদের সত্যিকারের পাঠক থাকে এবং সেই পাঠকেরা তাদের লেখকদের কাছ থেকে মোটামুটি একটা সম্মানজনক প্রক্রিয়ায় অটোগ্রাফ নিয়ে থাকেন। আমি যেহেতু কমবয়সি ছেলেমেয়েদের জন্যে লেখালেখি করি আমার অবস্থাটা একটু ভিন্ন- আমার পাঠকেরা কমবয়সি এবং তাদের অটোগ্রাফ নেয়ার প্রক্রিয়া যথেষ্ট আদিম। তারা অটোগ্রাফ নেবার জন্যে ঘিরে ধরে, চেপে ধরে, ধাক্কাধাক্কি করে, চিৎকার করে এবং প্রয়োজন হলে হুমকি দেয়। মাঝে মাঝে তাদের দেখে মনে হয় অটোগ্রাফ নামের এই অতি বিচিত্র বিষয়টি নিতে না পারলে তাদের জীবন অর্থহীন হয়ে যাবে। তবে অটোগ্রাফ নিয়ে আমার অতি বিচিত্র অভিজ্ঞতাটি হয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারির দুপুরবেলা। অনেকেই আমাকে ঘিরে ধরেছে এবং তাদের সবাইকে ঠেলে একজন তরুণ এগিয়ে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একটা কাগজ আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘সাইন করে দেন।’
আমি অন্য কারো বইয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছিলাম। বললাম, ‘এটা শেষ করেই দিচ্ছি।’
তরুণটির ধৈর্য্ নেই। মেঘ স্বরে বলল, ‘সাইন করে দেন।’
আমি বললাম, ‘একটু দাঁড়াও।’
কিন্তু তার দাঁড়ানোর সময় নেই, রীতিমতো হুমকি দিয়ে বলল, ‘সাইন করেন।’
অবস্থা বেগতিক দেখে আমি তাড়াতাড়ি তার কাগজে অটোগ্রাফ দিলাম। তরুণটি কাগজটি হাতে নিয়ে মোবাইল বের করল। আজকাল সব মোবাইলেই ক্যামেরা থাকে, সে সেই ক্যামেরায় ছবি নিয়ে ভিড় ঠেলে বের হয়ে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে গেল। ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কে? আপনার নাম কী?’
বইমেলায় প্রতিদিনই এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটে আর আমার মনে হয় আহা বেঁচে থাকাটা কী মজার!
লেখক: শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
এআরএস/এমএস