দুর্নীতির অভিযোগে বরাদ্দ কাটছে উন্নয়ন সহযোগীরা


প্রকাশিত: ০২:২৮ এএম, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

দেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প `পদ্মা সেতু প্রকল্প` নিয়ে বছর চারেক আগে সরকারের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সম্পর্কের টানাপড়েন তৈরি হয়েছিল; সেটি এখন আর নেই। সম্পর্ক এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন স্থগিত করা সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল না সেটি স্বীকার করে বরাদ্দের ওই ১২০ কোটি ডলার অন্য প্রকল্পে স্থানান্তরও করেছে সংস্থাটি। তবে অনিয়ম-দুর্নীতির ক্ষেত্রে তারা আগের অবস্থানেই আছে।

পদ্মা সেতু-কাণ্ডের পর তাদের অর্থায়নে চলমান প্রতিটি প্রকল্পে নজরদারি বাড়িয়েছে বিশ্বব্যাংক। হিসাব-নিরীক্ষায় (অডিট) আগে কিছু ছাড় দেওয়া হলেও মন্ত্রণালয়গুলোকে এখন ন্যূনতম ছাড়ও দেওয়া হচ্ছে না। প্রকল্পে কোনো ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। গত এক বছরে বেশ কয়েকটি প্রকল্পে কেনাকাটায় দুর্নীতি হয়েছে- এ অভিযোগ এনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। অনিয়মের টাকা ফেরত দেওয়ার দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি। কিছু ক্ষেত্রে তারা টাকা কেটেও নিয়েছে।

অনিয়ম-দুর্নীতির এমন অভিযোগে বেকায়দায় পড়েছে সরকার। কারণ সরকারের একাধিক তদন্তেও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের পাশাপাশি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), অস্ট্রেলিয়ার ডিপার্টমেন্ট অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ট্রেড (ডিএফএটি) এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নও তাদের অর্থে চলমান প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ এনে যে পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে তা কেটে রাখছে। বরাদ্দ-কর্তনে একটি সংস্থা ব্যত্যয়ী আচরণও করেছে। বরাদ্দ কাটায় ওই সব প্রকল্প বাস্তবায়নে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে।

অনিয়ম-দুর্নীতির এসব ঘটনাকে অনাকাঙ্ক্ষিত উল্লেখ করে বহিঃসম্পদ বিভাগের (ইআরডি) জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিন বলেন, এতে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে, সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। তিনি জানান, উন্নয়ন সহযোগীদের অভিযোগ আমলে নিয়ে অভিযুক্ত মন্ত্রণালয়গুলোয় চিঠি পাঠাচ্ছে ইআরডি, যাতে সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান হয়।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পে অর্থ খরচে অনিয়মের অভিযোগ এনে গত সপ্তাহে ইআরডিতে চিঠি পাঠিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তারা বলছে, ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট শীর্ষক ওই প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট পাঁচ সরকারি কর্মকর্তা বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে নিয়ম ভেঙে বাড়তি অর্থ খরচ করেছেন। এতে পাঁচ লাখ টাকার অনিয়ম হয়েছে। এ টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ইআরডিকে অনুরোধ জানিয়েছে সংস্থাটি। এই অভিযোগের নিষ্পত্তির লক্ষ্যে গত রোববার পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন ইআরডির জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিন।

জানা গেছে, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা সাইফুল আলম বলেন, ওই কর্মকর্তারা বিদেশ ভ্রমণের সময় কিছু ভুল তথ্য দিয়েছেন। সে জন্য অতিরিক্ত টাকা খরচ হয়েছে। এখন তা সংশোধনের প্রক্রিয়া চলছে।

প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নবিষয়ক পিইডিপি (তিন) প্রকল্পেও দুর্নীতির অভিযোগ এনে প্রায় তিন লাখ ডলার কেটে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ইআরডিতে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি) বাস্তবায়নের সময় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর তাদের ক্রয়-নীতিমালা না মেনে কেনাকাটা করেছে। এতে তিন লাখ ডলার অনিয়ম হয়েছে। এ জন্য বরাদ্দ থেকে ওই পরিমাণ অর্থ কেটে নেওয়া হবে।

বিশ্বব্যাংকের পথ অনুসরণ করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও (এডিবি)। গত ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এডিবির আবাসিক প্রতিনিধি কাজুহিকো হিগুইচি ইআরডিতে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পিইডিপি (তিন) কর্মসূচির ২১টি সিভিল ওয়ার্কসে কেনাকাটায় অনিয়ম হয়েছে। এ জন্য এডিবি কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ থেকে দুই লাখ ৯৫ হাজার ডলার কেটে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কর্মসূচি ভবিষ্যতে যাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে বাস্তবায়িত হয় সে অনুরোধ জানিয়েছে এডিবি।

গত ডিসেম্বরে পিইডিপি (তিন) প্রকল্প থেকে প্রায় ৩০ লাখ ডলার প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেয় অস্ট্রেলিয়ার সরকারি সংস্থা ডিএফএটি। গত ১১ ডিসেম্বর ইআরডিতে চিঠি দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া দূতাবাস। পরের কিস্তিতে এ পরিমাণ অর্থ কম দেওয়া হবে বলে ডিএফএটির কাউন্সেলর প্রিয়া পাওয়েল চিঠিতে জানান। তাঁরাও পিইডিপি (তিন) কর্মসূচিতে দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। ওই কর্মসূচিতে যে দুর্নীতি হয়েছে, সেটি সরকারের তদন্তেও প্রমাণিত হয়েছে। উন্নয়ন সহযোগীদের চিহ্নিত ২১ কাজে অনিয়মে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে এলজিইডি তদন্ত শুরু করে। তদন্তে ১৭ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ক্রয়কাজে অনিয়মে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। এসব প্রতিষ্ঠানকে চার-পাঁচ বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করেছে এলজিইডি। অনিয়মে জড়িত এলজিইডির দুই উপজেলা প্রকৌশলী ও এক উপসহকারী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

এদিকে প্রথমবার সতর্ক করার পরও বিশ্বব্যাংক অর্থায়িত একটি প্রকল্পে আবার আর্থিক অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। এ জন্য দ্বিতীয় দফায় ওই প্রকল্প থেকে সাড়ে তিন লাখ ডলার ফেরত নিচ্ছে সংস্থাটি। এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রিপেয়ার্ডনেস অ্যান্ড রেসপনস প্রকল্প থেকে গত এপ্রিলে আর্থিক অনিয়মের জন্য প্রথম দফায় তিন লাখ ডলার ফেরত দিতে হয়েছিল সরকারকে। অনিয়মটি কেনাকাটায় হয়েছিল বলে বিশ্বব্যাংক বলেছিল।

আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ এনে ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইইউ) টাকা কেটে রেখেছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় চলমান স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম থেকে ১০ কোটি টাকা কেটে নিয়েছে সংস্থাটি। এতে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে প্রাথমিক স্তরের অতিদরিদ্র প্রায় সাড়ে চার লাখ শিক্ষার্থী। স্কুল ফিডিং কর্মসূচির আওতায় দেশের সাতটি বিভাগের ১০ উপজেলায় ওই শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন এক প্যাকেট করে পুষ্টিকর বিস্কুট পাচ্ছিল। অর্থ কেটে রাখায় এখন আর বিস্কুট পাচ্ছে না তারা।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং স্কুল ফিডিং কর্মসূচির কর্মকর্তারা জানান, ইইউর অর্থায়িত ভূমি মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পে ১০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। কিন্তু ভূমি মন্ত্রণালয় দাবি করে, অভিযোগ সত্য নয়। এই বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে দুই পক্ষের মধ্যে চিঠি চালাচালি হয়। কিন্তু সমাধান হয়নি। পরে স্কুল ফিডিং কর্মসূচির বরাদ্দ থেকে ওই টাকা কেটে নেয় ইইউ। এ কারণে কর্মসূচির কাজ ব্যাহত হচ্ছে।

স্কুল ফিডিং কর্মসূচির পরিচালক (পিডি) মসিউর রহমান বলেন, অর্থ ফেরত পাওয়ার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে অনেক দেনদরবার করেছি। ভূমি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও অনেক বৈঠক করেছি; কিন্তু সুরাহা হয়নি।` এখন ওই ১০ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান তিনি।

ইআরডির জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিন সম্প্রতি অন্য মন্ত্রণালয়ের এক সচিবের কাছে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করেন, কোনো প্রকল্পের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সুষ্ঠুভাবে ক্রয়-পরিকল্পনা বাস্তবায়ন একান্তভাবে প্রয়োজন। কিন্তু উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, ক্রয়-পরিকল্পনা সঠিকভাবে মেনে চলা হয় না। তিনি বলেন, এতে দেশের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে, ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। প্রকল্পের কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগ উঠলে তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।

এএইচ/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।