হাসি মুখে জেলে ঢুকছেন সবাই
দুপুর পৌনে ১২টা। প্রখর খরতাপে সারিবদ্ধভাবে শতাধিক আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা দাঁড়িয়ে আছেন। একজন লাইন ভেঙে সামান্য একটু সামনে এগোতেই ১৬-১৭ বছরের এক কিশোর উচ্চৈঃস্বরে চেঁচিয়ে উঠে বললো, আঙ্কেল আপনার আগে কিন্তু আমি ভেতরে ঢুকবো। লাইনের বাইরে চার-পাঁচ বছর বয়সী দুই কন্যাশিশুর হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক। বার বার উঁকিঝুঁকি দিয়ে লাইনে দাঁড়ানো এক আত্মীয়কে খুঁজছিলেন। হঠাৎ তাকে উদ্দেশ্য করে এক যুবককে বলতে শোনা যায়, ‘আর একটা মিনিট খাড়ান, এক্ষুণি সবাই একলগে ভেতরে ঢুকতে পারমো।’
বুধবার মধ্যাহ্নে সম্প্রতি স্থানান্তরিত পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটকের সামনে জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের সামনে এ দৃশ্য চোখে পড়ে। ২২৮ বছরের পুরনো এ কেন্দ্রীয় কারাগারে হাসি মুখে ভেতরে প্রবেশের কোনো নজির নেই। গত ২৯ জুলাই কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরের আগ পর্যন্ত ভেতরে প্রবেশের সময় আসামি ও তাদের স্বজনদের এখানে শুধু কাঁদতে দেখা গেছে।
কিন্তু বুধবার যারাই প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকছিলেন তাদের সবার চোখে-মুখে হাসি দেখা যায়। কারো মুখে এতটুকু মলিনতা নেই, নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে পরিপাটি পোশাক পরিধান ও সেজেগুজে জেলখানার ভেতরে যেতে দেখা যায়। এককালের মোগল দুর্গ, কোতোয়ালি পুলিশ স্টেশন ও পরবর্তীতে জেলখানায় রূপান্তরিত ১১ একর আয়তনের এ কারাগারটির সাথে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও রাজনীতির স্মৃতি জড়িত।
এ কেন্দ্রীয় কারাগারটি আজ বুধবার থেকে পরবর্তী চারদিন জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে কারা অধিদফতর। মাত্র ১০০ টাকায় টিকিট কিনে তারা দুই ঘণ্টা কারাগার পরিদর্শনের সুযোগ পাবেন। মঙ্গলবার থেকে সংগ্রামী জীবন গাঁথা শিরোনামে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার দুর্লভ আলোকচিত্র নিয়ে কারাগারের ভেতর প্রথম প্রদর্শনী উপলক্ষে তারা এ সুযোগ পাচ্ছেন।
সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা যায়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটকের সামনে দুটি স্থানে টিকিট বিক্রি চলছে। আগের অনুসন্ধান কক্ষের সামনে টেবিল পেতে নারী ও সিনিয়র সিটিজেন এবং প্রধান ফটকের দক্ষিণ দিকের এক কোণায় সাধারণ মানুষের কাছে টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে।
ধানমন্ডির মধুবাজারের বাসিন্দা ৭৫ বছরের বৃদ্ধ বেলায়েত হোসেনকে জেলখানা দেখাতে নিয়ে এসেছেন তার ভাতিজা স্বপন মিয়া। এক সময় চকবাজারে ব্যবসা করতেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে দিয়ে বহুদিন গেলেও ভেতরে ঢুকতে পারেননি।
কী কারণে আজ ভেতর যাচ্ছেন বলতেই বৃদ্ধের চোখেমুখে হাসির ঝিলিক। একটু দম নিয়ে বললেন, ‘আমরা হইলাম শেখ সাহেবের আমলের লোক। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার দুর্লভ চিত্রের প্রদর্শনী আর জেলখানা ঘুরে দেখার লোভ সামলাতে না পারায় অসুস্থ শরীর নিয়েও ভাতিজার সাথে ছুটে এসেছি।’
পলা, নিরা, সুইটি, সাজেদা ও মিলা এরা পাঁচ বান্ধবী ধানমন্ডির একটি বেসরকারি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। প্রধান ফটকের সামনে স্ক্যানিং মেশিন দিয়ে যাওয়ার সময় শব্দ হতেই কারারক্ষী হেসে জিজ্ঞাসা করেন, আপনার ব্যাগের ভেতর মেটাল জাতীয় কিছু আছে নাকি? এ কথা শুনে ওরা সবাই একত্রে হেসে উঠে বলে, চাবি, নেইল কাটার আরও কত কিছুই তো আছে, তবে বোমাটোমা নেই বলেই আবার হেসে উঠে। এবার কারারক্ষী তাদের সব বের করতে বলে সিরিয়াস ভঙ্গিতে তাকান।
বাড্ডা থেকে স্ত্রী, ছোট দুই মেয়ে ও এক ছেলেসহ পরিবার নিয়ে এসেছেন মো. হারুন মিয়া। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে জানান, ‘পেপারে ও টিভিতে দেইখ্যা আইছি। ভেতরে জীবনে যাই নাই, তবে কারাগারের ভেতরে কয়টি ভবন আছে, ভবনগুলোর কোনটিতে সাধারণ কয়েদি হাজতিরা থাকতো, কোথায় ভিআইপিরা থাকতো, কোথায় রন্ধনশালা, কোথায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ফাঁসিতে ঝোলানো হতো ইত্যাদি জানার আগ্রহ থেকে সবাইকে দেখাতে এসেছি।’
এমইউ/জেডএ/পিআর