মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত দগ্ধ রোগীরা


প্রকাশিত: ০৭:৪০ এএম, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা চলমান অবরোধ ও হরতালে দুর্বৃত্তদের ছোঁড়া পেট্রলবোমা ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দগ্ধ রোগীরা বিভিন্ন হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটকেই নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে ভাবছেন।

দেশের বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির গ্যাঁড়াকলে সাধারণ মানুষরাই বেশি দগ্ধ হচ্ছেন। তারা দগ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হলেও আর বাসায় ফিরতে চাচ্ছেন না।

হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তাররা বলছেন, পেট্রলবোমা বা ককটেলের বিকট আওয়াজের ধ্বনি এখনো তাদের কানে বাজে। অনেকে নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে বিশ্বাস করতে চান না তার অঙ্গার অবস্থা।

এসব মিলে দগ্ধ রোগীদের অনেকের মধ্যে উৎকণ্ঠা আর আতঙ্ক বিরাজ করছে। এই আতঙ্ক তাদের মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে যাওয়ায় স্থায়ীভাবে মানসিক সমস্যা দেখা দিতে দিচ্ছে। হরতাল-অবরোধে দগ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পথে আবারও দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রলবোমায় আগুনে দগ্ধ হবেন কিনা সেই শঙ্কা কাজ করছে অনেকের মনে।

আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আগুনে দগ্ধ হয়ে ‘মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই’ করছেন। ঢাকার বাইরে থেকে অনেকে হাসপাতালে আসছেন। স্বজনরা হরতাল-অবরোধ মাড়িয়ে হাসপাতালে আসতেও ভয় পাচ্ছেন।

এসব মিলিয়ে দগ্ধরোগীদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। যা পরবর্তী কয়েক বছর তাদের বয়ে নিয়ে বেড়াতে হতে পারে এমনকি স্থায়ীভাবেও হতে পারে। ইতোমধ্যে অনেক দগ্ধরোগীর মধ্যে এ সমস্যা দেখা দিয়েছে।

বছরজুড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে কার্যত রোগীর সংখ্যা কম থাকলেও এ বছরের শুরু থেকেই অগ্নিদগ্ধ রোগীর সংখ্যা ক্রমশই বেড়েছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে যন্ত্রণা, আর্তনাদ ও আহাজারি।

মঙ্গলবার সরেজমিনে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিট ঘুরে দেখা গেছে, একাধিক রোগীর যন্ত্রণা ও আহাজারির চিত্র। রোগী ও স্বজনদের আর্তনাদে বার্ন ইউনিটের বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে।

দগ্ধ রোগীদের কেউ শুয়ে আর্তনাত করছেন। কেউ স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছেন আবার কেউবা একই কক্ষের অন্য দগ্ধ রোগীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছেন। আবার অনেককে দেখা যাচ্ছে ভয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠতে।

এমনই একজন বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার (মোকামতলা) লক্ষ্মীপুরের সাজু মিয়া (৩০)। তিনি পেট্রলবোমার আঘাতে দগ্ধ হন। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি বিছানায় পড়ে থাকার কারণে তিন মেয়েকে নিয়ে স্ত্রী শাহানাজ না খেয়ে দিনাতিপাত করছেন।

কান্না জড়িত কন্ঠে শাহানাজ বলছেন, ‘আমাদের জন্য কিছু করেন। আমার স্বামীর কিছু হয়ে গেলে তিন মেয়েকে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়াতে হবে’। এ সময় অগ্নিদগ্ধ স্বামী সাজু হঠাৎ বলে উঠছেন “আগুন আগুন। আমাকে এখান থেকে সরাও আগুন লাগছে গায়ে আগুন।”

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শাহানাজ জানান, সুস্থ মানুষটি আগুনে পুড়ে গেছে। এরপর থেকে ভুলভাল বকছে। হঠাৎ ভয়ে জড়োসড়ো হচ্ছে। কখনো চিৎকার করে বলতেছে আগুন আগুন।

হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন পার্থ শংকর পাল বলেন, গত ৫ জানুয়ারির পর থেকে পেট্রলবোমা হামলা ও বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে ১০৪ জন দগ্ধ রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ৪৩ জন চিকিৎসা শেষে ছুটি নিয়েছেন। বর্তমানে ৫২ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। এর বাইরে প্রতিদিন ৫/৭ বা এর বেশি মানুষ দগ্ধ হয়ে ভর্তি হচ্ছেন।

পার্থ শংকর পাল বলেন, দগ্ধদের অবস্থার উন্নতির জন্য প্রায় ৯০ জনের বেশি চিকিৎসক বিভিন্ন শিফটে দায়িত্ব পালন করছেন। আহতদের শরীরের ১২ থেকে ৪৮ ভাগ দগ্ধ হয়েছে বলেও জানান তিনি।

দগ্ধ রোগীদের মধ্যে মানসিক কোনো সমস্যা দেখা দিতে পারে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, মানসিক সমস্যা হওয়াটাই স্বাভাবিক। কোনো মানুষ বাসে ঘুমাতে ঘুমাতে বোমার বিকট আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গে এরপর তারই শরীর পুড়ে যায় আগুনে। এটা কোনো স্বাভাবিক মানুষ মেনে নিতে পারে না। সে কারণে অনেকের মধ্যে ভয় বা আতঙ্ক কাজ করে।

তিনি বলেন, আমরা আপাতত মানসিক সমস্যার বিষয়টির চাইতে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি শারীরিক সমস্যাকে। কারণ শারীরিকভাবে সুস্থ হতে না পারলে মারা যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সুস্থতার পর মানসিক সমস্যা উত্তোরণে কাজ করা সম্ভব।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. এস এম ওসমান গনি জাগোনিউজকে বলেন, কোনো ঘটনায় সুস্থ মানুষের যখন অঙ্গহানি ঘটে তখন সে হীনমন্মতায় ভোগে। সে ভাবে তার দ্বারা আর কাজ করা সম্ভব হবে না। পরিবারের কী হবে, নিজের কী হবে, এসব ভেবে সে নিজেকে সমাজের একজন বোঝা হিসেবে চিহ্নিত করে ডিপ্রেশনে ভোগে। এসব কারণে ফিজিক্যালি ডিজঅর্ডার মানুষ মানসিক সমস্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

জাতীয় মানুসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এর সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. জিল্লুর রহমান খান(রতন) জাগোনিউজকে বলেন, প্রচণ্ড ভয় থেকেই মানুষের মানসিক সমস্যা হতে পারে। কারণ কল্পনার বাইরে গিয়ে কোনো কিছু ঘটে গেলে তা মানতে না পারার কারণে সমস্যা দেখা দেয়।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক সাইকিয়াট্রি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. মো. ওয়াজিউল আলম চৌধুরী জাগোনিউজকে বলেন, ভয় বা আতঙ্ক থেকে মানসিক রোগ দেখা দিতে পারে। বোমার শব্দে ঘুম ভাঙ্গলে বা পেট্রলবোমায় দগ্ধ হওয়ার পর রোগীদের মধ্যে সব সময় সেই ভয়াল দৃশ্যের কথা মনে পড়ে আর শিউরে উঠে।

অনেকে ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। আবার অনেকে জ্ঞান না হারালেও সেই ভয়টা ভিতরে পুষতে থাকেন। যা পরবর্তীতে মানসিক সমস্যায় পরিণত হয়। আবার যারা দগ্ধ হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন বাস্তবতার কারণে তাদের মানসিক সমস্যার আগে শারীরিকভাবে সুস্থতা অনিবার্য হয়ে পড়ে।

প্রফেসর ডা. মো. ওয়াজিউল আলম চৌধুরী বলেন, কোনো রোগী যখন শারীরিকভাবে সুস্থতার পর আয়নায় নিজেকে দেখে উৎকণ্ঠা আর ভয় কাজ করে। ভয় আর আতঙ্কের কারণে তারা ডিপ্রেশনে চলে যায়।

তিনি বলেন, যারা দগ্ধ হচ্ছেন তাদের বেশিরভাগ মানুষই গরীব মানুষ। কোনো পরিবারের কর্মক্ষম মানুষটিই যখন দগ্ধ হয়ে অসুস্থতা নিয়ে বিছানায় পড়ে থাকেন, তখন পরিবারের খাওয়ার চিন্তা নিজের চিকিৎসার খরচের চিন্তা বিষাদভাবে ভর করে মনে।

ওয়াজিউল আলম চৌধুরী বলেন, এমন রোগীদের মধ্যে পিটিএসডি রোগের আবির্ভাব ঘটে। যে কারণে ৫/৬ মাস বা অনেকক্ষেত্রে অনেক বেশি সময় তাদের মধ্যে এই সমস্যা থেকে যায়।

এ থেকে উত্তোরণে উপায় কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা ও পুনবার্সনে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিত্তবান মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে।

দগ্ধ মানুষগুলো যাতে দুশ্চিন্তায় না ভোগে সেজন্য দ্রুত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাদের মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে উত্তোরণে সাহস যোগাতে হবে। প্রয়োজনে কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা নিতে হবে।

জাতীয় মানসিক হাসপাতালে এমন রোগীদের চিকিৎসার কোনো প্রস্তুতি রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের এখানে রানা প্লাজা ধ্বসের ঘটনায় অসুস্থ অনেক মানুষ চিকিৎসা নিচ্ছেন। সরকার প্রয়োজনবোধ করলে আমরা দগ্ধ রোগীদের মানসিক রোগের চিকিৎসা দিতে প্রস্তুত রয়েছে। আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।

জেইউ/বিএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।