মগবাজার-মৌচাক উড়ালসড়কে কাজ হয়েছে মাত্র ৪২ শতাংশ
চলতি বছরের ডিসেম্বর নাগাদ রাজধানীর বহুল আকাঙ্খিত মগবাজার-মৌচাক উড়ালসড়কের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হচ্ছে না। দুটি অংশ মিলে এখন পর্যন্ত পুরো উড়ালসড়কের কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ৪২ শতাংশ।
হিসেব অনুযায়ী প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ৭৭২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। কাজে সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে এই ব্যয় আরও বাড়বে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
১০ জানুয়ারির মধ্যে উড়াল সড়কের নিচের রাস্তাটা যানবাহন চলাচলে উপযোগী করতে হবে বলে গত বছরের ২৩ ডিসেম্বরে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঘোষণা করলেও তা সম্ভব হয়নি।
নগর বিশেষজ্ঞ মনে করেন, কাজের সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব আর সমন্বয়হীনতার কারণে নগরের ব্যস্ততম এলাকায় যে কাজটি করা হচ্ছে, তা নগরবাসীর দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দেবে। নির্মাণ ব্যয়ও অনেক বেশি হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মগবাজার-মৌচাক সমন্বিত ফ্লাইওভার- এর দুটি অংশ চালু হওয়ার কথা ছিল গতবছরের শেষ নাগাদ। এক অংশের কাজ শুরু হয়েছে গত বছরের জানুয়ারিতে। অপর অংশটি রামপুরা-শান্তিনগর। এটি চালুর কথা এ বছরের ডিসেম্বরে।
তবে কাজের সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনোভাবেই কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না।
বিস্তারিত নকশা ছাড়াই কাজ শুরু: প্রায় সোয়া আট কিলোমিটার এলাকা জুড়ে মগবাজার-মৌচাক উড়ালসড়কের দৈর্ঘ্য। উড়ালসড়কটি নকশার ভিত্তিতে কাজ শুরু কথা থাকলেও তা করা হয়নি।
২০০৫ সালে এই উড়ালসড়ক নির্মাণের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানি সমীক্ষা করে নকশা করেছিল। এই আট বছরে প্রকল্প এলাকার অবকাঠামোগত অনেক পরিবর্তন হলেও তা বিবেচনা না করে আগের নকশা ধরে কাজ শুরু হয়।
বিস্তারিত যাচাই-বাছাই না করেই কার্যাদেশ দেওয়া হয়। মাটির নিচে বিভিন্ন সংস্থার পাইপ ও তারের অবস্থান নির্ণয় না করে কাজ শুরু করার ফলে বাধ্য হয়ে নকশায় আনা হয় পরিবর্তন। ফলে কাজের গতি কমে মানুষের দুর্ভোগ যেমন বাড়ছে তেমনই প্রকল্পে নির্মাণ খরচও বেড়েছে শত কোটি টাকা।
ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংস্থা কাজের ব্যাঘাত ঘটায় জরিমানা গুনতে হচ্ছে ৩ কোটি টাকারও বেশি।
উড়ালসড়কটির বাংলামোটর-মৌচাক অংশের ৫০ শতাংশ এবং তেজগাঁও সাতরাস্তা-মগবাজার হলি ফ্যামিলি অংশের ৫২ শতাংশ কাজ হয়েছে। এ দুটি অংশ চালু হওয়ার কথা ছিল গত ডিসেম্বরে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে রামপুরা-শান্তিনগর অংশ চালুর কথার কথা থাকলেও কাজ হয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ।
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।
নিয়ম লঙ্ঘন করে উপঠিকাদার নিয়োগ : এলজিইডি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, উড়ালসড়কটির বাংলামোটর-মৌচাক অংশের কাজ যৌথভাবে পায় চীনা কোম্পানি এমসিসিসি (নম্বর ৪) এবং ইউডিসি কনস্ট্রাকশন লিমিটেড ও শামীম এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড (এমইএল)। প্রায় ২০০ কোটি টাকার কাজ দুই প্রতিষ্ঠানের ভাগবাটোয়ারা হয়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে কাজ করছে তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
সূত্রটি জানায়, উড়ালসড়কটির বাংলামোটর-মৌচাক অংশের ১০ ভাগ কাজের জন্য তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেডকে উপঠিকাদারী দেওয়া হয়। যা ক্রয় আইন, ২০০৬ এবং ক্রয় বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী ব্যত্যয় ঘটেছে।
ইউডিসির কনস্ট্রাকশন লিমিডেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কালাম হোসেন জানান, কাগজে কলমে বিল হচ্ছে ওই তিন প্রতিষ্ঠানের নামে কিন্তু পরে তা চলে যাচ্ছে তমার হিসাবে।
এছাড়াও প্রকল্পে উপঠিকাদারও নিয়োগ করা হয়েছে নিয়ম লঙ্ঘন করে। অভিযোগ রয়েছে, পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে নয় কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে এলজিইডির প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক নাজমুল আলম জানান, কাজের গুরুত্বের কারণে বিস্তারিত নকশা (ডিজাইন) ছাড়াই প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে সম্প্রতি কাজের সমন্বয় আনা হয়েছে দাবি করে বলেন, এ পর্যন্ত সার্বিক কাজ হয়েছে ৪০ শতাংশ। এ বছরেই দুটি অংশ চালু হবে।
এছাড়াও রয়েছে পরামর্শক নিয়োগে বড় ধরনের আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিষ্ঠান স্মেক এবং বাংলাদেশের ক্রান্তি অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্তু চুক্তির পর নিয়ম লঙ্ঘন করে ডেপুটি টিম লিডার (ডিটিএল) ও স্ট্রাকচারাল প্রকৌশলী পরিবর্তন করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি।
সম্প্রতি মগবাজার-মৌচাক উড়ালসড়কের কাজ পরিদর্শনে এসে উপস্থিত সাংবাদিকদের সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, চলতি বছরের অক্টোবর নাগাদ নির্মাণ কাজ শেষ হবে।
এ ব্যাপারে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ শুরু করার আগে আমাদের উচিত ছিল জনদুর্ভোগের বিষয়টি চিন্তা করা। বনানী ফ্লাইওভার নির্মাণের সময় সেনাবাহিনী বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখায় সেখানে কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু এখানে প্রবলেম হচ্ছে।
তিনি বলেন, এই ফ্লাইওভারের কাজ দ্রুত শেষ করতে পারলে ভালো হতো। জনদুর্ভোগের বিষয়টি বিবেচনা করে বর্ষা মৌসুমে নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকায় কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছে।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের এডিশনাল সেক্রেটারি মোজাম্মেল হক বলেন, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ দেখভাল করছে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়। এখানে সমস্যা হলো, রাস্তার নিচ দিয়ে অসংখ্য তার ও পাইপ লাইন রয়েছে। এসবের কারণে নির্মাণ কয়েক দফায় ব্যাহত হয়েছে। শেষে বাধ্য হয়ে ফ্লাইওভারের নকশাও পরিবর্তন করতে হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্মাণ কাজ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে বলে দাবি করেন তিনি।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন।
জেইউ/বিএ/এমএস