যাকাতুল ফিতর ফরজ


প্রকাশিত: ১০:০২ এএম, ২২ জুলাই ২০১৪

আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে ঈদুল ফিতর। ঈদ উৎসবে যাতে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারে, এ জন্য ফরজ করে দেওয়া হয়েছে যাকাতুল ফিতরকে। যাকাতুল ফিতর অর্থ- পবিত্রকরণ, দানশীলতা, যেটি রোজা ভেঙে ফেলার জন্য দেওয়া হয় এবং এই দান এমন একটি পরিমাণ, যা দরিদ্র মুসলিমদের খাদ্য হিসেবে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে আবু দাউদে উদ্ধৃত একটি হাদিস রয়েছে যেখানে বলা হচ্ছে, মুহম্মদ (সা.) প্রত্যেক মুসলমানের ওপর যাকাত ফরজ করেছেন। অপরদিকে ইবন ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, গোলাম, স্বাধীন, পুরুষ, নারী, ছোট, বড় সকল মুসলিমের ওপর রসূল (সা.) এক ‘সা’ তামার (খেজুর), অথবা এক ‘সা’ গম যাকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন এবং সালাতের পূর্বে তা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন।

বুখারির অপর বর্ণনায় আছে, নাফে (র.) বলেছেন, ইবন ওমর ছোট-বড় সবার পক্ষ থেকে তা আদায় করতেন, তিনি আমার সন্তানদের পক্ষ থেকে পর্যন্ত আদায় করতেন। যারা তা গ্রহণ করত, ইবন ওমর তাদের তা প্রদান করতেন, তিনি ঈদুল ফিতরের একদিন অথবা দুদিন আগে তা আদায় করতেন। আবু সায়িদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা যাকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক ‘সা’ বার্লি অথবা এক ‘সা’ গম অথবা এক ‘সা’ খেজুর অথবা এক ‘সা’ পনির অথবা এক ‘সা’ কিসমিস দ্বারা।

ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রোজাদারকে অশ্লীলতা থেকে পবিত্র করা ও মিসকিনদের খাদ্যের ব্যবস্থাস্বরূপ রসূল (সা.) যাকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন। সালাতের পূর্বে যে আদায় করল, তা গ্রহণযোগ্য যাকাত, যে তা সালাতের পর আদায় করল, তা সাধারণ সদকা। কায়স ইবন সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যাকাত ফরজ হওয়ার পূর্বে আমাদের রসূল (সা.) সদকাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। যখন যাকাত ফরজ হলো, তিনি আমাদের নির্দেশ দেননি, নিষেধও করেননি, তবে আমরা তা আদায় করতাম।

শিক্ষা ও মাসায়েল : এক. যাকাতুল ফিতর সকল মুসলিমের ওপর ফরজ, যা ফরজ হয়েছে যাকাতের পূর্বে। যাকাত ফরজের পর পূর্বের নির্দেশের কারণে তা এখনও ফরজ। দুই. প্রত্যেক মুসলিমের নিজ ও নিজের অধীনদের পক্ষ থেকে, যেমন স্ত্রী-সন্তান ও যাদের ভরণ-পোষণ তার ওপর ন্যস্ত, যাকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। তিন. স্ত্রী-সন্তান যদি কর্মজীবী অথবা সম্পদশালী হয়, তাহলে তাদের প্রত্যেকের নিজের পক্ষ থেকে যাকাতুল ফিতর আদায় করা উত্তম, কারণ তারা প্রত্যেকে যাকাতুল ফিতর প্রদানে আদিষ্ট। হ্যাঁ, যদি তাদের অভিভাবক তাদের পক্ষ থেকে আদায় করে, তাহলে জায়েজ আছে, যদিও তারা সম্পদশালী। চার. যাকাতুল ফিতরের মূল্য দেওয়া যথেষ্ট নয়, এটা জমহুর আলেমের অভিমত। কারণ নবী করীম (সা.) নির্দেশ দেননি, তিনি এরূপ করেননি, তার কোনো সাহাবি এরূপ করেননি, অথচ প্রতিবছর যাকাতুল ফিতর আসত। অধিকন্তু ফকিরকে খাদ্য দিলে সে নিজে ও তার পরিবার তার দ্বারা উপকৃত হয়, অর্থ প্রদানের বিপরীত, কারণ সে অর্থ জমা করে পরিবারকে বঞ্চিত করতে পারে। দ্বিতীয়ত মূল্য আদায়ের ফলে শরিয়তের এ বিধান তেমন আড়ম্বরতা পায় না। পাঁচ. যাকাতুল ফিতর আদায়ের প্রথম সময় আটাশে রমজান। সাহাবায়ে কেরাম ঈদের একদিন অথবা দুদিন পূর্বে তা আদায় করতেন। সর্বশেষ সময় ঈদের সালাত, যেমন হাদিসে এসেছে। ছয়. হকদার ফকির-মিসকিনদের এ যাকাত দিতে হবে, কারণ নবী করীম (সা.) বলেছেন, যাকাত মিসকিনদের খাদ্যস্বরূপ। প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের দেওয়া ভুল যদি তারা অভাবী না হয়, যেমন কতক লোক কুরবানি ও আকিকার গোশতের ন্যায় যাকাতুল ফিতর পরস্পর আদান-প্রদান করে, এটা সুন্নতের বিপরীত। কারণ, এটা যাকাত, হকদারকে দেওয়া ওয়াজিব, কোরবানি ও আকিকার গোশতের অনুরূপ নয়, যা হাদিয়া হিসেবে দেওয়া বৈধ। আরেকটি ভুল যে, কতক মুসলিম প্রতিবছর নির্দিষ্ট পরিবারকে যাকাতুল ফিতর আদায় করে, অথচ বর্তমান সে স্বচ্ছল হতে পারে, কিন্তু পূর্বের ন্যায় যাকাত দিতে থাকে, এটা ঠিক নয়। সাত. নিজ দেশের অভাবীদের যাকাতুল ফিতর দেওয়া উত্তম, তবে অন্য দেশে দেওয়া জায়েজ, বিশেষ করে যদি সেখানে অভাবের সংখ্যা বেশি থাকে, তাদের চেয়ে বেশি অভাবী নিজ দেশের কারো সম্পর্কে জানা না থাকে অথবা তার দেশের অভাবীদের দেওয়ার অন্য লোক থাকে। আট. যাকাতুল ফিতরের কতক বিধান ও উপকারিতা :

(১). বান্দার ওপর আল্লাহর নিয়ামত প্রকাশ করা হয়। যেমন তিনি পূর্ণমাস সিয়ামের তওফিক ও রমজান শেষে পানাহারের অনুমতি প্রদান করেছেন। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং ‎তিনি তোমাদের যে হিদায়েত দিয়েছেন, ‎তার জন্য খোদার বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং ‎যাতে তোমরা শোকর কর।
(২). এটা শরীরের যাকাত, যা আল্লাহ পূর্ণ বছর সুস্থ রেখেছেন।
(৩). যাকাতুল ফিতর বান্দার সিয়ামকে অশ্লীলতা থেকে পবিত্র করে। যেমন হাদিসে এসেছে, যাকাতুল ফিতর রোজাদারকে অশ্লীলতা থেকে পবিত্র করে।
(৪). যাকাতুল ফিতর দ্বারা ফকির-মিসকিনদের প্রতি অনুগ্রহ ও তাদের ভিক্ষা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়, যেন ঈদের দিন তারাও অন্যান্য মুসলিমের ন্যায় আনন্দ ও বিনোদন করতে পারে।
(৫). যাকাতুল ফিতর দ্বারা রোজাদারকে অনুগ্রহ ও অনুদানের প্রতি উৎসাহী করা হয় এবং তাকে লোভ ও কৃপণতা থেকে রক্ষা করা হয়।

নয়. এক মিসকিনকে এক পরিবার বা একাধিক ব্যক্তির সদকাতুল ফিতর দেওয়া বৈধ, যেমন বৈধ একজনের সদকাতুল ফিতর কয়েকজনকে ভাগ করে দেয়া। দশ. শেষ রমজানের সূর্যাস্তের ফলে সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয়, যদি কেউ তার পূর্বে মারা যায়, তার ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হবে না। কারণ সে ওয়াজিব হওয়ার আগে মারা গেছে। অনুরূপ কেউ যদি সূর্যাস্তের পর জন্মগ্রহণ করে, তার পক্ষ থেকে সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব নয়, তবে মোস্তাহাব। এগারো. কর্মচারী ও ভাড়াটে মজুরদের পক্ষ থেকে সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব নয়, তবে চুক্তির মধ্যে তাদের সাথে অনুরূপ শর্ত থাকলে আদায় করতে হবে। হ্যাঁ, অনুগ্রহ ও দয়া হিসেবে তাদের পক্ষ থেকে মালিকের আদায় করা বৈধ। বারো. যদি সদকাতুল ফিতর আদায় করতে ভুলে যায়, ঈদের পর ছাড়া স্মরণ না হয়, তাহলে সে তখন সদকা আদায় করবে, এতে সমস্যা নেই, কারণ ভুলের জন্য সে অপারগ। তেরো. যদি কাউকে সদকাতুল ফিতর ফকিরের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে ঈদের আগে তার নিকট তা পৌঁছে দেওয়া জরুরি। তবে যদি কোনো ফকির কাউকে সদকাতুল ফিতর তার জন্য সংরক্ষণ করে রাখার দায়িত্ব দেয়, তাহলে ঈদের পর পর্যন্ত তার নিকট তা সংরক্ষণ করা বৈধ।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।