রেলে ইঞ্জিন-কোচ সংকট, বন্ধ ৭৯ ট্রেন

• সারাদেশে বর্তমানে চলছে ২৭৫ ট্রেন, বন্ধ ৭৯
• ইঞ্জিন-কোচ-ক্রু সংকটে অধিকাংশ ট্রেন বন্ধ
• ৫১ শতাংশ ইঞ্জিনের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল পেরিয়েছে
বাংলাদেশের মতো অধিক জনসংখ্যার দেশে আরামদায়ক যানবাহন হিসেবে ট্রেন ব্যাপক জনপ্রিয়। ঈদ বা কোনো উৎসবে যাত্রী চাহিদার শীর্ষে থাকে এ বাহন। তবু, এত বছর পরও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি ট্রেনে। বিলাসবহুল কোচ কিংবা দ্রুতগতির ইলেকট্রিক ট্রেনও আমাদের বহরে যোগ হয়নি। সেই অর্থে বাড়েনি রুট। উল্টো ইঞ্জিন, কোচ, ক্রু সংকটে বর্তমানে বন্ধ ৭৯টি ট্রেন।
রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, যাত্রীসেবা দিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন তারা। তবে ইঞ্জিন কেনা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। বাজেট সংকুলান না হওয়ায় সংকট দূর করা যাচ্ছে না।
সমস্যার সমাধান হচ্ছে না কারণ রেলের ইঞ্জিন আমাদের দেশে উৎপাদন হয় না, বিদেশ থেকে আনতে হয়। আমরা আজ যদি অর্থের সংস্থান পাই তাহলে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে অর্ডার দিলে ইঞ্জিন পেতে মিনিমাম দুই থেকে তিন বছর সময় লাগে।-বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন
তবে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময়ের কাজ সব সময়ই অসময়ে করে রেল। ঢিলেঢালাভাবে কাজ আর গা-ছাড়া ভাবের কারণে প্রতিষ্ঠানটি আজও উন্নত হতে পারেনি। সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ না করায় জনগণ রেল থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না।
বর্তমানে চালু আছে ২৭৫টি ট্রেন
বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য বলছে, সারাদেশে মোট ১২০টি আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলে ৫৮টি এবং পশ্চিমাঞ্চলে ৬২টি। কমিউটার ও মেইল ট্রেন চলাচল করে ১২৮টি। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলে ৬০টি এবং পশ্চিমাঞ্চলে চলে ৬৮টি। এছাড়া সারাদেশে আটটি কনটেইনার ট্রেন এবং ১৯টি গুডস ট্রেন চলাচল করে। সব মিলিয়ে বর্তমানে চালু আছে ২৭৫টি ট্রেন।
রেলের সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেই। প্রতিষ্ঠানটির প্রস্তুতি বা ক্যাপাসিটি নেই। রেলইঞ্জিন কেনায় দীর্ঘ মেয়াদের কথা বলে, কিন্তু তাদের তো মাস্টারপ্ল্যান আছে। এটি দুই দফায় করা হয়েছে। সেখানে বলা আছে দক্ষ জনবল নিয়োগের কথা। আসলে রেল সময়ের কাজ সময়ে কখনো করেনি।–যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ মো. হাদিউজ্জামান
বন্ধ থাকা ট্রেনের হিসাবে দেখা যায়, লোকাল ও ডেমু ট্রেন মিলিয়ে পূর্বাঞ্চলে ৩৬টি এবং লোকাল ও মিশ্র মিলিয়ে ৩৭টি ট্রেন বন্ধ আছে। আর গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে চলাচলকারী বন্ধন, মিতালি এবং মৈত্রী- এই তিন জোড়া অর্থাৎ ছয়টি ট্রেন চলাচল বন্ধ আছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে চলছে না ৭৯টি ট্রেন।
অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল পেরিয়েছে ৫১ শতাংশ ইঞ্জিনের
বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য বলছে, বর্তমানে রেলের বহরে মোট ইঞ্জিন রয়েছে ২৯৭টি। এর মধ্যে মিটারগেজ ইঞ্জিন ১৬৭টি ও ব্রডগেজ ইঞ্জিন ১৩০টি। রেলট্র্যাকে যুক্ত হওয়ার পর একটি ইঞ্জিনের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ধরা হয় ২০ বছর।
- আরও পড়ুন
- ৩৬ কোটি টাকা খরচের হিসাব দিতে পারছে না রেলওয়ে
- ইলেকট্রিক ট্রেন চালু করতে সমীক্ষায় পার ৫ বছর
- পরিবেশবান্ধব হবে রেলপথ, চাপ কমবে সড়কে
অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল রয়েছে রেলওয়েতে এমন ইঞ্জিনের সংখ্যা ১৪৭টি। বাকি ১৫০টি ইঞ্জিনের মধ্যে ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী ৫০টি ও ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী রয়েছে ১৬টি। অবশিষ্ট ৮৪টি ইঞ্জিনের বয়স ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে বর্তমান রেলওয়ের বহরে থাকা ইঞ্জিনগুলোর মধ্যে ৫১ শতাংশের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল পেরিয়েছে।
যেসব রুটের ট্রেন বন্ধ
বাংলাদেশ রেলওয়ে থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, পূর্বাঞ্চলে বন্ধ থাকা ময়মনসিংহ-দেওয়ানগঞ্জ বাজার-ময়মনসিংহ রুটে চলাচলকারী লোকাল ২৫১/২৫২ ট্রেন, ময়মনসিংহ-ভৈরব বাজার-ময়মনসিংহ রুটের লোকাল ২৪১/২৪২, ৩৪৫/৩৪৬ ট্রেন, সিলেট-ছাতকবাজার-সিলেট রুটের লোকাল ৩৪১/৩৪২ এবং ৩৪৫/৩৪৬ ট্রেন ২০২০ সালের ২৪ মার্চ, চট্টগ্রাম-সিলেট-চট্টগ্রাম রুটের জালালাবাগ এক্সপ্রেস ১৩/১৪ ট্রেন ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর, ঢাকা-ময়মনসিংহ-ঢাকা রুটের ঈশা খাঁ এক্সপ্রেস ৩৯/৪০ ট্রেন ২০২০ সালের ১২ মার্চ, চট্টগ্রাম-দোহাজারী-চট্টগ্রাম রুটের দোহাজারী কমিউটার ১/৬ ট্রেন ২০২৩ সালের ১ আগস্ট, আখাউড়া-সিলেট-আখাউড়া রুটের কুশিয়ারা এক্সপ্রেস ১৭/১৮ এক্সপ্রেস ২০২০ সালের ৩ মার্চ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এসব ট্রেন ইঞ্জিন, ক্রু ও কোচ সংকটে বন্ধ হয়ে যায়।
এছাড়া চট্টগ্রাম-নাজিরহাট-চট্টগ্রাম রুটের নাজিরহাট কমিউটার ১/৬ ট্রেন ২০২৩ সালের ৮ ডিসেম্বর, চট্টগ্রাম-চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়-চট্টগ্রাম রুটের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কমিউটার ১/২/৩/৪ ট্রেন, লাকসাম-চাঁদপুর-লাকসাম রুটের চাঁদপুর কমিউটার ৮১/৮২ ট্রেন, লাকসাম-নোয়াখালী-লাকসাম রুটের নোয়াখালী কমিউটার ৮৫/৮৮ ট্রেন ২০২০ সালের ২৪ মার্চ, ঢাকা-হাইটেক সিটি-ঢাকা রুটের কালিয়াকৈর কমিউটার ১/২ ট্রেন ২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি, নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের নারায়ণগঞ্জ কমিউটার ১/২/৩/৪ ট্রেন ২০২২ সালের ২৯ মার্চ, চট্টগ্রাম-পটিয়া-চট্টগ্রাম রুটের পটিয়া কমিউটার ১/২ ট্রেন ২০২৩ সালের ৮ ডিসেম্বর বন্ধ হয়ে যায়। এসব ট্রেন বন্ধ হাওয়ার কারণ হিসেবে ‘এমসি আন্ডার রিপেয়ার’ থাকার কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া পূর্বাঞ্চলের ঢাকা-যমুনা সেতু পূর্ব-ঢাকা রুটে টাঙ্গাইল কমিউটার ১০৭/১০৮ ট্রেন ২০২৪ সালের ৪ মে, ময়মনসিংহ ভুয়াপুর-ময়মনসিংহ রুটের ধলেশ্বরী কমিউটার ৭৫/৭৬ ট্রেন ২০২৪ সালের ২৮ মে বন্ধ হয়ে যায়। এই দুটি ট্রেন বন্ধ হওয়ার কারণ হিসেবে ইঞ্জিন স্বল্পতার কথা বলা হয়েছে।
পশ্চিমাঞ্চলের বন্ধ থাকা ট্রেনের কারণ বিশ্লেষণে দেখা যায়, গোয়ালন্দঘাট-রাজবাড়ি রুটের লোকাল ৫১৫, রাজবাড়ী-ঈশ্বরদী রুটের লোকাল ৫১১, ঈশ্বরদী-পার্বতীপুর রুটের লোকাল ৫৪১, পার্বতীপুর-চিলাহাটি রুটের লোকাল ৫৯১, চিলাহাটি-পার্বতীপুর রুটের লোকাল ৫৯২, পার্বতীপুর-ঈশ্বরদী রুটের লোকাল ৫৪২, ঈশ্বরদী-রাজবাড়ী রুটের লোকাল ৫১২ ট্রেন ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর, লালমনিরহাট-বুড়িমারী-লালমনিরহাট রুটের মিশ্র ৪৫১/৪৫২ ট্রেন ২০০৬ সালের ১২ মে, পার্বতীপুর-বী.মু.সি.ই.-পার্বতীপুর রুটের মিশ্র ৪১৩/৪১৪ ট্রেন এবং লালমনিরহাট-পার্বতীপুর-লালমনিরহাট রুটের মিশ্র ৪১৩/৪১৪ ট্রেন ২০০৯ সালের ১ ডিসেম্বর, লালমনিরহাট-পার্বতীপুর-লালমনিরহাট রুটের লোকাল ৪১১/৪১২ ট্রেন এবং লালমনিরহাট-বুড়িমারী-লালমনিরহাট রুটের লোকাল ৪৫৩/৪৫৪ ট্রেন ২০১০ সালের ১৬ মার্চ, পার্বতীপুর-বী.মু.সি.ই.-পার্বতীপুর রুটের লোকাল ৪৩১/৪৩৪ ট্রেন ২০১১ সালের ১৫ মার্চ বন্ধ হয়ে যায়। এসব ট্রেন বন্ধের কারণ হিসেবে কোচ, ইঞ্জিন ও ক্রু সংকটের কথা বলেছে রেলওয়ে।
পার্বতীপুর-লালমনিরহাট-পার্বতীপুর রুটের পার্বতীপুর কমিউটার ৬৯/৭০ ট্রেন ২০১১ সালের ১ জুলাই, লালমনিরহাট-সান্তাহার-লালমনিরহাট রুটের লোকাল ৪৮১/৪৮২ ট্রেন ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বন্ধ হয়ে যায়। এই দুটি ট্রেন বন্ধের কারণ হিসেবে ক্রুর অভাবের কথা বলা হয়েছে।
সান্তাহার-বী.মু.সি.ই.-সান্তাহার রুটের উত্তরবঙ্গ মেইল ৭/৮ ট্রেন ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট বন্ধ হয়ে যায়। এটি বন্ধের পেছনে ইঞ্জিন ও ক্রু সংকটের কথা বলা হয়েছে।
লালমনিরহাট-পার্বতীপুর-লালমনিরহাট রুটের রংপুর কমিউটার ১/২ (ডেমু) ট্রেনটি ২০২৩ সালের ১৮ জুন, পার্বতীপুর-বী.মু.সি.ই.-পার্বতীপুর রুটের পঞ্চগড় কমিউটার ১/২ (ডেমু) ২০২০ সালের ২৪ মার্চ বন্ধ হয়ে যায়। এই দুটি ট্রেন বন্ধের কারণ হিসেবে আন্ডার রিপেয়ার থাকার কথা বলা হয়।
এছাড়া রাজবাড়ী-ভাঙ্গা-ঢাকা-ভাঙ্গা-রাজবাড়ী রুটের ১২১/১২৪, ১২৩/১২২ চন্দনা/ভাঙ্গা কমিউটার ট্রেন ২০২৪ সালের ১৩ আগস্ট যাত্রীখাতে বয়স কম হওয়ার কারণে এবং ঈশ্বরদী-রাজশাহী-ঈশ্বরদী (আংশিক) রুটের লোকাল ৫৬৩/৫৬৪ ট্রেন ২০২৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর নাশকতা এড়াতে ঈশ্বরদী-রাজশাহী-ঈশ্বরদী অংশে চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে আর সেটি চালু হয়নি।
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সমস্যার সমাধান হচ্ছে না কারণ রেলের ইঞ্জিন আমাদের দেশে উৎপাদন হয় না, বিদেশ থেকে আনতে হয়। আমরা আজ যদি অর্থের সংস্থান পাই তাহলে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে অর্ডার দিলে ইঞ্জিন পেতে মিনিমাম দুই থেকে তিন বছর সময় লাগে।’
‘অর্থের সংস্থান পেতেও সময় লাগে, কারণ এটা রাজস্ব বাজেটের আওতায় হয় না, প্রকল্পের সাহায্য লাগে। ডেভেলপমেন্ট পার্টনার বা দাতা সংস্থার অর্থায়নের প্রয়োজন আছে। এটা এমন নয় যে টাকা দিলাম আর বাজারে গিয়ে ইঞ্জিন কিনে নিয়ে আসলাম।’
তিনি বলেন, ‘মিটারগেজ ও ব্রডগেজ মিলে আমাদের এখন ৯০টির মতো ইঞ্জিন প্রয়োজন। নতুন ইঞ্জিন কেনার জন্য আমাদের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। প্রথম ধাপে এডিবির অর্থায়নে মিটারগেজের জন্য ৩০টি ইঞ্জিন কেনার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।’
এ প্রকল্পের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাত্র প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। কিন্তু অর্থায়নের জন্য এডিবি এখনো এগ্রিমেন্টে সাইন করেনি। এগ্রিমেন্ট সাইনের পরে আমরা টেন্ডার প্রক্রিয়ায় যাবো।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক ও অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘রেলের সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেই। প্রতিষ্ঠানটির প্রস্তুতি বা ক্যাপাসিটি নেই। রেলইঞ্জিন কেনায় দীর্ঘ মেয়াদের কথা বলে, কিন্তু তাদের তো মাস্টারপ্ল্যান আছে। এটি দুই দফায় করা হয়েছে। সেখানে বলা আছে দক্ষ জনবল নিয়োগের কথা। আর সময়মতো ইঞ্জিন-লোকোমোটিভ কেনার কথা আছে। আসলে রেল সময়ের কাজ সময়ে কখনো করেনি। এভাবে চলতে থাকলে রেল আরও ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।’
এই যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘রেললাইন সম্প্রসারণের কাজ নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু এর সঙ্গে ইঞ্জিন, ওয়াগন, কোচ, দক্ষ জনবল প্রয়োজন। রেল তো অনুভবই করে না তাদের দক্ষ জনবল লাগবে। এজন্য আউটসোর্সিংয়ের লোক দিয়ে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানো হচ্ছে।’
এনএস/এএসএ/জিকেএস