বিদেশ যেতে এজেন্সির প্রতারণায় নিঃস্ব, প্রতিকারের কেউ নেই

কাজের উদ্দেশে গত বছরের ৬ জুন আলজেরিয়ায় যান ৪৩ জন শ্রমিক। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড ভিশন নামের একটি রিক্রুটিং এজেন্সি তাদের সেখানে পাঠায়। প্রতারণার শিকার হয়ে সাড়ে সাত মাসের ভোগান্তি শেষে শূন্য হাতে এসব শ্রমিক ২০২৫ সালের ২১ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন। ২২ জানুয়ারি তারা প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে গিয়ে অভিযোগ করেন।
অভিযোগকারী ভুক্তভোগী আসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভার্চুয়াল এজেন্সি আমাদের বলেছে দুই বছরের ভিসা করে দেবে। সে অনুযায়ী চুক্তিও ছিল। প্রতারণার ফাঁদে ফেলে আট মাস আমাদের সেখানে রেখেছে। যে কয়েক মাস কাজ করেছি টাকাও পাইনি। সেখানে মানবেতর জীবনযাপন করে পরবর্তীসময়ে আইওএমের মাধ্যমে দেশে আসি।’
তিনি বলেন, আমরা অভিযোগ দিয়েছি প্রায় দুই মাস হয়ে গেছে। আমরা নিঃস্ব। এখনো কোনো ক্ষতিপূরণ পাইনি। মন্ত্রণালয় থেকে বারবার আমাদের ডেট দিচ্ছে। কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি।
সারাদেশে বিদেশফেরত কিংবা বিদেশগামীদের এমন অহরহ অভিযোগ প্রতিনিয়ত জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) কর্মসংস্থান (অভিযোগ সেল) শাখায় জমা হয়।
কর্মসংস্থান শাখা সূত্রে জানা গেছে, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৭ হাজার ৩৩৭টি অভিযোগের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৪ হাজার ১৬৬টি। অনিষ্পন্ন বা তদন্ত হয়নি এমন অভিযোগের সংখ্যা ৩ হাজার ১৭১টি।
- আরও পড়ুন
যুক্তরাজ্যে আধুনিক দাসত্বের শিকার রেকর্ড সংখ্যক মানুষ
মালয়েশিয়ায় চালু হচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য স্পেশাল পাস
সূত্রে আরও জানা গেছে, সর্বশেষ ২০২৪ সালে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ জমা হয়েছে সৌদি প্রবাসীদের কাছ থেকে, ৬৭০টি। মালয়েশিয়া প্রবাসীদের ৫৭১টি, দুবাই প্রবাসীদের ৪৯টি, কিরগিজস্তানের ৪৮টি, রোমানিয়ার ২৯টি, ওমানের ২৫টি, লিবিয়ার ১৬টি, কাতারের ১৩টি, ইতালির ৭টি ও কুয়েতের অভিবাসন সংক্রান্ত অভিযোগ চারটি।
অভিবাসন বিশ্লেষকরা বলছেন, কর্মীদের অভিযোগ গুরুত্ব না দিলে সমস্যা বেড়েই যাবে। প্রতারণার ঘটনায় তদন্ত যথাযথভাবে না হওয়ায় অনেক সময় অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। ফলে দালালচক্র ও অসাধু নিয়োগ সংস্থাগুলোর দৌরাত্ম্য বাড়ছে, আর ভুক্তভোগীদের দুর্ভোগ পৌঁছাচ্ছে চরমে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, প্রবাসীদের অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য একটা সেপারেট সিস্টেম করতে হবে। এখন যে অবস্থায় আছে, বিএমইটি প্রায় সময় রিক্রুটিং এজেন্সিদের স্বার্থটা বেশি দেখে। আইনের যে অধিকার, তা বাস্তবায়ন করতে হলে ইনস্টিটিউটে পরিণত করতে হবে। যাতে এটা নিরপেক্ষ তদন্ত হয়। ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়।
‘আমাদের কিছু গবেষণায় দেখেছি, প্রতারণার অভিযোগগুলো প্রমাণিত হলে নারীদের ক্ষেত্রে নামমাত্র ৩০-৪০ হাজার টাকা দিয়ে সমাধান করে ফেলা হয়। পুরুষদের ক্ষেত্রে ৫০-৬০ হাজার টাকা দেয়। এগুলো আসলে ক্ষতিপূরণ হয় না। ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা দিয়ে যারা বিদেশ যায়, প্রতারিত হলে সে পরিমাণ টাকা তারা ফেরত পায় না। এখানে একটা সিস্টেম দেখানো হচ্ছে যে প্রবাসীদের অভিযোগ নেওয়া হচ্ছে! এতটুকুই’, যোগ করেন শাকিরুল ইসলাম।
বিদেশ যাওয়ার আগেই প্রতারণার শিকার
সম্প্রতি ইউরোপের দেশ হাঙ্গেরি নেওয়ার কথা বলে সাড়ে ৩ লাখ করে টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে গ্লোবাল ঢাকা নামের একটি এজেন্সির বিরুদ্ধে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি বিএমইটিতে এ নিয়ে অভিযোগ জমা দেন তিন ভুক্তভোগী শফিক, নুরুজ্জামান ও শাইফুল।
জাগো নিউজকে তারা বলেন, গ্লোবাল ঢাকা নামক এই এজেন্সি হাঙ্গেরিতে ওয়ার্ক পারমিট ভিসায় আমাদের নেবে বলে ৩ লাখ ৫০ হাজার করে টাকা নেয়। এরপর এজেন্সির মালিক উধাও হয়ে যায়। এখন আমাদের নেওয়ার কোনো প্রসেসিং নেই, আমাদের টাকা ফেরতও দিচ্ছে না। তারা আরও অনেকের কাছ থেকে হাঙ্গেরি নেবে বলে টাকা নিয়েছে।
- আরও পড়ুন
দুই মাসে ৯০০ যাত্রীকে বিমানবন্দর থেকে ফেরত দিয়েছে মালয়েশিয়া
শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে শিক্ষা কারিকুলাম পুনর্বিবেচনার তাগিদ
তারা বলেন, আমরা ওই এজেন্সির রনি নামের এক স্টাফের মাধ্যমে টাকা দেই। এখন গত কয়েক মাস ধরে ঘোরাঘুরি করেও আমাদের টাকা ফেরত পাচ্ছি না।
পরবর্তীসময়ে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে গ্লোবাল ঢাকা এজেন্সির স্টাফ রনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি ওই এজেন্সিতে এখন চাকরি করি না। আমি যখন কর্মরত ছিলাম, ভুক্তভোগীরা এসে অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে টাকা দিয়েছে। আমি সঙ্গে ছিলাম এতটুকুই। আমি কোনো এজেন্টও না, দালালও না। আমি শুধু সেখানে জব করেছি, আমার দায়িত্ব পালন করেছি। আমি ভুক্তভোগীদের থানায় মামলাও করতে বলছি। এজেন্সিতে গিয়ে অভিযোগ দিতে বলেছি। এখানে আমি কিছু না। আমি সর্বশেষ যতটুকু জানি, যাদের পাওনা ছিল সবার টাকা এজেন্সি মালিক দেবে।’
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি রিসার্চ মুভমেন্ট, রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন তাসনিম সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, প্রবাসীদের অভিযোগের সংখ্যা বাস্তবে আরও বেশি হবে। কারণ সরাসরি বিএমইটিতে এসে সবাই অভিযোগ দিতে পারে না। আমাদের একটা অনলাইন সিস্টেম ছিল, সেটি এখন আর নেই। তখন ওই অনলাইনের মাধ্যমে বিএমইটিতে অনেক অভিযোগ জমা দেওয়ার সুযোগ থাকায় অনেক বেশি অভিযোগ আসত। এছাড়া দেশে প্রবাসীদের জন্য কার্যকর কোনো লিগ্যাল সেল না থাকায় তারা সহজে আইনি সহায়তাও পান না।
প্রবাসীদের অভিযোগ তদন্তের জন্য নেই লিগ্যাল সেল
বিএমইটি সূত্রে জানা গেছে, কর্মসংস্থান শাখা তথা অভিযোগ সেলে কোনো আইনজীবী নেই। নেই কোনো লিগ্যাল সেল। কর্মসংস্থান শাখার সহকারী পরিচালক ও উপ-পরিচালকরা অভিযোগগুলোর তদন্ত করেন।
রামরুর চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, প্রবাসীদের অভিযোগ নিয়ে যারা তদন্ত করে, কাজ করে, তাদের কারওই লিগ্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। তদন্ত কিংবা বিচারিক কাজে তাদের অভিজ্ঞতাও নেই। অভিযোগগুলো তদন্ত করতে হলে অবশ্যই আইনজীবী লাগবে। তারা বসে মিটমাট করলে হবে না। লিগ্যাল সেল খুবই জরুরি এবং ডিস্ট্রিক্ট পর্যন্ত এটা বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।
যা বলছেন অভিযোগ তদন্তকারীরা
প্রবাসীদের অভিযোগগুলো তদন্ত করেন কর্মসংস্থান শাখার কর্মকর্তারা। তাদের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, আমরা সব সময় চেষ্টা করি একটা গ্রহণযোগ্য সমাধানের জন্য। উভয় পক্ষের কিছু দোষত্রুটি থাকে। ডিবেট থাকে। আসলে দালালদের দৌরাত্ম্য অনেক বেশি। বিদেশ যারা যায় বা যেতে ইচ্ছুক, তারা যখন টাকা দেয় বা তাদের সঙ্গে চুক্তি ও যাবতীয় কাজ খুব সতর্কতার সঙ্গে করে। সালিশে বিষয়গুলো উঠলে মাঝে মাঝে ভুক্তভোগীরা প্রমাণ করতে সক্ষম হয় না।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অভিযোগ ব্যবস্থাপনা সেলের সহকারী পরিচালক মো. এনামুল হক জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের অনেক সংকট, সমস্যা আছে। লোকবল কম। কিন্তু লিগ্যাল সেল কেন নেই, বা আইনজীবী নিয়োগ হবে কি না সেসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কথা বলবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অভিযোগ ব্যবস্থাপনা সেলের আরেক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, বেশিরভাগ অভিযোগ সৌদি ও গত বছর বন্ধ হয়ে যাওয়া মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে। অভিযোগগুলো তদন্ত করলে শুধু যে এজেন্সির দোষ, বিষয়টি এমন নয়। ভুক্তভোগীদেরও দোষ থাকে। তাদের অসচেতনতা ও যথেষ্ট জ্ঞানের অভাব অনেকটা দায়ী।
ক্লিয়ারেন্স দেওয়ার সময় আমরা অনেককে বলি, ভিসার চুক্তি ও কাজের ব্যাপারে নিশ্চয়তা নেই। তারা কিন্তু সেগুলো যাচাই-বাছাই না করে আত্মীয়স্বজন সেখানে আছে এমন ভরসায় চলে যায়। পরর্বতীসময়ে প্রতারিত হয়।
সার্বিক বিষয়ে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর কর্মসংস্থান শাখার পরিচালক মামুন সরদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছি, কিছুদিন পর ভালো রেজাল্ট আসবে। প্রতি মাসে প্রায় লাখের মতো শ্রমিক যাচ্ছে, সে অনুযায়ী আমি মনে করি অভিযোগ কিন্তু কম। সামনে আমাদের অনলাইন সিস্টেম খোলা হবে সেখানেও অভিযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে।’
‘এখন সমস্যা দুদিকে। অভিযোগ আসার পর তদন্ত কর্মকর্তার রিপোর্টে দেখা যায়, ভুক্তভোগীরা অনেক প্রমাণ রাখতে পারে না। তখন আসলে তাদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক জটিলতা সৃষ্টি হয়। আর আমাদের এখানে অভিযোগ নিষ্পত্তি হলে অভিযুক্তরা ক্ষতিপূরণ না দিলে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেই প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।’
তিনি বলেন, অভিযোগ সেলের জন্য আইনজীবী নিয়োগ হবে কি না সেটা পলিসি লেভেলের সিদ্ধান্ত। সেটা এখন বলা যাচ্ছে না।
আরএএস/এমএইচআর/জেআইএম