সরকারি সুবিধা পায় না গেজেটভুক্ত ১৩৯৯ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার

মাসুদ রানা
মাসুদ রানা মাসুদ রানা , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:২৯ এএম, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
ভাতাবঞ্চিত এসব শহীদ মুক্তিযোদ্ধার খোঁজ রাখেনি কেউ/জাগো নিউজ গ্রাফিক্স

সরকারি সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার বাইরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ গেজেটভুক্ত এক হাজার ৩৯৯ জন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবার। গেজেট জারির ২০ বছর পার হলেও এসব শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ আবেদন করেনি। সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো খোঁজ নেওয়া হয়নি। যোগাযোগ করা হয়নি পরিবারের সঙ্গে।

দীর্ঘদিন পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পরিবারগুলো চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম-ঠিকানাসহ তালিকা জেলা প্রশাসকদের কাছে পাঠানো হয়েছে। শহীদ পরিবারগুলোকে চিহ্নিত করা হলে সরকারের উদ্যোগেই তাদের সব সুযোগ নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে ‘শহীদ, খেতাবপ্রাপ্ত ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্মানি ভাতা বিতরণ আদেশ, ২০২১’ অনুযায়ী শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে সুবিধা দেওয়া হয়। ২০০৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিন দফায় গেজেটে ৬ হাজার ৭৫৭ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রকাশ করা হয়। কিন্তু এর মধ্যে ৫ হাজার ৩৫৮ জনের পরিবার আবেদন করে ভাতা নিচ্ছে। অবশিষ্ট এক হাজার ৩৯৯ জন কোনো ভাতা নেন না।

শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সদস্যদের মাসিক ৩০ হাজার টাকা হারে সম্মানি ভাতা এবং বছরে ২৩ হাজার টাকা হারে দুটি উৎসব ভাতা, দুই হাজার টাকা নববর্ষ ভাতাসহ আরও কিছু আর্থিক সুবিধা দেওয়া হয় বলে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে জানা যায়।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আমি বললাম রাষ্ট্র কী কোনোদিন জানতে চেয়েছে তারা কারা? তারাই রাষ্ট্র এনেছে। যারা রাষ্ট্র এনেছে তারা কৃষক, তারা শ্রমিক, তারা এত চালাক-চতুর লোক না, এরা বোকা লোক। তারা এসব বোঝে না, তারা গেজেট বোঝে না। তালিকা বোঝে না।- মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম

এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম জাগো নিউজকে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সদস্যরা ভাতা পান। বেসামরিক শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট হয় প্রথমে ২০০৩ সালের ৬ অক্টোবর। সামরিক শহীদদের গেজেট হয় ২০০৪ সালের ১২ এপ্রিল। পুলিশ ও বিডিআরের (বর্তমান বিজিবি) শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট হয় ২০০৫ সালের ১৫ জুন। শহীদদের তালিকায় মোট নাম এসেছে ৬ হাজার ৭৫৭ জনের।’

সরকারি সুবিধা পায় না গেজেটভুক্ত ১৩৯৯ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার

তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার ৩০ বছরেরও বেশি সময় পর শহীদদের তালিকা হয়েছে। সেখানে ৬ হাজার ৭৫৭ জন, কিন্তু উনি (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) বলেছেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ৩০ লাখ।’

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

উপদেষ্টা বলেন, ‘গেজেটভুক্তদের মধ্যে ৫ হাজার ৩৫৮ জন ভাতা পাচ্ছেন। অবশিষ্ট এক হাজার ৩৯৯ জন কোনো ভাতা পাচ্ছেন না। কেন তারা ভাতা পাচ্ছেন না- জানতে চাইলে অফিসাররা বলেন, স্যার এদের পরিবার কখনো আবেদন করেনি।’

‘আমি বললাম রাষ্ট্র কী কোনোদিন জানতে চেয়েছে তারা কারা? তারাই রাষ্ট্র এনেছে। যারা রাষ্ট্র এনেছে তারা কৃষক, তারা শ্রমিক, তারা এত চালাক-চতুর লোক না, এরা বোকা লোক। তারা এসব বোঝে না, তারা গেজেট বোঝে না। তালিকা বোঝে না।’

তিনি বলেন, ‘যিনি শহীদ হয়েছেন তার স্ত্রী হয়তো গৃহবধূ ছিলেন, সে তো গেজেট বোঝে না। রাষ্ট্র কেন তার কাছে গেলো না?’

বিজ্ঞাপন

ফারুক ই আজম বলেন, ‘আমি ডিসি সম্মেলনে ডিসিদের নির্দেশ দিয়েছি, কল্যাণ ট্রাস্টও সেখানে (পরিবারের খোঁজে) যাবে। সব ডিসিদের বলা হয়েছে, যারা ভাতা নিচ্ছেন না, এমন শহীদদের তালিকাও তাদের দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকের ঘরে ঘরে যেতে হবে। গিয়ে আমাকে আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে জানাতে হবে যে এ শহীদদের অ্যাড্রেস করা হয়েছে। তাদের কেউ আছে, কী নেই।’

শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এক হাজার ৩৯৯ জনের পরিবার ভাতা নিচ্ছে না। তারা আবেদন করেননি। এতদিন এ বিষয়টি কেউ সেভাবে ভাবেনি। তবে তাদের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। তবে আগে যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা কেউ তা করেননি।- মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ইসমাইল হোসেন

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট নিয়েছি, তাদের আলাদা করেছি। জেলার ভিত্তিতে আলাদা করেছি এবং জেলা প্রশাসকদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।’

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাদের পরিবার রাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনো সম্মান ও সুবিধা নেয়নি কিংবা পাচ্ছে না জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘এত বছরে কেউ কী এটার খোঁজ নেয়নি- জিজ্ঞাসা করলে কর্মকর্তারা বলেন, না কেউ জিজ্ঞাসাও করেনি। যারা কল্যাণ ট্রাস্টে ছিল তাদের কোনো দায়বদ্ধতা ছিল না। মন্ত্রণালয়ের তো ছিলই না। আমি কৌতূহল থেকে এ বিষয়টি দেখতে গিয়ে এটি পেয়েছি।’

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ইসমাইল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা তিন ক্যাটাগরিতে (শহীদ, খেতাবপ্রাপ্ত ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা) ১৮ হাজার ২০০ জন বা তাদের পরিবারকে ভাতা দেই। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এক হাজার ৩৯৯ জনের পরিবার ভাতা নিচ্ছে না। তারা আবেদন করেননি। এতদিন এ বিষয়টি কেউ সেভাবে ভাবেনি। তবে তাদের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। তবে আগে যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা কেউ তা করেননি।’

তিনি বলেন, ‘এখন উপদেষ্টা মহোদয় এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছেন। আমরা ডিসিদের দায়িত্ব দিয়েছি। তাদের লিখিত ও মৌখিক দুই ভাবেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তারা যাতে দ্রুত এ কাজটি করেন। তারা পরিবারগুলোকে চিহ্নিত করতে পারলে তাদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের কাজটি আমরাই করে দেবো।’

অধ্যাদেশ চূড়ান্ত হলে শুরু হবে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শনাক্তের কাজ

বিভিন্ন জেলা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে শত শত অভিযোগ এসেছে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘জামুকা (জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল) আইন সংশোধন করে নতুন অধ্যাদেশ হয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ পুনর্গঠন করতে পারবো। সেখানে আমরা একটা অ্যাডহক কমিটি করে দেবো। এরপর জামুকা, অ্যাডহক কমিটি, প্রশাসন যৌথভাবে যে অভিযোগগুলো এসেছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করবে।’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘আমরা আগে বলেছিলাম যেসব অমুক্তিযোদ্ধা স্বেচ্ছায় মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে চলে যাবেন তাদের ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) দেবো, তাদের শাস্তির আওতায় আনবো না। সেই সুবাদে ১০-১২ জনের মতো পেয়েছি, যারা স্বেচ্ছায় চলে যেতে আবেদন করেছেন। তারা জাতি ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন যে, তারা এটা অন্যায় করেছিলেন। তাদের যাতে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তাদের ভাতা বন্ধ করে দিয়েছি।’

সরকারি সুবিধা পায় না গেজেটভুক্ত ১৩৯৯ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার

‘ইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠনগুলো থেকে একটি দাবি জানানো হয়েছে, স্বেচ্ছায় চলে যেতে সরকার যাতে সময় নির্ধারণ করে দেয়। তারা বলেন, আগামী ২৬ মার্চ পর্যন্ত যাতে সময় বেঁধে দেওয়া হয়। আমরা তাদের এ দাবি বিবেচনা করছি।’

বিজ্ঞাপন

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সৃষ্টিকারীদেরও বিচার হবে

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, ‘যাদের ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করা হবে, তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। এটা পুরো জাতির সঙ্গে প্রতারণা। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় যারা ছিল, তদন্তের মাধ্যমে তাদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা হবে।’

আওয়ামী লীগ সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে- এ বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘হ্যাঁ, এ ব্যাপারে একটা অভিযোগ জামুকায়ও জমা পড়েছে। আগামী সভায় আমরা এটা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিচেনায় নেবো, আলোচনা করবো।’

সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রায় ৯০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা সেখানে যাচাই-বাছাই করবো। কারও কোনো আপত্তি থাকলে তা আমাদের জানাতে পারবেন। আমরা সেটা দেখবো।’

মুক্তিযোদ্ধাদের মামলা নিষ্পত্তিতে আলাদা বেঞ্চ চাওয়া হবে

মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন বিষয়ে দুই হাজার ৭০০টির মতো মামলা রয়েছে জানিয়ে উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেন, ‘এ মামলাগুলো একটা ডেডিকেটেড বেঞ্চে শেষ করার জন্য প্রধান বিচারপতির সাক্ষাৎ চেয়েছি। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে একটা আলাদা বেঞ্চ চাইবো, যাতে সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের মামলা অগ্রাধিকারভিত্তিতে আমরা শেষ করতে পারি।’

ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকে বিপুল অর্থ

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের বিপুল অর্থ আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে থাকা কয়েকটি ব্যাংকে রয়েছে। মনে করা হচ্ছে, বিশেষ সুবিধার বিনিময়ে গত কয়েক বছরে এ অর্থ ওইসব ব্যাংকে জমা করা হয়েছে। এসব অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। ট্রাস্টের তহবিলের বড় অংশটি রয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে।

এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের বড় ফান্ড আছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সব টাকা নিয়ে রেখেছে বেসরকারি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে। যে ব্যাংক ১০ কোটি ফেরত দিতে পারে না, সেখানে কল্যাণ ট্রাস্ট ১৬৭ কোটি টাকা জমা রেখেছে। এ টাকা কবে ফেরত পাবে আল্লাহই জানেন।’

তিনি বলেন, ‘কেউ না কেউ তো এ ধরনের ব্যাংকে টাকা রেখে সুবিধা নিয়েছেন। এ বিষয়গুলো আমরা দেখছি।’

আরএমএম/এএসএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।