‘রাষ্ট্র দেখভাল করে না, কোনো সরকারই করেনি’

ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক। রাষ্ট্রের জন্য প্রস্তুত ছিলেন নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে যারা সক্রিয় ছিলেন তাদের অন্যতম তিনি। চিকিৎসক হয়েও যার চলার পথ ছিল অন্য রেখায়। মনোনিবেশ করেছিলেন সাহিত্যচর্চায়। গুণী এই মানুষ ৯৫ বছর বয়সে এসে ভুগছেন অর্থাভাবে। দায়িত্ব নেয়নি কোনো সরকার। চিকিৎসা করাতেও বর্তমানে প্রায় অপারগ।
জীবন সায়াহ্নে এসে আক্ষেপ প্রকাশ করলেন সব সরকারের ওপর। নিজের বাড়ি বিক্রি করে দান করে দিয়েছিলেন সামান্য টাকা নিজের জন্য রেখে। শমরিতা হাসপাতাল চিকিৎসার দেখভাল করবে বলেও করেনি জানিয়ে ক্ষোভ ঝাড়লেন।
চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, এ (পরিচারক মো. আবুল কালাম) বলতে পারবে ভালো। আমিও জানি তবে আমার থেকে ও ভালো বলতে পারবে। রাষ্ট্র দেখভাল করে না। কোনো সরকারই করেনি। অসুস্থ হওয়ার পরেও সরকার দেখভাল করেনি।
১৯ ফেব্রুয়ারি আবুল কালামের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইস্কাটনের ২৩/সি বাসায় যাওয়া। বাসায় ঢুকতেই গত বছরের তুলনায় বেশ অসুস্থ মনে হলো। প্রথমে নিজের অসুস্থতা জানিয়ে কথা বলতে অপরাগতা প্রকাশ করলেন। অনুরোধের পর অবশ্য রাজিও হলেন। অল্প অল্প করে কিছু কথা বলা গেলো।
আরও পড়ুন
- ভাষাসৈনিক বললেন, ‘যা চেয়েছিলাম তা পাইনি’
- ৭০ বছরেও স্বীকৃতি মেলেনি নারায়ণগঞ্জের ভাষাসৈনিকদের
- দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ দেখে মরতে চান শতবর্ষী ভাষাসৈনিক
- জন্মস্থানেই হারিয়ে যাচ্ছে ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুবের স্মৃতি
কেমন আছেন, শরীরটা কেমন যাচ্ছে প্রশ্ন করতেই বলেন, শরীর ভালো না, ঠিকমতো ঘুম হয় না। সকালের দিকে একটু ঘুম হয় আর সারা রাত জেগে থাকি। চোখে ভালো দেখি না, কানে ভালো শুনি না, খাবারও তেমন খেতে পারি না।
আগের চেয়ে এখন অসুস্থ, আগের বয়স তো এখন আর নেই। সময় কাটে শুয়ে-বসে। চিন্তা-ভাবনা করে। নিয়মিত ডাক্তার দেখাতে পরি না। ওষুধ খেতে হয়।
একটু থেমে আবার বললেন, আগের চেয়ে এখন অসুস্থ, আগের বয়স তো এখন আর নেই। সময় কাটে শুয়ে-বসে। চিন্তা-ভাবনা করে। নিয়মিত ডাক্তার দেখাতে পরি না। ওষুধ খেতে হয়।
কিংবদন্তি এ ভাষাসৈনিকের জীবনসঙ্গীনী ছিলেন মাইক্রো বায়োলজির অধ্যাপক এস কে রুহুল হাসিন। যিনি ২০০৬ সালে মারা যান। ব্যক্তি জীবনে এই দম্পতি নিঃসন্তান।
আহমদ রফিক দীর্ঘদিন রাজধানীর উত্তরায় বসবাস করেছেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বাড়ি বিক্রি করে ২০০৮ সালে ইস্কাটনে চলে আসেন। ওঠেন ভাড়া বাসায়। এসব কথা জানালেন বর্তমানে আহমদ রফিকের দেখাশোনা করা মো. আবুল কালাম। যিনি ১৯৮৯ সাল থেকে তাকে দেখাশোনা করেন।
চন্দ্রবানু নামে আরেক নারী আছেন। তিনিও ২৫ বছর ধরে এই ভাষাসৈনিকের দেখাশোনা করেন। দুজনই অবশ্য বেতনভুক্ত। তবে তারাই এখন পরিবার। ‘স্যারের এক ভাগ্নে কিছুদিন টাকা পয়সা পাঠালেও এখন আর খোঁজ নেয় না’ জানালেন আবুল কালাম।
দুপুরে খাবার বলতে ভাত, মাছ, সবজি আর রাতে কেক, রুটি, ডিম, ফল এসব খুব অল্প পরিমাণে খেতে পারেন তিনি। নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হয়। তবে প্রয়োজন উন্নত চিকিৎসা, আরেকটু ভালো জীবনমান। উত্তরার বাড়ি বিক্রির পর যে অর্থ পেয়েছিলে তা নিজের জন্য অল্প পরিমাণে রেখে বাকিটা বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানে দান করে দিয়েছেন। তার ধারণা ছিল বেশিদিন হয়তো বাঁচবেন না। এসব অর্থের তাই কোনো কাজ নেই। এখন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ভুগছেন চরম অর্থ সংকটে। অর্থের অভাবে তাই সুচিকিৎসা পর্যন্ত হচ্ছে না।
ইস্কাটনের এই বাসার ভাড়া সব মিলিয়ে প্রতি মাসে প্রায় ৩৩ হাজার টাকা। খাবারসহ অন্য সব খরচ এখন অনিশ্চিতভাবে চলে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতার ওপর চলছেন এখন।
চিকিৎসাসহ যাবতীয় খরচ কীভাবে চলে— এমন প্রশ্ন করতেই আহমদ রফিক বলেন, ও (আবুল কালাম) বলতে পারবে ভালো। আমিও জানি তবে আামর থেকে ও ভালো বলতে পারবে। রাষ্ট্র দেখভাল করে না। কোনো সরকারই করেনি। অসুস্থ হওয়ার পরেও সরকার দেখভাল করেনি।
শমরিতা (শমরিতা হাসপাতাল) ডিক্লিয়ারেশন দিয়ে দেখভাল করবে বলেছিল, একবার দেখানোর পরেরবার ঠিকই বিল নিয়েছে। এদের ওপর ভরসা করে কেউ! ভালো চিকিৎসা দরকার। আর্থিক সংকট আছে, ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সংকট আছে। ডাক্তারের কাছে গেলে তো উঠতে হয়, যেতে হয়। সেটা আমার জন্য কষ্টকর।
ভাষার জন্য রাজপথে লড়ে এখন এই অবস্থার জন্য আফসোস লাগে কি না— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এদের জন্য আবার আফসোস লাগবে কী! শমরিতা (শমরিতা হাসপাতাল) ডিক্লিয়ারেশন দিয়ে দেখভাল করবে বলেছিল, একবার দেখানোর পরেরবার ঠিকই বিল নিয়েছে। এদের ওপর ভরসা করে কেউ! ভালো চিকিৎসা দরকার। আর্থিক সংকট আছে, ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সংকট আছে। ডাক্তারের কাছে গেলে তো উঠতে হয়, যেতে হয়। সেটা আমার জন্য কষ্টকর।
মো. আবুল কালাম বলেন, প্রতি মাসে লাখখানেক টাকার কাছাকাছি খরচ হয়। ওনার এখন এক পয়সাও ইনকাম নেই। নিয়মিত সরকারি কোনো সাহায্য উনি পান না। উনি নিজে তো যাওয়ার অবস্থায় নেই। ডাক্তার দেখাতে নিতে হলে দুজনে ধরে বাসার নিচে নিয়ে গাঠি ভাড়া করে যেতে হয়। নিয়মিত চেকআপ-উন্নত চিকিৎসা দরকার।
সরকার যদি দায়িত্ব নেয়, ডাক্তার নিয়মিত এসে চেকআপ করে যায় তাহলে ওনার জন্য ভালো হয়। দাবি জানান আবুল কালাম।
এনএস/এএসএ/এমএস