সূচনা ফাউন্ডেশনের ব্যাংক হিসাবে ২৬৩ কোটি টাকার বেশি লেনদেন

সাইফুল হক মিঠু
সাইফুল হক মিঠু সাইফুল হক মিঠু
প্রকাশিত: ০৪:২৮ পিএম, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সূচনা ফাউন্ডেশনের সাতটি ব্যাংক হিসাবের মধ্যে তিনটিতে ২৬৩ কোটি ৫৮ লাখ ২২ হাজার ১০৮ টাকা লেনদেন হয়েছে। এছাড়া চারটি ব্যাংক হিসাবে ৫৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকার স্থায়ী আমানত (এফডিআর) রয়েছে।
সূচনা ফাউন্ডেশন ঢাকার ধানমন্ডিতে শেখ হাসিনার সুধা সদনের বাসার ঠিকানায় নিবন্ধিত। কিন্তু ওই বাড়িতে অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের এনফোর্সমেন্ট দলের অনুসন্ধান ও এনবিআরের নথি পর্যালোচনা করে এমন তথ্য জানা গেছে।

এসব তথ্যের ভিত্তিতে প্রকাশ্যে অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। সম্প্রতি এ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে নিশ্চিত করেন।

বিজ্ঞাপন

গত ২৯ জানুয়ারি সূচনা ফাউন্ডেশনের অফিসে অভিযান চালায় দুদক। একইদিন প্রতিষ্ঠানটির কর মওকুফসহ বিভিন্ন অনিয়মের নথি সংগ্রহ করতে এনবিআরে যায় দুদক।

দুদকের উপ-পরিচালক আকতারুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘চার সদস্যের একটি এনফোর্সমেন্ট দল সমাজসেবা অধিদপ্তরের দেওয়া সূচনা ফাউন্ডেশনের ধানমন্ডি অফিসের ঠিকানায় অভিযান চালায়। প্রতিষ্ঠানটি ধানমন্ডি ৫ নম্বর সড়কের ৫৪ নম্বর হোল্ডিং বা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সুধা সদনের বাসার ঠিকানায় নিবন্ধিত। ওই বাড়িতে অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।’

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

একাধিক নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সূচনা ফাউন্ডেশন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও কুমিল্লা-৭ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্তসহ সাতজন। পুতুল ছিলেন ফাউন্ডেশনটির চেয়ারম্যান। তিনি বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরে অবস্থান করায় প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হতো ভাইস চেয়ারম্যান ডা. প্রাণ গোপাল দত্তের তত্ত্বাবধানে।

এছাড়া ডা. মাজহারুল মান্নান সাধারণ সম্পাদক, সাইফুল্লাহ আব্দুল্লাহ সোলানখি কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। নাজমুল হোসেন, শিরিন মুনীর জামান ও সামসুজ্জামান ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এদের অনেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে ধারণা দুদকের।

সূচনা ফাউন্ডেশনের তিন অ্যাকাউন্টে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ২৬৩ কোটি ৫৮ লাখ ২২ হাজার ১০৮ টাকা লেনদেন হয়েছে।

নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত কুমিল্লা-৭ আসনে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য। তিনি কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

এসব বিষয় জানতে ডা. প্রাণ গোপাল দত্তের ফোনে কল করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে তার কর্মস্থল গ্রিন লাইফ হসপিটালে যোগাযোগ করা হলে সেখান থেকে জানানো হয় তিনি দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটিতে আসছেন না।

স্বেচ্ছাসেবী ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০১৪ সালে গড়ে ওঠে সূচনা ফাউন্ডেশন। মানসিক প্রতিবন্ধী, অটিজম ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতো প্রতিষ্ঠানটি। সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এটির প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল সূচনা ফাউন্ডেশন খুলে বিভিন্ন সামাজিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে জোরপূর্বক উপঢৌকন নেওয়ার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।

সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সূচনা ফাউন্ডেশনের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে আইন-বিধি মেনে কাজ করছে তদন্ত দল। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা যায় কি না সেই বিষয়ে কাজ শুরু হয়েছে। - দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন

এছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ওপর প্রভাব বিস্তার করে ফাউন্ডেশনের নামে পাওয়া অর্থ করমুক্ত করিয়ে নেওয়া হয়, এতে সরকারের বিপুল অর্থের ক্ষতিসাধন হয়। গত ১০ ফেব্রুয়ারি সূচনা ফাউন্ডেশনের আয়কর অব্যাহতির সুবিধা ও দানের ওপর করমুক্ত সুবিধা বাতিল করে এনবিআর। এর আগে গত বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশনা দেয়।

বিজ্ঞাপন

তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৫ সালের অক্টোবরে জেলা সমাজসেবা কার্যালয় থেকে ফাউন্ডেশন ফর নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅ্যাবিলিটিস অ্যান্ড মেন্টাল হেলথের নাম সংশোধন করে সূচনা ফাউন্ডেশন নামে নিবন্ধন (যার নম্বর-৮-০৯১২২) নেওয়া হয়। সূচনা ফাউন্ডেশনের নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর রেজিস্ট্রেশন রয়েছে। সূচনা ফাউন্ডেশনের তিনটি ব্যাংকে মোট সাতটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এর মধ্যে একটি ব্যাংকে তিনটি সঞ্চয়ী হিসাবে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ১৩৩ কোটি ৯৮ লাখ ৯৪ হাজার ৮০৩ টাকা জমা এবং ১২৯ কোটি ৫৯ লাখ ২৭ হাজার ৩০৫ উত্তোলনসহ মোট ২৬৩ কোটি ৫৮ লাখ ২১ হাজার ৫০৮ টাকা লেনদেন হয়েছে।

এছাড়া তিনটি ব্যাংকের চারটি অ্যাকাউন্টে ৫৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকার স্থায়ী আমানত (এফডিআর) রয়েছে। এর বাইরে কয়েকটি ব্যাংক থেকে সামাজিক দায়বদ্ধতার অর্থ সূচনা ফাউন্ডেশনের অ্যাকাউন্টে গেছে।

সূচনা ফাউন্ডেশনের ব্যাংক হিসাবগুলোর মধ্যে তিনটিতে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ২৬৩ কোটি ৫৮ লাখ ২২ হাজার ১০৮ টাকা লেনদেন হয়েছে। এছাড়া চারটি ব্যাংক হিসাবে ৫৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকার স্থায়ী আমানত (এফডিআর) রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, এনফোর্সমেন্ট অভিযানে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত ও বিভিন্ন দপ্তর থেকে সংগৃহীত রেকর্ডপত্র যাচাই-বাছাই শেষে এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরুর সুপারিশসহ কমিশনে একটি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করে কমিশন এটি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় এবং দুদকের বিশেষ তদন্ত শাখাকে অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সূচনা ফাউন্ডেশনের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে আইন-বিধি মেনে কাজ করছে তদন্ত দল। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা যায় কি না সেই বিষয়ে কাজ শুরু হয়েছে।

গত ১২ জানুয়ারি পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নামে ১০ কাঠার সরকারি প্লট বেআইনিভাবে বরাদ্দের অভিযোগে পুতুল ও তার মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৬ জনের নামে মামলা করে দুদক।

বিজ্ঞাপন

২০২৩ সালের নভেম্বরে ভারতের দিল্লিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক কমিটির ৭৬তম অধিবেশনে সংস্থাটির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক নির্বাচিত হন পুতুল। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে সেই দায়িত্ব নেন।

এসএম/এমআরএম/এমএমএআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।