ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ

ইতালির কথা বলে লিবিয়ায় আটকে মুক্তিপণ আদায়

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৪:৪৩ পিএম, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
ভুক্তভোগী পরিবারের সংবাদ সম্মেলন

ইতালিতে পাঠানোর কথা বলে লিবিয়ায় আটকে রেখে পাশবিক নির্যাতন ও মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায়ের পরও ছেড়ে দেওয়া হয়নি, বরং আবারও মুক্তিপণ দাবির অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যরা। মধ্যস্থতাকারী মোজাম্মেল হোসেন এবং ঢাকা হাওলাদার ট্রাভেলসের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেছেন তারা।

একই সঙ্গে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার অসহযোগিতাসহ আসামিদের পক্ষে কাজ করার অভিযোগ করেছেন।

বিজ্ঞাপন

রোববার (১৬ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর ক্র্যাব মিলনায়তনে ‘মানবপাচার মামলার তদন্ত নিয়ে পুলিশের গড়িমসি’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যরা এসব অভিযোগ করেন।

ঘটনার বিস্তারিও তুলে ধরে ভুক্তভোগী মাসুম মোল্যার ভাই আশরাফুল মোল্যা বলেন, ‘আসামি দালাল মো. মোজাম্মেল হোসেনের শ্বশুরবাড়ি আমার পার্শ্ববর্তী উপজেলায় হওয়ায় তিনি আমার পূর্ব পরিচিত। ২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর মোজাম্মেল হোসেন আমার বড় ভাইকে ইতালিতে পাঠানোর প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন বৈধভাবে ১৮ লাখ টাকার বিনিময়ে ঢাকা হাওলাদার ট্রাভেলস এর মাধ্যমে ইতালিতে লোক পাঠান। তখন তার প্রস্তাবে আমি রাজি হই এবং ১১ ডিসেম্বর দালাল চক্রের অন্য সদস্যদের নিয়ে গুলশান অফিসে আসার পর আমার বড় ভাই মাসুম মোল্যাকে ১৮ লাখ টাকার বিনিময়ে ইতালিতে পাঠানোর জন্য মৌখিকভাবে চূড়ান্ত চুক্তি হয়।’

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘ওই দিন আমি পাসপোর্টের সঙ্গে নগদ ৩ লাখ টাকা জমা দিয়ে বাড়ি চলে আসি। পরে মোজাম্মেল হোসেন আমাকে ফোন করে বলেন যে, আপনার বড় ভাইয়ের ফ্লাইট জানুয়ারির ২৮ তারিখ (২০২৪) এবং আমাকে বলেন বাকি ১৫ লাখ টাকা সঙ্গে নিয়ে অফিসে আসবেন। পরে গত জানুয়ারির ২১ তারিখে মোজাম্মেল আমাকে ব্যাংক হিসাব নম্বর দেন এবং বলে ১ লাখ টাকা পাঠাতে। আমি ওই দিনই ১ লাখ টাকা পাঠিয়ে দেই। পরে ২৬ তারিখে ঢাকার অফিসে এসে অন্য সব আসামিদের সামনে নগদ ১৪ লাখ টাকা মোজাম্মেল হোসেনের হাতে বুঝিয়ে দেই। সেসময় মোজাম্মেল হোসেন ২৮ তারিখ সকাল ৯টার মধ্যে আমার বড় ভাইকে অফিসে নিয়ে যেতে বলেন। সন্ধ্যায় আমার বড় ভাইয়ের ইতালির ফ্ল্যাইট বলে জানান তিনি।’

আরও পড়ুন

আশরাফুল মোল্যা বলেন, ‘আমি তার কাছে বিদেশ যাওয়ার সব কাগজপত্র চাইলে তিনি বলেন কাগজপত্র লাগবে না। সব কাগজ ফ্লাইটে ওঠার আগে আমার বড় ভাইকে বুঝিয়ে দেবেন। তখন আমি তার কথা বিশ্বাস করি। তারপর আমি ফ্লাইটের দিন ২৮ তারিখে আমার বড় ভাইকে নিয়ে তাদের অফিসে আসি। সেখানে আরও ৫ থেকে ৬ জনকে দেখি, তারাও ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে এসেছেন। পরে ওই দিন রাত ৯টায় আমার বড় ভাইসহ আরও ৫ থেকে ৬ জন দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হন। আমার বড় ভাই দুবাই পৌঁছে কল দিয়ে জানান তিনি দুবাই আছেন। সেখান থেকে ৫ দিন পর ইতালির ফ্লাইট বলে জানান। এ বিষয়ে আমি মোজাম্মেলের সঙ্গে কথা বললে জানান ওখান থেকে ইতালির ফ্লাইটে যাবে।’

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘এরপর ৭ ফেব্রুয়ারি আমাকে আমার বড় ভাই ইমোতে কল দিয়ে জানান তিনিসহ আরও ৭ থেকে ৮ জনকে ইতালির ফ্লাইট না দিয়ে দালালের মাধ্যমে লিবিয়া নিয়ে এসেছেন। আমি এই বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য মোজাম্মেল হোসেন ও তার স্ত্রী ফারজানাসহ অন্য আসামিদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা আমাকে বলেন ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে ইতালিতে যাবে। আমি তাদের কথা বিশ্বাস করি। এর ১৫ দিন পর আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।’

‘মার্চের ২৪ তারিখে আমাকে আমার বড় ভাই কল দিয়ে জানান দালালরা তাকে আটকে রেখেছেন। পাশাপাশি অমানবিক মারপিটের অডিও-ভিডিও ক্লিপ পাঠান। আমাকে জানান ওখান থেকে তাকে মুক্ত করতে হলে ২৫ লাখ টাকা দালালদের দিতে হবে। এ কথা শোনার পর দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং ঢাকায় এসে অফিস (ঢাকা হাওলাদার ট্রাভেলস) বন্ধ পাই। তারপর মোজাম্মেল হোসেনের কথায় ভাইয়ের জীবন বাচাঁনোর জন্য ব্যাংকের মাধ্যমে ১৭ লাখ টাকা দেই।’

আশরাফুল বলেন, ‘এ নিয়ে দালাল চক্রকে মোট ৩৫ লাখ টাকা দেই। কিন্তু তারপরও তারা আমার ভাইকে ছাড়েনি। পরে টাকা দেওয়ার ৬ মাস পার হয়ে গেলেও ভাইয়ের সন্ধান না পেয়ে আমি দালাল মোজাম্মেলসহ অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দেন। পরে আমি এবং অন্য এক ভুক্তভোগীর বাবা চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি গুলশান থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা করি।’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত আসামি মোজাম্মেল হোসেনকে প্রধান আসামি করে দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পরে ৪ ফেব্রুয়ারি গুলশান থানার তদন্ত কর্মকর্তা মো. পলাশ হোসেন আসামিকে রিমান্ডে নিতে হাজির করেন।’

তদন্তকারী কর্মকর্তা বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে তালবাহানার অভিযোগ তুলে আশরাফুল বলেন, ‘তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মো. পলাশ আসামির রিমান্ড নিয়ে গড়িমসি করেন এবং টাকার জন্য আমাদের হুমকি দেন। টাকা না দেওয়ায় মামলার সঠিক তদন্ত নিয়ে টালবাহানা করেন। পর্যাপ্ত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তিনি অন্য আসামিদের গ্রেফতার করছেন না।’

তিনি বলেন, ‘এসআই পলাশ মামলার ৪ নম্বর আসামি নওশেদ শিকদারকেও গ্রেফতার করতে অনীহা প্রকাশ করেন। তারপর আমরা ৯৯৯-এ কল দিয়ে গুলশান থানার এস আই মশিউরের সহযোগিতায় নওশেদ শিকদারকে গুলশান থানার পার্শ্ববর্তী তাজ উদ্দিন আহমেদ পার্ক থেকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হই।’

বিজ্ঞাপন

মোজাম্মেল এবং মুন্না হাওলাদার অবৈধভাবে কীভাবে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়াতে মানবপাচার করেন সে সম্পর্কে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এস আই পলাশ হোসেনের সামনে বিস্তারিত তুলে ধরেন গ্রেফতার নওশেদ শিকদার। জবানবন্দি পাওয়ার পরও এসআই পলাশ কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি বলেও জানান আশরাফুল।

তিনি বলেন, ‘পলাতক আসামি মুন্না হাওলাদারসহ অন্যরা লিবিয়ায় অবস্থানরত চক্রের অন্য সদস্য মো. তারেকের (দিপু) কাছে ভুক্তভোগীদের আটকে রেখে আমাদের হুমকির পাশাপাশি আরও ২০ লাখ টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। কিন্তু পুলিশ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না।’

সংবাদ সম্মেলনে আরেক ভুক্তভোগী রিপন শিকদারের বাবা সাদেক শিকদার জানান, ‘ছেলেকে পাঠানোর সময় ২১ লাখ টাকা দালালদের পরিশোধ করি। পরে রিপনকে আটকে পাশবিক নির্যাতন করে ইমোতে নির্যাতনের বিভিন্ন ভিডিও এবং অডিও পাঠিয়ে আরও ২৫ লাখ টাকা দাবি করেন তারা। আমি বিভিন্নভাবে আরও ১৫ লাখ টাকা পরিশোধ করি। কিন্তু ৪ মাস পার হয়ে গেলেও তারা আমার ছেলেকে ছাড়েনি। বরং আরও ২০ লাখ টাকা দাবি করেছে। টাকা না দিলে তারা আমার ছেলেকে মেরে ফেলবে বলেও হুমকি দিচ্ছে।’

বিজ্ঞাপন

পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা করা হচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেন সাদেক শিকদার।

কেআর/ইএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।