মানবপাচার মামলা
প্রাথমিকভাবে অপরাধ প্রমাণিত হলেও শেষ পর্যায়ে ব্যর্থ রাষ্ট্রপক্ষ
#জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানাতেও সাক্ষীর হদিস নেই
#মামলা চালাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন বিচারপ্রার্থীরা
#খালাস পেয়ে যাচ্ছেন অধিকাংশ আসামি
বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে অভিবাসন খাতটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২৭২ মিলিয়ন মানুষ কাজের জন্য বা অন্য কোনো প্রয়োজনে নিজ দেশে বাস না করে অন্য দেশে বাস করছেন। কাজের জন্য অন্য দেশে গিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন দেশের অনেক রেমিট্যান্সযোদ্ধা। সবকিছু হারিয়ে দেশে এসে তারা নেন আইনের আশ্রয়। প্রতারকদের বিরুদ্ধে করেন মানবপাচার আইনে মামলা।
মামলায় প্রাথমিকভাবে সত্যতা পেয়ে মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। মামলা প্রমাণের জন্য করা হয় একাধিক সাক্ষী। কিন্তু মামলার সাক্ষীদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরও তাদের আদালতে আনতে ব্যর্থ হচ্ছে রাষ্ট্রপক্ষ। সাক্ষীরা আদালতে উপস্থিত না হওয়ায় আসামিদের দেওয়া হচ্ছে খালাস। এতে করে মানবপাচারকারী অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছেন। ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছেন অপরাধীরা।
আরও পড়ুন: দেশে ফিরে নির্যাতনের কাহিনী শোনালেন পাচার হওয়া জাহাঙ্গীর
মানবপাচারের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি ও ন্যায়বিচার ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে ময়মনসিংহ বাদে দেশের সাত বিভাগে মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল গঠনের অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর ২০২০ সালের ৯ মার্চ ঢাকায় মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১০২৬টি মামলা নিষ্পত্তি করেন ঢাকার মানবপাচার ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে খালাস পেয়েছেন ৯১২টি মামলার আসামি। অব্যাহতি পেয়েছেন ৮৩ মামলার আসামিরা। আর সাজা হয়েছে ৩১টি মামলার আসামিদের। অধিকাংশ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের অনুপস্থিতির কারণে আসামিদের খালাস দেন আদালত।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, সাক্ষীদের সাক্ষ্য দিতে বার বার সমন জারি করা হয়। এরপর জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরও তারা সাক্ষ্য দিতে আদালতে উপস্থিত হন না।
পুলিশ বলছে, নির্ধারিত ঠিকানায় সাক্ষীদের খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই তাদের বিরুদ্ধে আদালতের দেওয়া জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিল করা যায় না।
আরও পড়ুন: কাজের কথা বলে ভারতে নারী পাচার, বাধ্য করতেন অনৈতিক কাজে
জাগো নিউজের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০২২ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত ৫৭৬টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন ঢাকার মানবপাচার ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে ১৪টি মামলায় সাজা হয়েছে। খালাস পেয়েছেন ৫১৪ মামলার আসামিরা। ২০২১ সালের মোট ৪১৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১৭টি মামলায় সাজা হয়েছে। খালাস পেয়েছেন ৩৬১ মামলার আসামিরা। ২০২০ সালের ১২ মার্চ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আদালত ৩৭টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন। নিষ্পত্তি হওয়া কোনো মামলায় সাজা হয়নি। বরং সবাই খালাস পেয়েছেন।
অধিকাংশ মামলার খালাসের রায়ে বিচারক উল্লেখ করেছেন, রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষীদের আদালতে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে। সাক্ষী উপস্থাপনে রাষ্ট্রপক্ষের অনুরূপ ব্যর্থতার কারণে একটি ফৌজদারি মামলা বছরের পর বছর বিচারাধীন থাকার কোনো আইনগত বা যুক্তিসংগত বিধান নেই। মামলার বিচারে অনুরূপ বিলম্ব ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। তাই আসামিদের খালাস প্রদান করা ন্যায়সংগত এবং যুক্তিযুক্ত।
জাগো নিউজের অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ৫১টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৪৪ মামলায় খালাস, ৪ মামলায় অব্যাহতি ও তিন মামলায় সাজা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে ৫৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৪৭ মামলায় খালাস, ৬ মামলায় অব্যাহতি হয়েছে। মার্চ মাসে ৪৬টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৪৩ মামলায় খালাস, দুই মামলায় অব্যাহতি ও এক মামলায় সাজা হয়েছে। এপ্রিল মাসে ৪৬টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৪৩ মামলায় খালাস, দুই মামলায় অব্যাহতি ও এক মামলায় সাজা হয়েছে। মে মাসে ৫০টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৪৬ মামলায় খালাস, দুই মামলায় অব্যাহতি ও দুই মামলায় সাজা হয়েছে। জুনে মাসে ৬৬টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৬০ মামলায় খালাস, চার মামলায় অব্যাহতি ও দুই মামলায় সাজা হয়েছে। জুলাই মাসে ২৭টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ২৫ মামলায় খালাস, দুই মামলায় অব্যাহতি হয়েছে। আগস্ট মাসে ৪৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৪১ মামলায় খালাস, চার মামলায় অব্যাহতি হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে ৬৭টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৬২ মামলায় খালাস, ৪ মামলায় অব্যাহতি ও এক মামলায় সাজা হয়েছে। অক্টোবর মাসে ৩৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ২৪ মামলায় খালাস, ৭ মামলায় অব্যাহতি ও দুই মামলায় সাজা হয়েছে। নভেম্বর মাসে ৯২টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৩টি মামলায় সাজা হয়েছে। খালাস পেয়েছেন ৭৯ মামলার আসামি আর অব্যাহতি পেয়েছেন ১০ মামলার আসামি।
আরও পড়ুন: নৌকায় ভেসে ভেসে লিবিয়ার ‘গেম ঘরে’ আটকা কয়েকশ বাংলাদেশি
জাগো নিউজের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ৫৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৪১ মামলায় খালাস, ৯ মামলায় অব্যাহতি ও তিন মামলায় সাজা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে ৪৬টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৩৬ মামলায় খালাস, ৭ মামলায় অব্যাহতি ও তিন মামলায় সাজা হয়েছে। মার্চ মাসে ৫৭টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৫৫ মামলায় খালাস, এক মামলায় অব্যাহতি ও এক মামলায় সাজা হয়েছে। এপ্রিল মাসে মাত্র একটা মামলায় নিষ্পত্তি হয়েছে। এ মামলায় খালাস দেওয়া হয়েছে। মে মাসে কোনো মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। জুনে নিষ্পত্তি হওয়া সাত মামলায় খালাস দেওয়া হয়েছে। জুলাই মাসে কোনো মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। আগস্টে নিষ্পত্তি হওয়া ১০ মামলায় খালাস দেওয়া হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে ৭৪টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৬৪ মামলায় খালাস, ৪ মামলায় অব্যাহতি ও ছয় মামলায় সাজা হয়েছে। অক্টোবর মাসে ৫৭টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৫০ মামলায় খালাস, ৪ মামলায় অব্যাহতি ও তিন মামলায় সাজা হয়েছে। নভেম্বর মাসে ৭৬টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৭৫ মামলায় খালাস, এক মামলায় অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ডিসেম্বর মাসে ৩২টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ২৫ মামলায় খালাস, ৬ মামলায় অব্যাহতি ও এক মামলায় সাজা হয়েছে।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে মানবপাচারের ছয় হাজার ১৩৪টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৩৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। ৩৩টি মামলায় ৫৪ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। ২০০ মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত বিচারাধীন ছিল বাকি পাঁচ হাজার ৯০১টি মামলা।
আরও পড়ুন: ভারতে চাকরির কথা বলে যৌনপল্লিতে বিক্রি, নারী গ্রেফতার
হিসাব মতে, প্রায় ১৪ শতাংশ মামলায় আসামির সাজা হয়েছে। বাকি প্রায় ৮৬ শতাংশ বিচারে আসামি খালাস পেয়েছে।
ভালো চাকরির মিথ্যা প্রলোভনে শফিকুলদের পাচার করা হয় ইরাকে
মাসিক বেতন ৩৫০ ইউএস ডলারে ভালো চাকরির মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে ভুয়া ছাড়পত্র দিয়ে ২০১৩ সালের ১৬ থেকে ২৮ মার্চ শফিকুল ইসলামকে ইরাকে পাচার করেন নাসির উদ্দিন। এর জন্য তার কাছ থেকে নেওয়া হয় চার লাখ টাকা। শফিকুলের সঙ্গে ইরাকে পাচার করা হয় রুবেল মিয়া, মীর কাসেম ইলিয়াস হোসেনকে। সেখানে পৌঁছামাত্র শফিকুলসহ চারজনের পাসপোর্ট নিয়ে একটি ক্যাম্পে বন্দি করে রাখেন আসামিদের সহযোগীরা। ওই ক্যাম্পে বন্দি অবস্থায় ছিলেন আরও ২৭ জন বাংলাদেশি। সেখানে দীর্ঘ দশ মাসেও শফিকুলসহ চারজনকে কোনো কাজ দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়নি বেতন। ঠিকমতো খাবারও দেওয়া হয়নি। কাজ ও খাবার চাইলে তাদের ওপর চলতো অমানবিক নির্যাতন। কোনো কুলকিনারা না পেয়ে শফিকুলসহ চারজন যোগাযোগ করেন বৈদেশিক কর্মসংস্থান ব্যুরোতে। বৈদেশিক কর্মসংস্থা ব্যুরো সেখান থেকে উদ্ধার করে পরের বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি তাদের বাংলাদেশে পাঠান।
দেশে এসেই নাসির উদ্দিন খান, জয়নাল আবেদীন জয়, রোকনুজ্জামান, আমির আলী, নুরুন নবী, নুর আলম ও জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিমানবন্দর থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২ এর ৭/৮ ধারার শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে একটি মামলা করেন।
আসামিদের বিরুদ্ধে মানবপাচারের অভিযোগ প্রাথমিকভাবে সত্য প্রমাণিত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। মামলা প্রমাণের জন্য চার্জশিটে সাক্ষী করা হয় ১৯ জনকে।
আরও পড়ুন: গোপালগঞ্জে নারী পাচারকারীসহ আটক ৬
এরপর ট্রাইব্যুনাল আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। বিচার চলাকালে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ ছয়জন আদালতে সাক্ষ্য দেন। মামলার বাদী শফিকুলসহ অন্য সাক্ষীদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরও তাদের আদালতে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয় রাষ্ট্রপক্ষ।
রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম না হওয়ায় ২০২২ সালের ২০ অক্টোবর আসামিদের বেকসুর খালাস দেন ট্রাইব্যুনাল।
বিচারক রায়ে উল্লেখ করেন, রাষ্ট্রপক্ষ ভিকটিমদের প্রতারণার আশ্রয়ে বা ভয়ভীতি প্রদর্শনপূর্বক বা বলপ্রয়োগ করে ইরাকে পাচার বা ইরাকে অবস্থানকালে আসামিদের দ্বারা ভিকটিমদের শ্রম শোষণ ও নির্যাতনের বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হননি।
পলিকে গৃহকর্মীর কাজ দেওয়ার কথা বলে দেওয়া হয় ব্যাচেলর হাউজে
মেয়ে পলি আক্তারকে ২০১৮ সালের ৯ আগস্ট এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি আরব পাঠান কোহিনুর বেগম। সেখানে তাকে গৃহকর্মীর কাজ দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হয় ব্যাচেলর হাউজের কাজ। ব্যাচেলর হাউজে থাকা অবস্থায় পলির ওপর চলে পাশবিক অত্যাচার। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পলি তার মাকে জানান। পলির মা এ খবর শুনে ছুটে যান পল্টনের এজেন্সি অফিসে। যেখান থেকে পলিকে সৌদি পাঠানো হয়। অফিসে গিয়ে তিনি পলিকে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বলেন তাদের।
পলিকে দেশে ফেরত আনতে কোহিনুরের কাছে চাওয়া হয় তিন লাখ টাকা। অনেক কষ্টে তাদের সঙ্গে ষাট হাজার টাকায় রফাদফা হয়। ৪৫ দিন পর দেশে ফিরে আসেন পলি। পলি ফিরে আসার সাতদিনের মাথায় ৩০ অক্টোবর ঢাকার আদালতে মানবপাচার আইনের ৬/৭/৮/১৪ ধারায় একটি মামলা করেন কোহিনুর।
মানবপাচার মামলায় গ্রেফতার আসামিদের ফাইল ছবি
আসামি করা হয় বার্সেলোনা ওভারসিজ প্রা. লিমিটেডের ব্যবসায়িক অংশীদার জাহাঙ্গীর আলম, আসাদ, প্রোপ্রাইটর আব্দুল হালিম, প্রসেসিং ম্যানেজার মিজানুর রহমান, মনির হোসেন ও অফিসের পিয়ন মানিকে।
আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। মামলাটি প্রমাণের জন্য পাঁচজন সাক্ষী করা হয়। একই বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। কিন্তু অভিযোগ গঠনের চার বছরেরও অধিক সময় অতিক্রম হওয়ার পর আদালতে কোনো সাক্ষী উপস্থিত হয়নি।
আদালতে সাক্ষীদের উপস্থিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর আসামিদের খালাস প্রদান করেন ঢাকার মানবপাচার ট্রাইব্যুনাল।
আরও পড়ুন: হজের আশ্বাসে সৌদি নিয়ে নির্যাতন, টার্গেট দরিদ্র-তালাকপ্রাপ্ত নারী
রায়ে বিচারক উল্লেখ করেন, রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষীদের আদালতে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এরই মধ্যে প্রায় চার বছরেরও অধিক সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। সাক্ষী উপস্থাপনে রাষ্ট্রপক্ষের অনুরূপ ব্যর্থতার কারণে একটি ফৌজদারি মামলা বছরের পর বছর বিচারাধীন থাকার কোনো অইনগত বা যুক্তিসংগত বিধান নেই। মামলার বিচারে অনুরূপ বিলম্ব ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। তাই ফৌজদারি কার্যবিধির ২৬৫ ধারা মতে আসামিদের খালাস প্রদান করা ন্যায়সংগত এবং যুক্তিযুক্ত।
সৌদিতে কর্মী পাঠিয়ে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়কারী-ফাইল ছবি
শুধু শফিকুল বা পলি নন। এভাবে মানবপাচারকারীদের হাতে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন অনেক রেমিট্যান্সযোদ্ধা। দেশে এসে নিচ্ছন আইনের আশ্রয়। মামলা প্রমাণ করতে রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষীদের আদালতে উপস্থিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় খালাস পেয়ে যাচ্ছেন মানবপাচারকারী অপরাধীরা।
আরও পড়ুন: বিদেশে পার্লারে কাজের কথা বলে নারী পাচার, আটক ৬
এ বিষয়ে ঢাকার মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (ভারপ্রাপ্ত পাবলিক প্রসিকিউটর) সাজ্জাদুল হক শিহাব বলেন, মানবপাচার মামলার সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে সমন জারি করেন আদালত। সমন জারির পরও সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষ্য দিতে উপস্থিত না হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এরপরও সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষ্য দিতে হাজির হন না। মামলার বাদী ও সাক্ষীদের যে ঠিকানায় সমন পাঠানো হয় সে ঠিকানায় তাদের পাওয়া যায় না। সাক্ষী ছাড়া মামলা প্রমাণ করা যায় না। তাই অধিকাংশ মানবপাচার মামলার আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, মানবপাচার ট্রাইব্যুনাল গঠনের আগে এ মামলাগুলোর বিচার হতো নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালে। সেখান ৯৯ শতাংশ মামলা হলো পিটিশন মামলা। এ মামলাগুলোতে বাদী ও সাক্ষী হতো পাবলিক। কিন্তু তারাও একটা পর্যায়ে আদালতে সাক্ষ্য দিতে হাজির হয় না। এছাড়া কিছু মামলার বাদী হচ্ছে পুলিশ। তারাও সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির হয় না। অধিকাংশ পুরোনো মামলায় বর্তমানে সাক্ষী হাজির না হওয়ায় আসামিদের খালাস প্রদান করছেন আদালত।
গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের হাতে আটক নারী পাচারকারী-ফাইল ছবি
আইনজীবী জি এম মিজানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, মানবপাচার দেশের জন্য অভিশাপ। মানবপাচারকে নির্মূল করতে হবে। এজন্য রাষ্ট্রপক্ষকে মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে আরও শক্তিশালী ভূমিকা নিতে হবে। সাক্ষীদের আদালতে আনার জন্য ভূমিকা নিতে হবে। সাক্ষীদের সঙ্গে মোবাইল, হোয়াটসঅ্যাপ অথবা সরাসরি যোগাযোগ করতে হবে। সাক্ষীর আগের দিনও তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। যাতে করে তারা সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির হন। প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি হলে মানবপাচার অনেকটাই কমে আসবে।
আরও পড়ুন: মালয়েশিয়ায় পাচারে প্রতিবন্ধী তরুণীরা ছিল মা-মেয়ের টার্গেট
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, মানবপাচারকারীরা বড় শক্তিশালী। যিনি পাচারের শিকার তিনি দুর্বল থাকেন। শক্তিশালী থাকার কারণে মানবপাচারকারীরা মামলা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাদের পক্ষে সব কিছু নিয়ে যান। যিনি বিচারপ্রার্থী তিনি বিভিন্ন জায়গায় অসহায়ের মতো ঘুরে বেড়ায়। ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে এক সময় বিচারপ্রার্থীরা মামলা চালাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। অনেক সময় আসামিরা বিচারপ্রার্থীদের মামলার সমঝোতার কথা বলেন। আমি মনে করি মানবপাচারের মামলাগুলোয় সরকারকে ভালোভাবে নজর দিতে হবে। যারা বড় বড় মানবপাচারকারী তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বিচার দেরিতে হওয়া বা না পাওয়া আরও বড় দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে যে পাচারকারীরা শস্তিশালী আর যিনি পাচারের শিকার হয়েছেন তিনি দুর্বল।
আরও পড়ুন: ইউরোপ পাঠানোর কথা বলে ভারতে পাচার
ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, মানবপাচার আইনের মামলার সাক্ষীর সমনগুলো যখন আদালত থেকে আমাদের কাছে পাঠানো হয় সেটা আমরা নির্ধারিত ঠিকানায় পাঠিয়ে দেই। নির্ধারিত ঠিকানায় গিয়ে তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে সাক্ষীর সুরক্ষা আইনের ব্যবস্থা না থাকায় সাক্ষীরা অধিকাংশ সময় সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির হন না। তারা সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসা নিরাপদ মনে করেন না। তাই সাক্ষী সুরক্ষা আইনের ব্যবস্থা করতে হবে। সাক্ষীদের সুরক্ষা দিতে হবে।
জেএ/এসএইচএস/জেআইএম