ড. মুহাম্মদ ইউনূস: যিনি স্বপ্নের সমান বড়
একজন মেধাবী ছাত্র সারা জীবনে একটি কিংবা বড়জোর দুটি স্বপ্ন দেখেন — ভালোভাবে পড়ালেখা করে একটি ভালো চাকরি যোগাড় করা এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। অপরপক্ষে, কেউ যদি এক জীবনে একজন সফল ছাত্র, শিক্ষক, উদ্যোক্তা, ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ, রাষ্ট্রনায়ক, নাগরিক সমাজের সর্বজনগ্রাহ্য নেতা এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বে তুমুল জনপ্রিয় সামাজিক ব্যবসার পুরোধা হন, তাকে কি সাধারণ মানুষ বলা যায়? না, মনে হয় বলা যায় না। আমি জানি পাঠকও বলবেন না। কারণ সাধারণের আবরণে তিনি অনন্য, অসাধারণ। সে জন্যই তিনি অভীষ্ট লক্ষে অটুট। সে জন্যই তিনি জয়ী। সে জন্যই তিনি বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের এক নম্বর রোল মডেল। তিনি প্রফেসর ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস। যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক জাতি রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকে এখন পর্যন্ত শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী একমাত্র বাংলাদেশি নাগরিক।
ঘটনাটা ঘটে ২০০৬ সালের ১৩ই অক্টোবর। বসুন্ধরা সিটি শপিং মলের ভিতরে চোখ আটকে গেল একটি টিভি সেটের পর্দায়। বাংলাদেশ জয় করেছে বিশ্ব। ড. ইউনূস শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন। বারংবার স্ক্রল পড়লাম। ঘটনাটা সত্যি! ড. ইউনূসের মাধ্যমে আমরা বাঙালিরা নোবেল পেয়েছি। কিছুক্ষণের জন্য আমি ঠায় দাড়িয়ে থাকলাম, আনন্দে আত্মহারায়। গর্বে বুকটা ফুলে উঠল। চোখের কোণে ছলছল আনন্দাশ্রু। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ও ক্ষুদ্রঋণ ধারণার প্রবর্তন করে ড. ইউনূস ও তাঁর প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক দক্ষিণ এশিয়ার এক ক্ষুদ্র দেশকে এক বিরল সম্মান এনে দিল! তিনি বিশ্বের সাতজন ব্যক্তিত্বের একজন যারা নোবেল পুরস্কার, মার্কিন ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম’ এবং মার্কিন ‘কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল’-এ ভূষিত হন। তাঁর অর্জন এখানেই শেষ নয়। এই ‘ব্যাংকার অব দ্য পুওর’-এর ঝুলিতে রয়েছে কয়েক ডজন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার। সম্মাননাও পেয়েছেন কয়েক ডজন দেশি-বিদেশি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
৮৪ বছরের এই অদম্য মানুষ ড. ইউনূস স্বপ্ন দেখেন ও স্বপ্ন দেখাতে ভালবাসেন আপামর জনসাধারণকে। যিনি এখনও রাত-দিন খেটে চলেন যুবক বয়সের উদ্যমতায়। যিনি বাংলাদেশে ও দেশের সীমানা পেরিয়ে বাঙালি ও অবাঙালি সবার কাছে প্রিয় ব্যক্তিত্ব। কেন তিনি সমানভাবে এতটা জনপ্রিয় দেশে ও বিদেশে? কারণ তাঁর চৌম্বক ব্যক্তিত্ব, তাঁর স্পষ্টবাদিতা ও তাঁর জীবনবোধ ও কাজের দর্শন। তিনি বাতিঘরের মতো — মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী, দেশের উন্নয়ন যাত্রার সারথি। দেশের উন্নয়ন, দশের উন্নয়ন, ক্ষুদ্রঋণ, দারিদ্র দূরীকরণ, অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, নারী উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন, লিঙ্গ সমতা, আত্মকর্মসংস্থান, বেসরকারি খাতে মানুষের উন্নত জীবনের জন্য জীবিকার বন্দোবস্থকরণ — কোথায় নেই তাঁর অবদান! তবুও আমাদের অনেক বাঙালির চক্ষুশূল হয়েছেন তিনি। বিগত বছরগুলোতে হয়েছেন ক্ষমতাসীনদের চোখের বালি। বারংবার তাঁকে পদ্মায় চুবোনোর খায়েশ ব্যাক্ত করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। তবে ড. ইউনূস দমে যাননি কখনোই; তিনি নিষ্ঠা, একাগ্রতা, সততা এবং অবিচলতার সাথে নিজের কাজ করে গেছেন।
সদ্য পতিত স্বৈরাচারের কর্তৃত্ববাদী শাসনামলে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অসংখ্য মিথ্যা মামলা রুজূ ও সরকারের মদদে হয়রানি বন্ধে বিশ্বের বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রনায়ক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা বহুবার কলম ধরেছে, খোলা চিঠি দিয়েছে। তাতেও কাজ হয়নি কেননা তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। বিনা ভোটের লুটেরা সরকার খুন-গুমের রাজত্ব কায়েম করেছে বিগত ১৫ বছর ৭ মাস যাবত। দুর্নীতি-মিশ্রিত কিছু ভালো কাজের পাশাপাশি রাজনৈতিক বিরোধীদের-প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন-পীড়ন ছিল আঁতকে ওঠার মত। দেড় যুগের বেশি সময়ের জেল-জুলুম-নির্যাতনের অবসান ঘটে চলতি মাসে ছাত্র-জনতার যৌবনদীপ্ত এক মহাকাব্বিক উপাখ্যানসম বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। মাসব্যাপী এই আন্দোলনের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে ২০২৪ সালের ০৫ আগস্টে। বাঙালীরা পায় দ্বিতীয় স্বাধীনতার স্বাদ, অভ্যুদয় হয় এক নতুন বাংলাদেশের। হঠাৎ মনে পড়লো চিশতী বাউলের সেই বিখ্যাত “যদি থাকে নসিবে, আপনি আপনি আসিবে…” গানের কথা।
ড. ইউনূস বরাবরই সাদামাঠা, নির্মোহ একজন ব্যক্তিত্ব। অনুদানের টাকায় প্রতিষ্ঠিত এই গ্রামীণ ব্যাংকে তাঁর কোন অংশিদারীত্ব নেই, মালিকানাও নেই। তবুও শেখ হাসিনা “সুদখোর জোঁক” হিসেবে বিশ্রী তকমা দিয়েছে। যদি তাই হয়, তবে বিভিন্ন তথ্যমতে সারা পৃথিবীর ১০৭টা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিজেদের উদ্যোগে মুহাম্মদ ইউনূস সেন্টার স্থাপন করলো কেন? ড. ইউনূস প্রায়শই বলেনঃ “নিজের জন্য টাকা কামানো হয়তো হ্যাপিনেস, অন্যের উপকার করা হচ্ছে সুপার হ্যাপিনেস।” তিনি মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে অঢেল সম্পদের পুঞ্জীভূত না হওয়ার ব্যপারে সদা সোচ্চার। তিনি মনে করেন সবাই এককভাবে সম্পত্তির মালিক হতে থাকলে গরীব আরো গরীব হয়ে যাবে, ধনী আরো ধনী হবে। ফলে বিশ্বব্যবস্থা অচল হয়ে পড়বে।
এই গ্লোবাল সেলিব্রেটি ফ্রান্সে সদ্য সমাপ্ত প্যারিস অলিম্পিকের মধ্যমণি ছিলেন। সরকারের তখতে তাউসে বসার কোন ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের অনুরোধে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস অগত্যা প্যারিস থেকে উড়াল দিয়ে ঢাকায় আসেন দেশ ও জাতিকে এই রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে মুক্তির দিশারী হিসেবে। চলতি মাসের ০৮ আগস্টে ১৭জন উপদেষ্টার সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বঙ্গভবনে শপথবাক্য পাঠ করে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। আমরা যতই তাকে অবহেলা-অবজ্ঞা করি না কেন, কোন লাভ নেই তাতে। আগুনের ধর্মই হচ্ছে জ্বলতে থাকা। আগুনকে চাপিয়ে রাখা যায় না, বরং তা কিছু সময় ছাইয়ের নিচে ধিকধিক করে জ্বলতে থাকে। তাঁর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে নোবেল লরিয়েট ড. ইউনূস। তাঁর ‘ইন্টেলেকচুয়ালিটি’ (intellectuality) বা বুদ্ধিবৃত্তির মূল্য যে অপরিসীম!
দ্বিতীয় স্বাধীনতা পেয়ে জনতা মুক্ত নিঃশ্বাস ফেলছে। ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে অবদান রাখা এই অর্থনীতিবিদ সুচারুভাবে দেশ পরিচালনা করবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি, কারণ বাঙালির ভাগ্যাকাশে আজ উজ্জ্বল নক্ষত্ররূপে আবির্ভূত হয়েছেন তিনি রাষ্ট্রের হাল ধরতে, দূষিত শাসনের খপ্পরে পড়া রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক সংস্কার কাজে। তিনি শুরু করেছেন এক নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্নযাত্রা। ড. ইউনূসের দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে নতুন-পুরাতনের মিশেলে গঠিত এই উপদেষ্টা পরিষদ যুব শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ও তাদের চেতনাকে পূঁজি করে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করবে এবং গনতন্ত্রকামী জনগণের প্রত্যাশা পূরণে আগামী সাধারণ নির্বাচনের মাঠ পঙ্কিল্মুক্ত করবে।
আমরা আশা করি ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক করবে এবং শেখ হাসিনার বহু বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের ‘অন্ধকার যুগ’ থেকে বাংলাদেশকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনবে। সরকারপ্রধান হিসেবে ড. ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনবেন। পাশাপাশি, জাতীয় বীর আবু সাঈদসহ দেশজুড়ে অন্যান্য শহীদ ছাত্রজনতা ও আহতদের পরিবারে যথাযতভাবে ক্ষতিপূরণ দিতে সক্ষম হবেন এবং দ্রুতগতিতে হত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারবেন। এছাড়া, দেশের মানুষ আশা করেন বর্তমান সরকার গণমাধ্যমে নগ্ন হস্তক্ষেপ ও কড়াকড়ি আরোপের পরিবর্তে পূর্ণ স্বাধীনতা দিবেন।
শেষ করবো ড. ইউনূসের বিখ্যাত তিন শূন্যের (three zeros) দর্শন দিয়ে। তিনি বিশ্বব্যাপী প্রচার করেন ‘শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ’, দারিদ্র্য হ্রাসের জন্য ‘শূন্য সম্পদ পুঞ্জীভূতকরণ’ এবং সবাইকে উদ্যোক্তা বানানোর মাধ্যমে ‘শূন্য বেকারত্ব’ তত্ত্ব যার প্রয়োগে একটি সুন্দর পৃথিবী ও উন্নত আগামী গড়া সম্ভব। নোবেল পুরস্কার বিজয়ের মাধ্যমে জনগণকে সম্ভাবনার যে অসীম স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তিনি, কী অসাধারণভাবে ১৮ বছর পরে সেই তিনিই সেই স্বপ্নকে বাস্তব করার সবচেয়ে মোক্ষম সুযোগটি পেয়ে গেলেন।
এম আমিনুল ইসলাম ([email protected]) জাতীয় ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস’-এর সিনিয়র নিউজ কনসালটেন্ট হিসেবে কর্মরত।
এইচআর/জিকেএস