ঘাতকের নির্ভুল ছকে ১৫ আগস্ট
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড ছিল ঘাতকের নির্ভুল ছকের অপারেশন। ওইদিন রাতভর প্রস্তুতি আর আধুনিক সমরাস্ত্রের সহায়তা নিয়ে স্বল্পতম সময়ে যে তাণ্ডব ঘটায় সেনাকর্মকর্তারা, তাতে গোটা দুনিয়া বিস্ময় প্রকাশ করে।
অপারেশনের আগের দিন ১৪ আগস্ট সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সেনাবাহিনীর টু-ফিল্ড রেজিমেন্টের যানবাহনগুলো সচল হয়ে ওঠে। ক্যান্টনমেন্টের দক্ষিণে অবস্থিত ইউনিট থেকে ১০৫ এমএম কামানগুলোকে ভারি ট্রাক দিয়ে নির্মাণাধীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয় নিয়মিত নৈশ প্রশিক্ষণের জন্য।
রাত ১০টার দিকে সেনানিবাসের উত্তর প্রান্ত থেকে বেঙ্গল ল্যান্সারের টি-৫৪ ট্যাংকগুলো ইউনিট থেকে বেরিয়ে পড়ে। এয়ারপোর্টে ১৮টি কামান ও ২৮টি ট্যাংক একত্রিত হয়। রাত সাড়ে ১১ টার দিকে মেজর ডালিম, মেজর নূর, মেজর হুদা, মেজর শাহরিয়ার, মেজর পাশা, মেজর রাশেদ প্রমূখ সেখানে জড়ো হয়।
১৫ আগস্ট রাতের প্রথম প্রহরে মেজর ফারুক অফিসারদের নিদের্শ দেয় বিমানবন্দরের কাছে হেড কোয়ার্টারে স্কোয়াড্রন অফিসে মিলিত হতে। অফিসারদের অপারেশনের পরিকল্পনা জানায় মেজর ফারুক।
মেজর ফারুক-ই ছিল অপারেশনের দায়িত্বে। প্রধান টার্গেট বঙ্গবন্ধুর বাড়ি সরাসরি আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। ওই বাড়িকে ঘিরে দু`টো বৃত্ত তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। আরো সিদ্ধান্ত হয়, ভেতরের বৃত্তের সদস্যরা সরাসরি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণ করবে। বাইরে থেকে রক্ষীবাহিনী বা ভেতর থেকে সেনাবাহিনীর কোনো আক্রমণ এলে তা ঠেকানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় বাইরের বৃত্তের সদস্যদের।
এর দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর নূর এবং মেজর হুদাকে। সিদ্ধান্ত হয়- তারা ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোড সোবাহানবাগ মসজিদ এবং ৩২ নম্বর ব্রিজে রোড ব্লক করবে। প্রধান টার্গেট বঙ্গবন্ধুর বাসা আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ধানমন্ডিতেই শেখ ফজলুল হক মণি এবং আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়।
মেজর ডালিম বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে অপারেশনের পরিবর্তে স্বেচ্ছায় সেরনিয়াবাতের বাড়িতে আক্রমণের দায়িত্ব নেয়। ভারী মেশিনগান সংযোজিত দ্রতগতির একটি জিপে রওনা দেয় ডালিম। সঙ্গে এক প্লাটুন ন্যান্সারসহ একটি বড় ট্রাক।
শেখ মণির বাসায় আক্রমণের দায়িত্ব দেয়া হয় রিসালদার মোসলেউদ্দিনকে। তার সঙ্গে দেওয়া হয় দুই প্লাটুন সৈন্য। এক কোম্পানি সৈন্যসহ রেডিও স্টেশন, বিশ্ববিদ্যায় এবং নিউমার্কেট এলাকায় দায়িত্ব থাকে মেজর শাহরিয়ার।
২৮টি গোলাবিহীন ট্যাংক নিয়ে শের-ই বাংলা নগরে রক্ষীবাহিনীকে প্রতিহত করার দায়িত্ব নেন মেজর ফারক নিজে। তবে ট্যাংকের মেশিনগানগুলোয় প্রচুর গুলি ভরা ছিল।
মেজর মহিউউদ্দিনের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণের ১২টি ট্রাকে সাড়ে তিনশ সাধারণ সৈনিককে তৈরি করা হয়। মেজর রশিদের সরাসরি কোনো আক্রমণের দায়িত্ব ছিল না। তার দায়িত্ব ছিল হত্যাকান্ড পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেয়া এবং সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সমন্বয় করা।
তার নেতৃত্বে থাকা ১৮টি কামান গোলা ভর্তি করে যুদ্ধাবস্থায় রাখা হয়। কামানগুলো রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়ার্টার এবং বঙ্গবন্ধুর বাসা লক্ষ করে তাক করে রাখা হয়। একটি মাত্র ১০৫ এমএম হাউইজার কামান রাখা হয় আর্টিলেটারির মেজর মহিউদ্দিনের অধীনে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির উল্টো দিকে লেকের পড়ে।
দায়িত্ব বুঝিয়ে সবাইকে তাজা বুলেট ইস্যু করা হয়। ঘাতকেরা বিমান বন্দর থেকে রাত ৪টার দিকে ধানমন্ডির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। ফারুকের নেতৃত্বে ২৮টি ট্যাংক বিমানবন্দর সড়ক হয়ে বনানী চেকপোস্ট দিয়ে যখন সেনানিবাসে প্রবেশ করে তখন ফজরের আজান পড়ে যায়।
ফারুক তার ট্যাংক নিয়ে সেনাবাহিনীর প্রধান সড়ক হয়ে একেবারে বিমানবন্দরে (পুরানো বিমানবন্দর) ঢুকে পড়ে। এ সময় দুটি ট্যাংক ফারুককে অনুসরণ করেছিল। বাকিগুলো জাহাঙ্গীর গেট হয়ে ফার্মগেটের দিকে এগুতে থাকে। ফারুক বিমানবন্দরের পশ্চিম পাশের দেয়াল ভেঙ্গে রক্ষিবাহিনীর হেডকোয়ার্টারের সামনে উপস্থিত হয়।
রাত সোয়া ৫টার দিকে মেজর ডালিম এবং রিসালদার মোসলেমউদ্দিনের নেতৃত্বে আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ মণির বাসা আক্রান্ত হয়।
শেখ মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণিকে হত্যা করা হয়। ডালিমের নেতৃত্বে ঘাতকেরা আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ১৪ বছরের মেয়ে বেবি, ১২ বছরের ছেলে আরিফ, চার বছরের নাতি বাবু, ভাতিজা শহীদ সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে আব্দুল নইম খান রিন্টু তিন অতিথি এবং আরো চার গৃহকর্মীকে হত্যা করে। এটিই ছিল ঘাতকদের প্রথম অপারেশন। এরপর বঙ্গবন্ধুর বাড়ি।
সূত্র : তিনটি সেনা অভ্যুত্থান এবং না বলা কিছু কথা : লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবঃ) আব্দুল হামিদ-পিএসসি
এএসএস/এআরএস