শিশুদের অনুপ্রেরণার প্রতীক শেখ রাসেল
১৮ অক্টোবর, শেখ রাসেলের জন্মদিন। ১৯৬৪ সালের এই দিনে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ঘর আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাঁচ সন্তানের মধ্যে ছোট ছিলেন শেখ রাসেল। তিনি যেদিন জন্মগ্রহণ করেন, সেদিন পিতা মুজিব নির্বাচনী প্রচারণায় চট্টগ্রামে ছিলেন। তারপর থেকে বেড়ে ওঠার সময়েও তিনি পিতাকে বেশি সময় কাছে পাননি। তখনকার উত্তাল সময়ে বঙ্গবন্ধুকে হয় জনসংযোগে বাইরে কিংবা জেলে যেতে হয়েছে।শেখ রাসেলের নামকরণেরও একটা ইতিহাস আছে। নোবেলজয়ী বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের দর্শনের অনুরাগী ছিলেন বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা। সেজন্যই আদরের ছোট ছেলের নাম লিখেছিলেন রাসেল।
শেখ রাসেল শৈশবে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে বেড়ে উঠেছেন। বাঙালি জাতির রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাড়িটি। আর বাবা ছিলেন সেই রাজনীতির নায়ক। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা,’৬৮-তে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা,’৬৯-এ গণঅভ্যুত্থান ও বঙ্গবন্ধুর কারামুক্তি,’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয় এবং ’৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় সবকিছুই এই বাড়িতে বসে প্রত্যক্ষ করেছিলেন শেখ রাসেল।পিতা মুজিবকে কারাগারে থাকতেও যেমন দেখেছেন,ঠিক তেমনি জনতার মহানায়ক হিসেবেও দেখেছেন।শৈশবের স্মৃতি গুলো তার চরিত্রের মানসপটে প্রভাব ফেলেছে।
শেখ রাসেলের বড় আপা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা' বইতে লিখেছেন,‘রাসেল আব্বাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করত। আব্বাকে মোটেও ছাড়তে চাইত না। যেখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব আব্বা ওকে নিয়ে যেতেন।মা ওর জন্য প্রিন্স স্যুট বানিয়ে দিয়েছিলেন।কারণ আব্বা প্রিন্স স্যুট যেদিন পরতেন সেদিন রাসেলও পরত। কাপড়-চোপড়ের ব্যাপারে ছোটবেলা থেকেই তার নিজের পছন্দ ছিল। তবে একবার একটা জিনিস পছন্দ হলে তা আর ছাড়তে চাইত না। ওর নিজের একটা আলাদা ব্যক্তিত্ব ছিল। নিজের পছন্দের ওপর খুব আস্তা ছিল। খুব স্বাধীন মত নিয়ে চলতে চাইত। ছোট মানুষটার চরিত্রের দৃঢ়তা দেখে অবাক হতে হতো।বড় হলে সে যে বিশেষ একটা মানুষ হবে তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না।'
বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা শেখ রেহানা তাঁর ছোট ভাই সম্পর্কে বলেছেন, ‘শেখ রাসেল আমাদের ভালোবাসা। আব্বার সঙ্গে আমার ও রাসেলের জাপান,মস্কো ও লন্ডন বেড়ানোর সুযোগ হয়। রাষ্ট্রীয় সফর বলেই রাসেল বিদেশিদের সাথে সৌজন্যমূলক ব্যবহার করত। সে ছোট্ট হলেও বুঝতে পারত কোথায় কিভাবে চলতে শিখতে হবে। ঢাকায় ফিরে আমি যখন মা ও সবার কাছে ওর এই সুন্দর ব্যবহারের গল্প করেছি তখন মুগ্ধ হয়ে শুনেছে।
লন্ডনের বিখ্যাত মাদাম তুসো'র মিউজিয়ামে আমরা যখন বেড়াতে যাই রাসেলের বিস্ময় আর কাটে না। আমরা দুইজন আব্বার সাথে নাটোরের উত্তরা গণভবনেও গিয়েছি। রাসেল সেখানে মাছ ধরত,আমরা বাগানে ঘুরে বেড়াতাম। ঢাকার গণভবনেও রাসেল মাছদের খাবার খাওয়াত। ফুফাতো ভাই আরিফ তার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। তারা দুইজন একই স্কুলে পড়ত এবং একসঙ্গে খেলত। টুঙ্গিপাড়ায় তাদের একটা খুদে বাহিনী ছিল,যাদের সঙ্গে খালের পানিতে সাঁতার কাটা,ফুটবল খেলায় মেতে থাকত তারা।'
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘কারাগারের রোজনামচায়’ আদরের ছোট ছেলে শেখ রাসেল নিয়ে অনেক স্মৃতিচারণ করেছেন। ১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু মুজিবের ৪৭ তম জন্মবার্ষিকীতে পরিবারের সদস্যরা জেলগেটে সাক্ষাৎ করেন। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন- পাঁচটা বেজে গেলো। ঠিক সেই মুহূর্তে জমাদার সাহেব বললেন,‘আপনার বেগম সাহেবা ও ছেলেমেয়েরা এসেছে। তাড়াতাড়ি কাপড় পরে রওনা হলাম জেলগেটের দিকে। ছোট মেয়েটা আর আড়াই বৎসরের ছেলে রাসেল ফুলের মালা হাতে দাঁড়াইয়া আছে। মালাটা রাসেলকে পরাইয়া দিলাম,নে কিছুতেই পরবে না, আমার গলায় দিয়ে দিলো।---আওয়ামী লীগ একটা বিরাট কেক পাঠাইয়া দিয়েছে। রাসেলকে দিয়ে কাটালাম, আমিও হাত দিলাম।“--- দুই বছরের ছেলেটা এসে বলে, ‘আব্বা বালি চলো।' কী উত্তর ওকে আমি দেবো।
ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম,তোমার মা'র বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো। ও কি বুঝতে চায়!কী করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগে গেলো।শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা তো বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখে নাই। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।”
বঙ্গবন্ধু আরেকটি জায়গায় লিখেছেন,“জেল গেটে যখন উপস্থিত হলাম,বাইরে এসে ছোট ছেলেটা দাঁড়াইয়া নাই দেখে আশ্চর্য হলাম।আমি যখন রুমের ভেতর যেয়ে ওকে কোলে নিলাম,আমার গলা ধরে ‘আব্বা' ‘আব্বা’ করে কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে যেয়ে ‘আব্বা' ‘আব্বা’ করে ডাকতে শুরু করলো।ওর মাকে ‘আব্বা' বলে।আমি কারণ জিজ্ঞাসা করলাম,ব্যাপার কী? ওর মা বললো বাড়িতে ‘আব্বা' ‘আব্বা’ করে কাঁদে তাই ওকে বলেছি আমাকে আব্বা বলে ডাকতে।আমার উপর অভিমান অভিমান করেছে বলে মনে হয়। এখন আর বিদায়ের সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায় না।”
যুগে যুগে ইতিহাসে অনেক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। কিন্তু ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের মতো এত নির্মম পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড আর কোথাও ঘটেনি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু,বঙ্গমাতা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন শিশু রাসেল। হত্যাকাণ্ডের সময় শিশু রাসেল আতঙ্কিত হয়ে মায়ের কাছে যেতে চেয়েছিলেন। মায়ের মৃতদেহ দেখার পর কান্নাজড়িত কন্ঠে আকুতি জানিয়েছিল,‘আমাকে হাসু আপার কাছে পাঠিয়ে দাও।’পাষন্ড নরপশুরা বাবা-মা, দুই ভাই, ভাইদের স্ত্রী, চাচাসহ পরিবারের সকল সদস্যদের মৃতদেহ দেখিয়ে সবশেষে রাসেলকে হত্যা করে। সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়ে রাসেলকেই হত্যা করেছিল। ঘাতকরা বুঝেছিল এই ছোট্ট শিশু যদি বেঁচে থাকে তাহলে সেও একদিন বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পতাকা তুলে ধরবে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা জার্মানি যাওয়ার সময় রাসেলকেও সাথে করে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ তার জন্ডিস হওয়ায় শরীর খারাপ হয়ে পড়ে। সেকারণে বঙ্গমাতা তাকে যেতে দেয়নি। সেদিন যদি রাসেল তার বড় আপার সাথে চলে যেতেন তাহলে হয়তো তাকে আর আমাদের হারাতে হতো না। তিনি মাত্র ১০ বছর ৯ মাস ২৭ দিনের বেঁচেছিলেন। এই স্বল্প সময়ের কর্মের মধ্যদিয়ে তিনি শিশুদের কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে আছেন।
শেখ রাসেলের প্রতিটি শিরায় বহমান ছিল বঙ্গবন্ধুর রক্ত। সেজন্যই তার আচরণ, ব্যক্তিত্ব, মানবতা এবং মমত্ববোধ অন্যান্য শিশুদের সহজেই আকৃষ্ট করতো। বন্ধুদের যেকোনো সমস্যায় এগিয়ে আসতেন। নিজের খাবার, বই, খেলাধুলার সামগ্রী বন্ধুদের দিয়ে দিতেন। তার মানবিকতা সবসময়ই শিশুদের কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। শুভ জন্মদিন শহীদ শেখ রাসেল। স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য,সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
haldertapas80@gmail
এইচআর/এএসএম