পোশাকশিল্পের অস্থিরতা

অনন্ত জলিল ও প্রেস সচিবের বিতর্ক, কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪:৫২ পিএম, ২৪ মার্চ ২০২৫

মাসুদ কবির

সম্প্রতি এজে গ্রুপের কর্ণধার অনন্ত জলিল এক সংবাদ সম্মেলনে পোশাকশিল্পের অস্থিরতা, অব্যবস্থাপনা এবং তার প্রতিকার চেয়ে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা বরাবর কিছু দাবি তুলে ধরেন, যা দেশের জাতীয় মিডিয়া গুরুত্ব সহকারে কভার করে। তার প্রতিক্রিয়ায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তাৎক্ষণিক তার ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, যা অনেকটা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পাল্টা জবাব দেওয়ার মতো।

বিজ্ঞাপন

পোশাক শিল্পের একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে প্রেস সচিবের বক্তব্যের প্রতি-উত্তর ও কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর জানা প্রয়োজন মনে করছি, যা এই শিল্পের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট-

জনাব প্রেস সচিবের নিকট প্রশ্ন?

১. জনাব অনন্ত জলিল বলেছেন গত ৭ মাসে প্রায় ২৪০টি পোশাকশিল্প কারখানা বন্ধ হয়েছে। ধরে নিলাম, তিনি সঠিক তথ্য দিতে পারেননি, যা প্রেস সচিব ‘মিথ্যা’ বলে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন কিন্তু সচিব মহোদয়ের কাছে কি তথ্য আছে আগস্টের পর কতটি ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়েছে? সেখানে যদি একটি ফ্যাক্টরিও বন্ধ হয়ে থাকে সেটা তো তদন্ত করে দেখা উচিত কী কারণে এবং কার দায়ে এমনটি হয়েছে? নাকি আপনার তথ্যমতে কোনো ফ্যাক্টরি গত ৭ মাসে বন্ধ হয়নি!

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

উল্লেখ্য, গত কয়েক মাস দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে গার্মেন্টস শিল্প কারখানা বন্ধের নিয়মিত রিপোর্ট প্রচার করা হয়েছে তার মধ্যে গত ৫ মার্চ দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়, তিন শিল্প এলাকায় সাত মাসে বন্ধ ৯৫ কারখানা। প্রথম আলোর এই রিপোর্টে উল্লেখ আছে অস্থায়ীভাবে ও অনেক কারখানা বন্ধ!

এখন স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে মোট কতটি কারখানা বন্ধ হয়েছে সে রিপোর্ট আশা করি সরকার ও জনাব প্রেস সচিব দ্রুত জাতিকে জানাবেন।

২। জনাব সচিব বলেছেন, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ৮৪ শতাংশ এক্সপোর্ট করে, এটা রেমিট্যান্সের হার না, ঠিক আছে। তাহলে এখানে রেমিট্যান্সের হার কত শতাংশ? আর ফ্যাক্টরিগুলোতে কত শতাংশ কর্মসংস্থান হচ্ছে? বেকার সমস্যা দূর করা, জনশক্তির দক্ষতা বৃদ্ধি ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে পোশাক শিল্পের কন্ট্রিবিউশন জাতীয় অর্থনীতিতে কত ভাগ, তা আমরা জানতে চাই। রপ্তানির হার এবং তার বিপরীতে নানা প্রতিকূলতার হার বিবেচনা করে একটি তুলনামূলক তথ্য চিত্র দাড় করানোর পর এই শিল্প নিয়ে আপনি তাচ্ছিল্য দেখাতে পারেন। তার পূর্বে করলে সরকারের পক্ষ থেকে ভুল বার্তা পৌঁছাবে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

৩. ১১ শতাংশ রপ্তানি বৃদ্ধির ক্রেডিট আপনি কিভাবে কোন ডাটার ভিত্তিতে নিচ্ছেন? এখানে রপ্তানি টার্গেট কী ছিলো? সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে নাকি ব্যাহত হয়েছে? সেখানে পূর্বের কোনো ব্যাক লগ ছিলো কিনা? আর এই রপ্তানি বৃদ্ধির কত শতাংশ আমাদের সামষ্টিক আয়? উৎপাদন ব্যয় ও দায় বৃদ্ধি করে রপ্তানি বাড়লেও কি সেটা সঠিক? যথাযথ পরিসংখ্যান ও তথ্য-উপাত্ত ছাড়া মোটা দাগে ক্রেডিট নিতে গেলে তো বিপদ। আমার জানা মতে, জুলাই-সেপ্টেম্বরের অভ্যুত্থান ও পরবর্তীতে শ্রমিক অসন্তোষের ফলে অনেক অর্ডার জমা পড়েছিলো যা পরবর্তীতে শুধু কাস্টমার ধরে রাখার জন্য এয়ার/ডিসকাউন্ট দিয়ে পণ্য রপ্তানি করা হয় যা এই বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। কিন্তু এই রপ্তানিতে কারখানার কতটুকু লোকসান দিয়ে টিকে থাকলো বা ব্যাংক/সরকার তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসছে কিনা! সেই তথ্য কি আপনার কাছে আছে? জনাব সচিব আপনি নিশ্চয়ই জানেন পতিত ফ্যাসিস্ট সর্বক্ষেত্রে উন্নয়নের ক্রেডিট নিতে গিয়ে গোটা অর্থনীতিকে ফোকলা করে রসাতলে ডুবিয়েছে, সেই খাদের কিনারায় যেন আবার কেউ না পড়ে।

৪. গাজীপুর, আশুলিয়ায় ৯৯ শতাংশ ফ্যাক্টরি ওপেন এটা খুবই আশার কথা এবং প্রশংসনীয় উদ্যোগ। শিল্প রক্ষার স্বার্থে এই ধারা যেন অব্যাহত থাকে, আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা যেন বিরাজমান থাকে। পাশাপাশি এই তথ্যটি জানা দরকার, এ সব এলাকায় মোট কারখানার সংখ্যা কতটি? ৯৯ শতাংশের তালিকায় কোন ক্যাটাগরির ফ্যাক্টরিকে বিবেচনা করা হয়েছে? কারণ এই শিল্পে ছোট-মাঝারি-বড় সাইজের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্যাটাগরির অনেক সহযোগী ফ্যাক্টরি আছে। তাই নির্দিষ্ট শতাংশ বলার আগে সব হিসাব বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন নয় কি?

প্রেস সচিবের নিকট নিম্নের ডাটা/তথ্য প্রকাশের দাবি জানাই -

১। বিশ্বব্যাংকের জরিপ মতে, ইজ অব ডুইং বিজনেস ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৬৮। সেই অবস্থা থেকে গত ৭ মাসে কতধাপ এগিয়েছে? এবং কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে?

২। ব্যাংক ঋণ হার আমাদের উৎপাদন প্রতিযোগী দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কতভাগ বেশি? এই হার বজায় রেখে শিল্প বিপ্লব বা শিল্পের বিকাশ অনুপ্রাণিত হবে নাকি ক্ষতিগ্রস্ত হবে? বা সুদ হার কমানোর কার্যকর কি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে?

বিজ্ঞাপন

৩। বিদ্যুৎ-জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ ও মূল্যের ভিত্তিতে শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের কতভাগ বেশি দিতে হয়? লোড শেডিংয়ের ফলে যে লোকসান হয় তার দায় কেন শুধু উদ্যোক্তাদের বহন করতে হবে?

৪। ব্যাংক, কাস্টমস, বন্ড, পোর্টে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য ও নীতি নির্ধারণী সময়ক্ষেপণে শিল্প কারখানা কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে? মোট জিডিপি লক্ষ্য পূরণে এই ঘাটতির কত শতাংশ? এ থেকে পরিত্রাণের সুনির্দিষ্ট কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে?

৫। শ্রমিক সংগঠন নামে যে সব নামধারী সংগঠনকে বিদেশি মদদে এ শিল্পকে অস্থির ও ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং দিনশেষে দেশের শিল্প ও উদ্যোক্তারা খেলাপি হচ্ছে তার প্রতিকারে সরকার কী উদ্যোগ বা ব্যবস্থা নিতে পেরেছে?

বিজ্ঞাপন

৬। আগস্টে বিপ্লব এবং বিপ্লব পরবর্তী নাশকতা, শ্রমিক অসন্তোষের কারণে শিল্প মালিকগণ বিপুল মাধ্যমে ত্যাগ-কুরবানি করেছে, এর বিনিময়ে শিল্প রক্ষায় সরকার কি সিগনিফিকেন্ট উদ্যোগ বা ভূমিকা রেখেছে তা সবিনয়ে জানতে চাই। আন্দোলনে শহীদ, পঙ্গু-আহতদের মতো এই শিল্পে আর্থিকভাবে যারা পঙ্গু-আহত তাদের রক্ষায় কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে? উপরন্তু, এয়ার/ডিসকাউন্ট/ক্রয়াদেশ বাতিলের ক্ষতি সব শিল্প মালিকদের ফোর্স লোন করতে বাধ্য করে দেশের অর্থনীতি আরো ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা হয়েছে। এটা কি স্রেফ অজ্ঞতা নাকি অদৃশ্য কোনো অপশক্তির যোগসাজশে হয়েছে? আর এ বিষয়ে কতটুকু অ্যানালাইসিস বা ডাটা আপনার কাছে আছে?

৭। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ভ্যালু এবং সারা বিশ্বে তার পরিচিতি কাজে লাগিয়ে ফেয়ার অ্যান্ড ইথিক্যাল বায়িং প্রাইস নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ক্রেতাদের চাপ দেয়া, আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তথ্য উপস্থাপন করে ক্রেতাদের দ্বিচারিতা তুলে ধরে জনাব তথ্য সচিব এ দেশের সর্ববৃহৎ শিল্প ও রপ্তানি খাতকে আরো সুসংহত এবং সিকিউর করতে পারতেন। বরং আমরা নিকট অতীতে দেখেছি আপনার নানা অমূলক মন্তব্য শিল্প মালিক-শ্রমিক বিরোধে রসদ জুগিয়েছে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কাছে এই শিল্প ও উদ্যোক্তারা সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছে। আমরা জানতে চাই, এই বুনো উল্লাস ও শিল্পকে দেশের শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের কাছে ব্র্যান্ড ইমেজ ক্ষুন্ন করলে কে বা কারা বেনিফিশিয়ারি হয়? তা কি কখনো ভেবে দেখেছেন?

অর্থনৈতিক ঝুঁকি, অনিশ্চয়তা ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে একজন উদ্যোক্তা তার প্রতিকার চেয়ে রাষ্ট্রের প্রধান অভিভাবকের কাছে অভিযোগ করতেই পারেন এবং তা আমলে নিয়ে অধিকতর মূল্যায়ন বা পর্যবেক্ষণও করতে পারেন কিন্তু কোনোরূপ তথ্য যাচাই-বাছাই না করে সরাসরি 'মিথ্যা' বলে খারিজ করে দেয়া স্বৈরাচারী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ, যা প্রকারান্তরে দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারী ও সুযোগ সন্ধানীদের ষড়যন্ত্রের পথ উন্মুক্ত করে দিবে। তেমনটি হলে দেশের সর্ববৃহৎ শিল্পখাতই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, বরং ৪৫ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ নিরাপত্তাহীনতা এবং মৌলিক চাহিদা পূরণের সংকটে পড়বে। সু-নাগরিক হিসেবে আমাদের সবার দায়িত্ব সঠিক সমস্যাকে চিহ্নিত করে তার জন্য যথাযথ পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেয়া।

বিজ্ঞাপন

চার দশকের অধিক এই শিল্পের জন্য দ্রুত সংস্কার কমিশন করে একটি টেকসই প্রস্তাবনা ও গাইড লাইন তৈরি হোক, আর চাই আলাদা মন্ত্রণালয়/অভিভাবক যার মাধ্যমে এ শিল্প বিশ্ব দরবারে তার অবস্থান মজবুত করবে, দেশের অর্থনীতি ও শ্রমিকদের নিরাপত্তায় অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।

লেখক: মাসুদ কবির, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মোটেক্স ফ্যাশন, mk@motex-dk.com

এমএমএআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।