সিজিএসের প্রতিবেদন

৫ বছরে বিলুপ্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অভিযুক্ত সাংবাদিক ৪৫১

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০২:৪৪ পিএম, ৩০ এপ্রিল ২০২৪

বিলুপ্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) অধীনে গত পাঁচ বছরে শুধু প্রতিবেদনের জন্য ২৫৫ জন সাংবাদিক অভিযুক্ত হয়েছে। অন্যান্য কারণে ১৮২ জন, আর ১৪ জনের মামলার কারণ জানা যায়নি। সব মিলে অভিযুক্ত সাংবাদিকের সংখ্যা ৪৫১ জন।

বুধবার (৩০ এপ্রিল) সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ৫ বছর: ২০১৮-২০২৩’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এই প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। গবেষণা দলের প্রধান যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক আলী রীয়াজ গবেষণাটি তুলে ধরেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সময়ে ফেসবুকে পোস্ট বা মন্তব্য করার জন্য ৯০৮টি মামলা হয়েছে। এতে অভিযুক্ত করা হয়েছে ২ হাজার ৩২৮ জনকে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের জন্য মামলা হয় ১২৯টি, এতে অভিযুক্ত করা হয় ১৯৮ জনকে।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, গত ৭ আগস্ট ২০২৩ সরকার ঘোষণা দেয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি (ডিএসএ) এখন থেকে সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ) নামে নতুন একটি আইন দিয়ে প্রতিস্থাপিত হবে। তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে দায়ের করা মামলাগুলো অব্যাহত থাকবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে দায়ের করা মামলার সংখ্যা ৭ হাজার ১টি। প্রতিটি মামলায় গড় আসামি এই ৩ দশমিক ১২ জন। আইনমন্ত্রীর উল্লেখ করা মামলার সংখ্যা গড় করলে সর্বমোট আসামির সংখ্যা অন্তত ২১ হাজার ৮৬৭ জন। প্রতিটি মামলায় গড়ে ১ দশমিক ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যার মোট হিসাব দাঁড়ায় কমপক্ষে ৭৫৪২ জন, যারা আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে।

সিজিএসের প্রতিবেদন বলছে, সংস্থাটির তালিকায় শনাক্তকারী পেশা অনুযায়ী মোট অভিযুক্ত ১৫৩৪ জন। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে রাজনীতিবিদ ৪৯৫ জন, সাংবাদিক ৪৫১ জন, শিক্ষার্থী ১৩৮ জন, ব্যবসায়ী ১০৮ জন এবং শিক্ষক ৫৯ জন। আর পেশা অনুযায়ী মোট গ্রেফতার ৫৭২ জন। এর মধ্যে রাজনীতিবীদ ১৪৩ জন, সাংবাদিক ৯৭ জন, শিক্ষার্থী ১০৪ জন, বেসরকারি চাকরিজীবী ৫২ জন, শিক্ষক ৪২ জন (মাদরাসার শিক্ষক ১৭)।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিযোগকারী ৮৫৯ জনের পেশা আমরা শনাক্ত করতে পেরেছি। এর মধ্যে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্য ১৮৯ জন, রাজনীতিবীদ ৩৩৮ জন (আওয়ামী লীগের ২৬৩ জন যা মোট অভিযোগকারীর ৭৭ দশমিক ৮১ শতাংশ)। গত পাঁচ বছরে প্রতি সপ্তাহে আওয়ামী লীগের দায়ের করা ১টি মামলার বিপরীতে আসামি রয়েছে ৩ জনের বেশি ব্যক্তি।

সামগ্রিক চিত্র বিশ্লেষণ করে বলা হয়, এই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর মানহানির জন্য মামলা হয়েছে ১৯০টি। যার মধ্যে অভিযুক্তের সংখ্যা ৪৬৪ জন। গ্রেফতার হয়েছে ১৬১ জন। এর মধ্যে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী করেছে ৩১টি মামলা। বাকি ১৫৯ মামলা প্রধানমন্ত্রীর সমর্থকরা দায়ের করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর মানহানির জন্য বছরভিত্তিক মোট মামলার বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে ১টি, ২০১৯ সালে ১৪টি, ২০২০ সালে ৬০টি, ২০২১ সালে ৬৪টি, ২০২২ সালে ৩৮টি, ২০২৩ সালে ১৩টি মামলা হয়েছে।

এ সময় মন্ত্রীদের মানহানির জন্য দায়ের করা মামলার সংখ্যা ৮০টি। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী করেছেন ৮টি, মন্ত্রীরা করেছেন ৬টি, মন্ত্রীদের সমর্থনকারীরা করেছেন অবশিষ্ট ৬৬টি মামলা। এসব মামলায় মোট অভিযুক্তের সংখ্যা ৩৩৭ জন আর গ্রেফতার হয়েছেন ৬৮ জন। আর রাজনীতিবীদদের মানহানির দায়ে দায়ের করা মামলার সংখ্যা ২১২টি। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী করেছেন ৭টি, রাজনীতিবীদরা করেছেন ৯৩টি, রাজনীতিবীদদের সমর্থনকারীরা করেছেন অবশিষ্ট ১১২টি মামলা। এসব মামলায় মোট অভিযুক্তের সংখ্যা ৭৩৯ জন আর গ্রেফতার হয়েছেন ১৩৬ জন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপরাধ ও শাস্তিযোগ্য ২২টি ধারার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে ২৫, ২৯, ৩১ ও ৩৫ ধারা। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ২৫ ধারায় মামলা ২৬৯টি, মোট অভিযুক্ত ৯০৫ জন। গ্রেফতার ১৮৫ জন। ২৯ ধারায় মামলা ২৬৭টি, মোট অভিযুক্ত ৮৮৮ জন, গ্রেফতার ১৫১ জন ৩১ ধারায় মামলা ১৬৭টি, মোট অভিযুক্ত ৫৩৯ জন, গ্রেফতার ১৩০ জন। ৩৫ ধারায় মামলা ১৭৩টি, মোট অভিযুক্ত ৯৬১ জন এবং গ্রেফতার ১৯৭ জন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব মামলার সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, স্বচ্ছতার অভাব, বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রিতা, বিচারপূর্ব বন্দি বা আটক, শিশু-কিশোরদের আইনের আওতায় আনা এবং আইনের স্বেচ্ছাচারী ব্যবহার।

প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশমালাও তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলো-

১। (ক) অন্য কোনো আইনের আওতায় (গুরুতর প্রকৃতির এবং জামিন অযোগ্য) দোষী সাব্যস্ত বা অভিযুক্ত না হলে, শুধু ডিএসএ-এর অধীনে অভিযুক্ত এবং আটক ব্যক্তিদের জামিন মঞ্জুর করা। (খ) সংশ্লিষ্ট আইনের অধীনে প্রদত্ত সমস্ত অধিকার, সুযোগ-সুবিধা এবং যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে এই ধরনের যে কোনো ব্যক্তির বিচার করা।

২। সাংবাদিক সম্প্রদায়, মানবাধিকার সংস্থা, আইনজীবী এবং সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের সদস্যদের নিয়ে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন যেন ওএইচসিএইচআর এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার পর্যবেক্ষকদের অংশগ্রহণ থাকবে এবং ওই কমিশনের দায়িত্ব হবে নিম্নলিখিত কাজগুলো সম্পাদন করা।

(ক) অক্টোবর ২০১৮ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২৩ এর মধ্যে ডিএসএ-এর অধীনে দায়ের করা প্রতিটি মামলার নথি পরীক্ষা।

(খ) ডিএসএ-এর অধীনে দায়ের করা মামলার সংখ্যা, অভিযুক্ত, গ্রেপ্তার, আটক আসামির সংখ্যা এবং কতজন আসামির জামিন আবেদন আদালত থেকে নাকচ করা হয়েছে তা-সহ এই মামলাগুলোর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে সরকারিভাবে বিবৃতি দেওয়া।

(গ) তদন্ত এবং আদালতে মামলার প্রতিবেদন দাখিল করার ক্ষেত্রে পুলিশ সমস্ত আইনি প্রক্রিয়া এবং নিয়ম মেনে চলে কি না তা পরীক্ষা। (ঘ) বিচার-পূর্ব বন্দিদের হয়রানি ও ভোগান্তি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন তৈরি। (ঙ) যেসব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সেখানে ডিএসএ-এর শিকার ব্যক্তিরা, বিশেষ করে যারা বেআইনিভাবে আটক তারা যেনো ক্ষতিপূরণ পান সে সুপারিশ করা।

এনএস/এমআরএম/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।