মানুষের আনন্দের মধ্যেই নিজেদের আনন্দ খুঁজে পান গণমাধ্যমকর্মীরা
আনন্দ-উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে সারাদেশে উদযাপিত হচ্ছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। সেমাই, ফিরনি, পায়েস খেয়ে ঈদগাহে যাওয়ার দৃশ্য অনিন্দ্য সুন্দর। নামাজ শেষে ঈদগাহে কোলাকুলি, সালামি বিনিময়, বন্ধুবান্ধব-প্রিয়জনদের নিয়ে ঘুর বেড়ানোসহ নানান আনন্দের উপলক্ষ দিবসটিকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে। দেশের মানুষ যখন নানান কর্মসূচিতে ঈদ উদযাপনে ব্যস্ত, তখন সেসব আনুষ্ঠানিকতা ও আনন্দঘন সময় ধারণ করতে ব্যস্ত থাকেন দেশের গণমাধ্যমকর্মীরা। মানুষের ঈদ-আনন্দের খবর তুলে ধরতে তারা ছুটে চলেন খবরের সন্ধানে। এসবের মধ্যেই খুঁজে নেন নিজেদের ঈদ-আনন্দ।
কীভাবে ঈদ কাটে খবরের সন্ধানে ছুটে চলা এসব গণকর্মীদের, আত্মীয়-স্বজনকে কখন সময় দেন, ঈদ নিয়ে খবর সন্ধানীদের অনুভূতি জানতে কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীর সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের।
গণমাধ্যমকর্মীরা বলছেন, পরিবার ছেড়ে কর্মক্ষেত্রে বা কাজের মধ্যে ঈদ উদযাপন তাদের কাছে কিছুটা খারাপ লাগে। কিন্তু যেহেতু এই পেশা বেছে নিয়েছেন, তাই মেনে নিয়েছেন। কাজের মধ্যে ব্যস্ত থেকে এবং সহকর্মীদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে পরিবার থেকে দূরে থাকাটা ভুলে থাকার চেষ্টা করেন।
আরও পড়ুন
- সবার সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করুন: প্রধানমন্ত্রী
- আর দশটা দিনের মতোই গণসংযোগে কাটে রাজনীতিবিদদের ঈদ
এ নিয়ে এনটিভির বিশেষ প্রতিনিধি সফিক শাহীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘পেশাগত দায়িত্ব পালনের মধ্যেও ঈদের অফুরান আনন্দ খুঁজি। সংবাদমাধ্যম যেহেতু জরুরি সেবার মর্যাদা অর্জন করেছে, সেহেতু সেবা দিয়েই গণমাধ্যম কর্মীদের যুগের পর যুগ সেই বিশ্বাস ধরে রাখতে হয়। ফায়ার সার্ভিস, চিকিৎসা ও নিরাপত্তার মতো জনসেবামূলক কাজের মতোই গণমাধ্যমও তথ্যসেবা দিয়ে মানুষের তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত করে।’
তিনি বলেন, ‘‘নিয়ম করে কখনো কখনো সরকারি ছুটির সঙ্গে মিলিয়ে পত্রিকা বন্ধ রাখা হয়। ঈদের পরের কর্মদিবসে কয়েক দিনের গুরুত্বপূর্ণ খবর ছাপানো হয়। তবে গণমাধ্যম হিসেবে টেলিভিশন চ্যানেল যেহেতু ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে, দর্শকরা দেখতে চান, তাই টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ রাখার কোনো সুযোগ নেই। তাই দর্শকের আগ্রহ এবং সংবাদ সংগ্রহ অব্যাহত রাখতে গণমাধ্যমকর্মীদের ছুটতে হয় মাঠে-ঘাটে খবরের পেছনে। দুর্যোগ-দুর্বিপাক ছাড়াও ঈদ-পূজায় যখনই কেউ আমাদের মাইক্রোফোন হাতে ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে দেখেন তখন অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন ‘আজকেও আপনাদের ছুটি নেই!’ তখন মুচকি হেসে জানতে চাই, ‘আজ কি আপনি টেলিভিশন চ্যানেল দেখা বন্ধ রাখবেন, খবর জানবেন না?’’
আরও পড়ুন
- ‘ছুটির দরখাস্ত করে টিকিট কেটে ব্যাগও গোছাই, কিন্তু ছুটি পাইনি’
- ঈদযাত্রা আরামদায়ক করতে যা করছে ট্রাফিক বিভাগ
সফিক শাহীন বলেন, ‘টেলিভিশন চ্যানেল চলে সাধারণত তিন শিফটে। অর্থাৎ রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা কাজ করেন গণমাধ্যমকর্মীরা। তবে দুই ঈদে ভাগ করে ডিউটি করেন তারা। ঈদুল ফিতরে যিনি ডিউটিতে থাকেন তিনি কোরবানির ঈদে ছুটি কাটাবেন। আবার যিনি ঈদুল ফিতরে ছুটি কাটাচ্ছেন তিনি কোরবানির ঈদে ডিউটি করবেন। এমন করে কাজ ও ছুটি ভাগাভাগি করে দায়িত্ব পালন করেন টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক, প্রযোজক, চিত্রসাংবাদিক ও অন্যান্য বিভাগের কর্মীরা। গণমাধ্যম কর্মীদের পরিবার সদস্যরাও জানেন এই ঈদে ছুটি পেলে সামনের ঈদে ডিউটি করতে হবে। তারাও মানিয়ে নিয়েছেন।’
‘ঈদ কিংবা বিশেষ দিনে কাজ করতে গেলে নিজের দুঃখ ভুলে যান একজন গণমাধ্যমকর্মী। কারণ যখন দেখেন তার সামনেই দায়িত্ব পালন করছেন ট্রাফিক পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবার কর্মীরা, গণপরিবহনের কর্মী এবং রিকশাচালকও দায়িত্ব পালন করছেন। আনন্দের দিনে যখন মানুষ টেলিভিশন চ্যানেলের খবর দেখেন, অনুষ্ঠান দেখে আনন্দ পান, তখন আমাদের গণমাধ্যম কর্মীদের ভেতর এক ধরনের তৃপ্তি কাজ করে। আমাদের প্রিয়জন হয়ে ওঠেন তারা, যারা নিজেদের সময় ও অর্থ খরচ করে আমাদের সংবাদ দেখেন।’ যোগ করেন তিনি।
একাত্তর টিভির বিশেষ প্রতিনিধি শাহনাজ শারমিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে খারাপ লাগতো। এখন আর এতটা খারাপ লাগার কোনো বিষয় মনে হয় না। এখন বরং আমাদের পেশার মতো অন্য যারা কাজ করছেন ঈদের দিনে, তাদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবি তাদের কেমন লাগছে? পরিবারও এখন কিছুটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে, এক ঈদে অফিস করবো। সহকর্মীদের সঙ্গেও দারুণ একটা সময় কাটে। দুই মেয়ের জন্য মন খারাপ হয়। কিন্তু জানি তথ্যসেবা দিতে নেমেছি, তাই বিরতি দেওয়া সম্ভব নয়। চলমান কাজের গতি অব্যাহত রাখতে হবে, তাই ঈদও কর্মময়।’
ডিবিসি নিউজের রিপোর্টার ফারাহানা যুথি, ‘ঈদের দিন আনন্দের দিন, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর দিন। যেহেতু আমি সংবাদকর্মী, একটি নির্দিষ্ট বিটে কাজ করি, তাই আমার পেশাগত দায়িত্ব পালন গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সে কারণে একটু আগে থেকে ঈদের দিন এবং পরবর্তী কয়েক দিনের কর্মসূচি গুছিয়ে নিয়েছি, অফিসের অ্যাসাইনমেন্টের পর পরিবারকে কখন সময় দেবো, কী কী করবো।’
আরও পড়ুন
তিনি বলেন, ‘ঈদের দিন অফিস এবং অ্যাসাইনমেন্টে একটা আলাদা পরিবেশ থাকে, যেটি মন ভালো করে দেয়। কাজেও প্রেরণা জোগায়। পরিবার থেকে দূরে সেই ব্যাপারটি মনে থাকে না কাজের চাপে। এতে করে আরও একটি সুবিধা আছে, যেহেতু আমি শ্বশুরবাড়ি থাকি, মায়ের বাড়িতে কবে যাবো, কবে সুযোগ হবে, ঈদের দিন কোথায় থাকবো, একটি দ্বিধা থাকে। অ্যাসাইনমেন্ট থাকায় বিষয়টি কারও মাথায় আসে না। পরে ছুটিগুলো কাজে লাগে। আর যানজটের নগরী ঢাকার শান্ত পরিচ্ছন্ন বিষয়টি খুব উপভোগ করার সুযোগ হয় এই ঈদের সময়ে। পরিবেশ দূষণ নেই বললেই চলে। তাই ঈদের দিন কর্মময় একটি উপভোগ করার দিন, সবাইকে ঈদ মোবারক।’
অনলাইন নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জসিম উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঈদে ডিউটি করতে ইচ্ছে করে না। বাড়ি যেতে মন চায়। কিন্তু চাইলেই তো হয় না, গণমাধ্যমের কালচারই এটা। তবে কাজের ভিড়ে থাকি, যাতে মন খারাপ না হয়। পরিবারকে সময় দেওয়ারও চেষ্টা করি, অফিস মেইনটেইন করে।’
আরও পড়ুন
তিনি বলেন, ‘সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেদের সাইট ও অন্য পোর্টাল দেখেছি। কিছু ঘটলো কি না। এরপর গোসল। সহধর্মিণীর হাতে তৈরি, সেমাই পুডিং খেয়ে মেয়েকে নিয়ে মসজিদে নামাজ। এরপর বাসায় ফেরা। মেয়েকে নামিয়ে দিয়ে শুরু নিউজের কাজ। বৃদ্ধাশ্রম, ফাঁকা ঢাকা, পুলিশের ঈদ আর নানান নিউজের ভিড়েই নিজের ঈদ-আনন্দ। কাজ শেষে সময় মিললে মেয়েকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার চিন্তা আছে। সেটা আবার নির্ভর করছে পরিস্থিতির ওপরে। এভাবেই তো কেটে যায় আমাদের ঈদ।’
দৈনিক বণিক বার্তার রিপোর্টার শেখ তৌফিকুর রহমান বলেন, ‘ঈদের দিনের একটা বড় অংশই অফিসে কাটছে। অফিস শেষ করে বাসায় ফিরে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাবো। আমার কাছে মনে হয় ঈদের মূল আনন্দ গ্রামে সবার সঙ্গে একসঙ্গে সময় কাটানো। সেটির আফসোস রয়ে গেছে। বাবা, মা, ভাই, বোনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগিটা হচ্ছে না। তবে সহকর্মীদের নিয়েও আরেকটি পরিবার, তাদের সঙ্গে ঈদ উদযাপনের অনুভূতিটাও ব্যতিক্রম।
এসইউজে/ইএ/এএসএম