তানুর মামলা প্রত্যাহার চান সাংবাদিক নেতারা
ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীদের খাবার পরিবেশনে অনিয়মের সংবাদ করায় জাগোনিউজ২৪.কম-এর প্রতিনিধি তানভীর হাসান তানুর বিরুদ্ধে করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন সাংবাদিক নেতারা। একই সঙ্গে আরও যে দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে একই আইনে মামলা করা হয়েছে তাও প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি মোল্লা জালাল বলেন, সরকার আমাদের বার বার বলেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ হবে না। কিন্তু আমরা দেখছি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বার্থান্বেষী মহল এ আইনের সুযোগটা নিচ্ছে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে।
তিনি বলেন, ঠাকুরগাঁওয়ের ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। যে নিউজ হয়েছিল, তাতে সরকারের জন্য পজিটিভ তথ্য ছিল। সাংবাদিকরা যদি এসব তথ্য না দেন, তাহলে সরকার পাবে কোথায়? এসব তথ্য দেয়া সাংবাদিকের দায়িত্ব।
বিএফইউজে সভাপতি আরও বলেন, মামলা করে সাংবাদিক গ্রেফতার করানো অনাকাঙ্ক্ষিত, এটা বাড়াবাড়ি। আমরা জাগোনিউজ২৪.কম-এর ঠাকুরগাঁও জেলা প্রতিনিধি তানভীর হাসান তানুসহ ঠাকুরগাঁওয়ের তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। এটা নিষ্পত্তির বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নেবে বলে বিশ্বাস করি।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান বলেন, দেশব্যাপী দুর্নীতির মচ্ছব চলছে। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং দলীয় কর্মীরা মিলে লুটপাট করছে। সেখানে ন্যূনতম বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সাংবাদিকরা। তাই সাংবাদিকরা এখন এদের অভিন্ন শত্রু। সুতরাং নানা নিবর্তনমূলক আইনের মাধ্যমে তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, হয়রানি করা হচ্ছে। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাই। অবিলম্বে সাংবাদিক তানভীর হাসান তানুর বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে তা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যে মামলা হচ্ছে তা স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন না ‘অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট’ নতুন করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হচ্ছে। মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য এ আইন অবিলম্বে বাতিল করা উচিত।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু বলেন, ডিইউজে সব সময় বলে আসছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে সব ধারা সাংবাদিকতার ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করে, সেটি প্রত্যাহার করা। সেটি বিলুপ্ত করার জন্য আমরা সব সময় দাবি জানাই।
তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিক গ্রেফতারের কারণে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হচ্ছে এবং তথ্যপ্রবাহের ক্ষেত্রে এক ধরনের বিড়ম্বনা তৈরি করছে। আমরা সাংবাদিক তানুসহ ঠাকুরগাঁওয়ের আরও দুই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হওয়া মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, আমরা সব সময় বলি পরিবেশিত সংবাদ নিয়ে যদি কেউ সংক্ষুব্ধ হন তিনি প্রতিবাদ দিক। তারপরও যদি কেউ মনে করেন ক্ষতির মুখে পড়েছেন বা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন, তিনি প্রেস কাউন্সিলের শরণাপন্ন হন।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সভাপতি মুরসালিন নোমানী বলেন, সাংবাদিক সমাজ আগে থেকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। এই আইন নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে ক্ষোভ আছে। এই আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে। অবিলম্বে এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন বা বাতিলের দাবি জানাচ্ছি।
ডিআরইউ সাধারণ সম্পাদক পদে মসিউর রহমান খান বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশের সময় আইনমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে যে ওয়াদা করেছিলেন, সেই ওয়াদা তিনি রক্ষা করতে পারেননি। সাংবাদিকতা পেশা নানামুখী চাপের মধ্যে রয়েছ। এই অবস্থায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার সাংবাদিকতা পেশাকে রুদ্ধ করে তুলছে। শুধু ঠাকুরগাঁও না, আমরা অহরহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দেখি ঠুনকো ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে সাংবাদিকদের হয়রানি করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ঠাকুরগাঁওয়ে তিনজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে এবং একজন গ্রেফতার হয়েছে। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে বরাদ্দের বিপরীতে রোগীর খাবার পরিবেশনে অনিয়ম নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে তানুসহ তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে শনিবার দুপুরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. নাদিরুল আজিজের করা এ মামলায় তানু ছাড়া বাকি যে দুজনকে আসামি করা হয়েছে, তারা হলেন- বাংলাদেশ প্রতিদিনের ঠাকুরগাঁও জেলা প্রতিনিধি আব্দুল লতিফ লিটু ও নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডটকমের জেলা প্রতিনিধি রহিম শুভ।
দায়ের হওয়া মামলার বিষয়ে শনিবার রাতে খবর নিতে গেলে ঠাকুরগাঁও সদর থানা পুলিশ তানুকে গ্রেফতার করে।
ঠাকুরগাঁও আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে খাবার সরবরাহে অনিয়ম নিয়ে গত ৫ জুলাই ‘দিনে বরাদ্দ ৩০০ হলেও করোনা রোগীদের খাবার দেয়া হচ্ছে ৭০ টাকার!’ শিরোনামে জাগো নিউজে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এই নিউজের জন্য তানুর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়।
এদিকে ঠাকুরগাঁও সদর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫(১)(ক) ২৫(১)(খ) ২৯(১)/৩১(১)/৩৫(১) ধারায় হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. নাদিরুল আজিজের করা মামলার এজাহারের একটি কপি জাগো নিউজের হাতে এসেছে। মামলার ওই এজাহারে জাগো নিউজে গত ৫ জুলাই প্রকাশিত ‘দিনে বরাদ্দ ৩০০ হলেও করোনা রোগীদের খাবার দেয়া হচ্ছে ৭০ টাকার!’ শিরোনামের সংবাদে খাবার সরবরাহে অনিয়মের সত্যতা উঠে এসেছে।
মামলার এজাহারে বাদী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক উল্লেখ করেছেন, ‘গত জুন মাসে ২/১ দিন খাবার সরবরাহে সামান্য ব্যত্যয় ঘটলেও অন্যান্য সময় সরকারি বরাদ্দ মোতাবেক যথাযথভাবে রোগীদের খাবার প্রদান করা হচ্ছে।’
তত্ত্বাবধায়কের দাবি—জাগো নিউজসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পরই তিনি হাসপাতালে খাবার সরবরাহে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, হাসপাতালের পাচক (বাবুর্চি) ও রোগীদের খাবার পরিবেশনের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করে এমন তথ্য জানতে পেরেছেন।
এদিকে রোববার তানভীর হাসান তানুকে জামিন দিয়েছেন আদালত। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সাংবাদিক তানুকে ঠাকুরগাঁও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) ডালিম কুমার রায় তানুর ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। অন্যদিকে তার আইনজীবী রিমান্ড বাতিল চেয়ে তার জামিন আবেদন করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে পাঁচ হাজার টাকা মুচলেকায় আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেন।
এমএএস/জেডএইচ/এমকেএইচ