হাসপাতালে খাবার সরবরাহে অনিয়মের সত্যতা মিলল মামলার এজাহারে
অডিও শুনুন
ঠাকুরগাঁও আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে বরাদ্দের বিপরীতে করোনা আক্রান্ত রোগীদের কম টাকার খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে—এমন সংবাদ প্রকাশের জেরে তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক।
ওই মামলায় এরই মধ্যে জাগোনিউজ২৪.কমের ঠাকুরগাঁও জেলা প্রতিনিধি তানভীর হাসান তানুকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মামলার অন্য দুই আসামি হলেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের জেলা প্রতিনিধি আব্দুল লতিফ লিটু ও নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডটকমের জেলা প্রতিনিধি রহিম শুভ।
ঠাকুরগাঁও সদর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫(১)(ক) ২৫(১)(খ) ২৯(১)/৩১(১)/৩৫(১) ধারায় হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. নাদিরুল আজিজের করা মামলার এজাহারের একটি কপি জাগো নিউজের হাতে এসেছে। মামলার ওই এজাহারে জাগো নিউজে গত ৫ জুলাই প্রকাশিত ‘দিনে বরাদ্দ ৩০০ হলেও করোনা রোগীদের খাবার দেয়া হচ্ছে ৭০ টাকার!’ শিরোনামের সংবাদের খাবার সরবরাহে অনিয়মের সত্যতা উঠে এসেছে।
মামলার এজাহারে বাদী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক উল্লেখ করেছেন, ‘গত জুন মাসে দু-একদিন খাবার সরবরাহে সামান্য ব্যত্যয় ঘটলেও অন্যান্য সময় সরকারি বরাদ্দ মোতাবেক যথাযথভাবে রোগীদের খাবার প্রদান করা হচ্ছে।’
তত্ত্বাবধায়কের দাবি, জাগো নিউজসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পরই তিনি হাসপাতালে খাবার সরবরাহে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, হাসপাতালের পাচক (বাবুর্চি) ও রোগীদের খাবার পরিবেশনের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করে এমন তথ্য জানতে পেরেছেন।
অর্থাৎ সংবাদ প্রকাশের পরই তিনি খোঁজ-খবর নিয়েছেন এবং তার দায়ের করা মামলার এজাহারে উল্লিখিত হাসপাতালে ‘দু-একদিন খাবার সরবরাহে ব্যত্যয়’-এর তথ্য জানতে পেরেছেন। অথচ ‘খাবার সরবরাহে ব্যত্যয়’র বিষয়ে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। উল্টো সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তিনি।
এদিকে এজাহারে ‘দু-একদিন খাবার সরবরাহে ব্যত্যয়’ ঘটার তথ্য অকপটে স্বীকার করা হলেও তা নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘ভাবমূর্তি বিনষ্ট’ এবং ‘সুনাম ক্ষুণ্ন’ হয়েছে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের দাবি, খাবার পরিবেশনে অনিয়মের ওই সংবাদে ‘জনরোষ সৃষ্টিকারী’ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। অথচ জাগো নিউজে প্রকাশিত প্রতিবেদনে হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডের দুজন রোগী, একজন স্বজনের নাম উল্লেখসহ ‘নিম্নমানের খাবার পরিবেশন’র অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া সংবাদে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি এবং হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ও তত্ত্বাবধায়কের বক্তব্যও প্রকাশ করা হয়।
অসুস্থ হয়ে পড়েছেন সাংবাদিক তানু
এদিকে গ্রেফতার জাগোনিউজ২৪.কম-এর জেলা প্রতিনিধি তানভীর হাসান তানু থানা হাজতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সেজন্য সেখান থেকে তাকে ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। শনিবার (১০ জুলাই) দিবাগত রাত ১টার দিকে তানুর শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তাকে হাসপাতালে পাঠান সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তানভীরুল ইসলাম।
তানুর স্বজনরা জানান, করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। সম্প্রতি এ রোগ থেকে সুস্থ হন তানু। তবে এখনো তিনি শারীরিক অসুস্থতা অনুভব করছেন। তাকে নিয়মিত ওষুধ খাওয়ানো হচ্ছে।
ঠাকুরগাঁও সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তানভীরুল ইসলাম বলেন, ‘সাংবাদিক তানু হঠাৎ শারীরিক অসুস্থতা অনুভব করেন। বিষয়টি দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা আমাকে জানালে আমি তাকে হাসপাতালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিই।’
তানুর মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন-বিক্ষোভ
এদিকে তানুকে গ্রেফতারের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মুক্তি দাবিতে এবং মিথ্যা মামলার প্রত্যাহার চেয়ে জেলা প্রেস ক্লাব চত্বরে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সামবেশ করেন সাংবাদিকরা। তারা তানুর মুক্তি ও সাংবাদিকদের নামে সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান।
কর্মসূচিতে সাংবাদিক নেতারা বলেন, অভিযোগ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর প্রতিবাদলিপিসহ বিভিন্নভাবে অবস্থান ব্যাখ্যা করার সুযোগ আছে। কিন্তু এ ধরনের কোনো পন্থায় না গিয়ে সরাসরি সাংবাদিকের নামে মামলা করে তাকে গ্রেফতারের মাধ্যমে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ করা হয়েছে।
ঠাকুরগাঁও প্রেস ক্লাবের সভাপতি মনসুর আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘একটি সত্য সংবাদ করার পরই এভাবে মামলা দিয়ে সাংবাদিককে হয়রানি করার মানে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা। মামলা দায়ের ও সাংবাদিককে গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই আমি। মামলা প্রত্যাহার করা না হলে এবং গ্রেফতার সাংবাদিককে মুক্তি দেয়া না হলে বৃহত্তর কর্মসূচি নেয়া হবে।’
তানুকে গ্রেফতারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিন্দার ঝড়
ঠাকুরগাঁও প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও এনটিভির জেলা প্রতিনিধি লুৎফর রহমান মিঠু ফেসবুকে পোস্ট করে লেখেন, ‘একটি সত্য সংবাদ করার পরই এভাবে মামলা দিয়ে সাংবাদিককে হয়রানি করা মানে দেশের কণ্ঠ চেপে ধরা। মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তানুকে গ্রেফতারের বিষয়ে আমি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করছি। পরবর্তীতে আমরা কঠোর আন্দোলনে যাব।’
জেলার আরেক সাংবাদিক জীবন হক লিখেছেন, ‘সাংবাদিক তানভীর হাসান তানুর নিঃশর্ত মুক্তি চাই। সত্য লেখা যদি অপরাধ হয়, তাহলে আমিও সেই অপরাধ বারবার করতে চাই।’
জেলার এক ব্যবসায়ী সেই পোস্টে কমেন্ট করেছেন, ‘সত্যের জয় হয় এটা এখন পুরাতন কথা। এখন সত্য মানেই আপনি হয়রানির শিকার।’
দৈনিক ইত্তেফাকের পঞ্চগড় প্রতিনিধি সাজ্জাদ লিখেছেন, ‘এভাবে এক সাংবাদিককে হয়রানি করা ঠিক নয়। এর তীব্র নিন্দা জানাই। এভাবে সত্য প্রকাশে বাধা দিতে থাকলে একসময় সত্য লেখা বা আলোচনা বন্ধ হয়ে যাবে।’
জনকণ্ঠের নীলফামারী প্রতিনিধি তাহমিম ববি তার ফেসবুক পোস্টে তানুর নিঃশর্ত মুক্তি চান। মুক্তি না দিলে কঠোর আন্দোলনে যাওয়ারও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
ফেসবুকজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এমনই হাজারো পোস্ট ও কমেন্ট। সর্বত্র তানভীর হাসান তানুর নামে দেয়া মামলার প্রতিবাদ, নিন্দা ও মুক্তির দাবি চোখে পড়ছে।
এএএইচ/জিকেএস