সম্পাদক পরিষদের বড় যে চার আপত্তি
>> নয়টি ধারা স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য হুমকি : সম্পাদক পরিষদ
>> পরবর্তী মন্ত্রিসভার বৈঠকে আপত্তিগুলো নিয়ে আলোচানা
>> ২১ ধারাটি যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রসঙ্গে সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, ‘এই আইনের বিষয়ে আমরা মনে করি, সংবিধানের দেয়া আমাদের ফান্ডামেন্টাল রাইটস, ফ্রিডম অব স্পিচ, ফ্রিডম অব প্রেস- এগুলো লঙ্ঘন করে। যে চেতনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করে আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি, সেই বাংলাদেশের আদর্শের পরিপন্থী এ আইন।
‘এই আইন গণতান্ত্রিক অধিকারের পরিপন্থী। সাংবাদিকতার মূল ইথিকস বা যে পরিবেশে সাংবাদিকতা হতে পারে তার পরিপন্থী। আইনটির বিরুদ্ধে আমাদের এই চার বড় আপত্তি।’
আরও পড়ুন >> পরবর্তী মন্ত্রিসভায় উঠছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সম্পাদক পরিষদের সঙ্গে সরকারের তিন মন্ত্রী ও এক উপদেষ্টার বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের কাছে এমন মন্তব্য করেন মাহফুজ আনাম।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, প্রধানমন্ত্রীর তথ্যবিষয়ক উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব আবুয়াল হোসেন।
সম্পাদক পরিষদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলো’র মতিউর রহমান, ডেইলি স্টারের মাহফুজ আনাম, যুগান্তরের সাইফুল আলম, নিউএজের নূরুল কবির, মানবজমিনের মতিউর রহমান চৌধুরী, নিউজ টুডের রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, কালের কণ্ঠের ইমদাদুল হক মিলন, ইন্ডিপেন্ডেন্টের মো. শামসুর রহমান, বাংলাদেশ প্রতিদিনের নঈম নিজাম, ইনকিলাবের এ এম এম বাহাউদ্দিন, বণিক বার্তার দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, ঢাকা ট্রিবিউনের জাফর সোবহান ও সমকালের মুস্তাফিজ শফি প্রমুখ।
এদিকে সম্পাদক পরিষদের সঙ্গে বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নয়টি ধারা স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য হুমকি বলে জানিয়েছে সম্পাদক পরিষদ। এসব ধারার বিষয়ে আলোচনার জন্য আবারও মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে।’
আনিসুল হক বলেন, ‘আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩- এ নয়টি ধারা নিয়ে মূলত আজকের আলোচনা। অন্য ধারার বিষয়ে কারও বক্তব্য নেই। যেহেতু আইনটি ইতোমধ্যে জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে, যদিও এখনও রাষ্ট্রপতি আইনটিতে স্বাক্ষর করেননি; সেহেতু সম্পাদক পরিষদের কিছু আপত্তির বিষয়ে যেগুলো সংবাদপত্রে ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে- সেগুলো নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পরবর্তী মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনা করবো।’
‘তবে আজকের বৈঠকে ২১ ধারাটা যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগামী ৩ অক্টোবর মন্ত্রিসভার একটি বৈঠক রয়েছে। কিন্তু ওই বৈঠকে অনেক এজেন্ডা আছে। তাই হয়তো সেদিন এটা উপস্থাপন সম্ভব হবে না। কিন্তু এর পরে যে সভা হবে সেখানে বিষয়গুলো উপস্থান করব। সেখানে আলোচনার জন্য আমাদের যে টার্মস অব রেফারেন্স দেয়া হবে সে আলোকে আবার আলোচনায় বসা হবে। সম্পাদক পরিষদসহ সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে কয়েকবার আলোচনায় বসা হতে পারে।’
এ বিষয়ে মাহফুজ আনাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা সম্পাদক পরিষদ থেকে একটা বিস্তারিত এবং আর্টিকেল বাই আর্টিকেল অভিমত প্রকাশ করে খবরের কাগজে ছেপেছি। আমি সাংবাদিকসহ সব ধরনের মানুষকে অনুরোধ জানিয়েছে, আইনটি পুরোপুরি পড়ুন এবং নিজেরাই বিচার করুন; আইনটি দেশের জন্য ভালো কিনা?’
তিনি বলেন, ‘আজকের আলোচনায় আমাদের আপত্তিগুলো লিখিত আকারে মন্ত্রীর নিকট দিয়েছি। এর ফলে আমাদের আর্গুমেন্টগুলো স্পষ্ট হয়েছে। আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, মতবিরোধ কিছু হয়েছে তবে উনারা আমাদের বক্তব্য শুনেছেন। আমাদের অভিযোগগুলো নিয়ে আলোচনার জন্য আইনমন্ত্রী আগামী বা তার পরের মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করবেন বলে জানিয়েছেন।’
‘এগুলো উপস্থাপনের মাধ্যমে একটা আলোচনার পথ উন্মোচন হবে। একই সঙ্গে তারা আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন যে, যেসব জায়গায় আমরা আপত্তি তুলেছি সেগুলো নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে গ্রহণযোগ্য সমাধান করবেন। আরও আশ্বস্ত করেছেন যে, উনারা এমন কোনো আইন করতে চান না যে আইন স্বাধীন সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করবে।’
একই সঙ্গে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘আইনটি সংসদে পাস হওয়ার আগে আমরা সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সঙ্গে দুটি বৈঠক করেছিলাম। তৃতীয় আরও একটি বৈঠক করার কথা ছিল। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলো যে, তৃতীয় বৈঠকটি আর হয়নি। কেন ওই বৈঠক হলো না এটা আমাদের কাছে বিরাট প্রশ্ন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আশাবাদী যে, আলোচনার মাধ্যমে যেসব জায়গায় আমাদের আপত্তি রয়েছে সেগুলো পরিবর্তন করে আইনটি সংশোধন করা হবে। আমরা বাতিল করতে বলছি না, সংশোধন করতে বলছি। ডিজিটাল নিরাপত্তার ব্যাপারে সম্পাদক পরিষদ অত্যন্ত সচেতন। আমরা মনে করি, ডিজিটাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটা আধুনিক আইন থাকা উচিত। তবে কোনো আইনই যেন সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে না যায়।’
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘বাংলাদেশ ডিজিটাল সমাজে রূপান্তরিত হচ্ছে। এ ডিজিটাল জগতে ডিজিটাল অপরাধীরা উৎপাত ও বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ অপরাধীদের শক্ত হতে দমন করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে। তবে কোনো আইন দ্বারা যদি গণমাধ্যমকর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেটি আমাদেরও উদ্বেগ। আমি মনে করি গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তা বিধান করা গণতান্ত্রিক কাজ।’
গত ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হয়। এ আইনের বিভিন্ন ধারা নিয়ে সাংবাদিকদের আপত্তি থাকলেও তা আমলে নেয়া হয়নি। বরং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারাকে ভিন্নভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সংযোজন এবং ঔপনিবেশিক আমলের ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট-১৯২৩’কে এ আইনের ৩২ ধারায় সংযুক্ত করার মাধ্যমে তা গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে নতুন উদ্বেগ তৈরি করে। এদিকে আইন পাস হওয়ার পর সম্পাদক পরিষদসহ সাংবাদিকদের সব সংগঠন এর বিরোধিতা করে।
একই সঙ্গে সম্পাদক পরিষদ আইনটি পাস হওয়ায় উদ্বেগ জানিয়ে গত ২২ সেপ্টেম্বর পরিষদের বৈঠক শেষে এক বিবৃতি দেয়। বিবৃতিতে ২৯ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করে। ২৬ সেপ্টেম্বর তথ্যমন্ত্রী স্বাক্ষরিত একটি চিঠি সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের কাছে পাঠানো হয়।
চিঠিতে মানববন্ধন কর্মসূচি স্থগিত করে ৩০ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টায় তথ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আইনটি নিয়ে বৈঠকে বসার আহ্বান জানানো হয়। তথ্যমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সম্পাদক পরিষদ কর্মসূচি স্থগিত রেখে বৈঠকে অংশ নিতে রাজি হয়।
সম্পাদক পরিষদ থেকে বলা হয়, আলোচনা ফলপ্রসূ না হলে প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
এমইউএইচ/এমএআর/আরআইপি