হাতে কলমে অনেককে সাংবাদিকতা শিখিয়েছেন বগুড়ার বেচান
শহরের কোনো টি-স্টল কিংবা প্রেসক্লাব, যেখানেই একাকি দেখা যাবে সেখানেই চিন্তামগ্ন মানুষ তিনি। সামনে দাঁড়ালেই হাসিমাখা সহকর্মীর প্রতিচ্ছবি। বই হাতে সারাক্ষণ ছুটে চলা এই মানুষটি ওয়াসিকুর রহমান বেচান। যাকে বগুড়ার সাংবাদিকরা বেচান ভাই বলেই চেনেন। বয়স ৬৭ পেরিয়েছে। আর সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে রয়েছেন ৪২ বছর ধরে। এখনও থেমে থাকেনি তার ছুটে চলা।
সংবাদপত্রের শহরখ্যাত বগুড়ায় অনেক প্রতিথযশা সাংবাদিকই বেচান ভাইয়ের কাছে হাতেখড়ি নিয়েছেন।
ফোনে কথা বলে দেখা করতে চাইলে সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে গেলেন তিনি। এরপর তার কয়েক দফা আলাপচারিতা। কখনও বিরক্ত হননি। অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজে তাকে নিয়ে লেখা যাবে শুনে আরও খুশি। কারণ তিনি নিজেও এ পোর্টালের একজন নিয়মিত পাঠক। ওয়াসিকুর রহমান বেচান বর্তমানে বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুক্তবার্তা পত্রিকার সম্পাদক। এছাড়া তিনি বর্তমানে দৈনিক করতোয়ার উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বেচান ভাই। যার চার দশকের অধিককাল ধরে সংবাদপত্র আর সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত থেকেও এখনও ক্লান্তি আসেনি তেমন করে, যেমন করে ভ্রান্তির জরা এসে পেশার মানুষকে নিয়ে যায়-পড়ান্তর প্রহরে। জানালেন প্রাণের প্রস্ফুটিত প্রণোদনে লম্বা একটা সময় ধরে সংবাদের পেছনে ছুটতে গিয়ে কিংবা ছুটে আসা সংবাদের সবান্ধব সম্পাদন করতে গিয়ে কৌতুহলের কলতালে এতটাই মুখরিত থেকেছেন যে, কখনওই মনে হয়নি-মিটে গেছে তার তৃষ্ণা। তাই তিনি এখনও উৎসুক হয়ে থাকেন যা কিছু আছে সবকিছু উজাড় করে দেবার।
আলাপচারিতায় জানালেন সমাজ-সংস্কৃতির অনিন্দ্য আলোকে রাজনীতির অভাবিত রূপায়নের রূপময় দিনগুলিতে বগুড়া মিউনিসিপ্যাল হাই স্কুল (বাংলা স্কুল) আর সরকারি আজিজুল হক কলেজের ছাত্র হিসেবে ছোটবেলা থেকেই পেয়েছেন পড়াশোনার পারিবারিক পরিবেশ। তার বাবা প্রখ্যাত ফুটবলার কোলকাতা ফার্স্টডিভিশন ফুটবল লীগের এরিয়ান্সের খেলোয়াড় মাহবুবর রহমান (বড়কালু)। তিনি উপমহাদেশের বিভিন্নস্থানে ফুটবল খেলতে গিয়ে সঙ্গে করে আনতেন পত্র-পত্রিকা। মা খোরশেদি বানু ছিলেন সাহিত্য অনুরাগি। পড়তেন গল্প-উপন্যাস। এগুলি সংরক্ষিত করে রাখা হতো। পরবর্তীকালে তার নিষ্ঠাবান পাঠক ছিলেন তিনি।
ছাত্র রাজনীতির ষাট দশকীয় সামাজিকায়নে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার সুযোগে রাজনৈতিক সাহিত্যের নানা বিষয়গুলিও অবগত ছিলেন পাঠ্যাভাসের চমকিত প্রণোদনে। ছোটবেলায় বাবা বাসায় রাখতেন কলকাতার বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক স্টেটসম্যান। সেটি পড়বার চেষ্টা করতেন। বাবা বলতেন, হাতের কাছে সবসময় ডিকশনারি রাখবে। পড়বে আর ডিকশনারি দেখবে। শব্দের মানে বুঝবে। তিনিও ইংরেজি পত্রিকাটি পড়ে মানে বুঝার চেষ্টা করতেন ডিকশনারি দেখে দেখে।
এক পর্যায়ে বললেন, আমার বাবা লেখাপড়া করেছেন কলকাতার রিপন কলেজে। তার ইংরেজির উপর দখল দেখে আমরা বিস্মিত হতাম। আমারও ইংরেজি শেখার পেছনে তার সৃদৃষ্টি ছিল প্রখর। তার কারণেই আমি সেই সময় কিছুটা ইংরেজি ভাষার সঙ্গে পরিচিত হই। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন লেখকের লিখনির পাশে বিখ্যাত সব পত্র পত্রিকার সঙ্গে পরিচিত হয়ে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ইত্তেফাক, সংবাদ, পূর্বদেশ, আজাদ আর দৈনিক বাংলার পাশে বিশ্বখ্যাত ইংরেজি সাপ্তাহিক টাইম, নিউজউইক, ইন্ডিয়া টুডে, সানডে, প্রোব, ফিল্মফেয়ার, ডেবোনিয়ার, দেশ, সানন্দা, উল্টোরথ, প্রসাদের মতো পত্রিকারও ছিলাম নিয়মিত পাঠক।
ওয়াসিকুর রহমান বেচান স্মৃতিচারণ করে বলেন, বগুড়ার সংবাদপত্র জগতের পরিচিত ত্রয়ী আব্দুল মতীন, দুর্গাদার্স মুখার্জি আর মীর্জা আমজাদ হোসেন। বগুড়া থেকে প্রকাশিতব্য দৈনিক করতোয়া নামের একটি পত্রিকার ডিক্লারেশন নিয়ে প্রকাশ করতে যাচ্ছেন তারা ১২ আগস্ট, ১৯৭৬ থেকে। তখন আমি ঢাকায় চার্টার্ড একাউনটেন্সি’র ছাত্র। সিএ ছাত্রদের কোনো না কোনো সিএ ফার্মের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে হাতে-কলমে শিক্ষা লাভ করতে হয়। আমি তখন সিএ ফার্ম কাসেম অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গে সংযুক্ত। শহরে প্রাণকেন্দ্র থানা রোডে নিউ মার্কেটে আমার জন্মস্থান ও বাসভবন। একদিন ছুটিতে বগুড়া এসে সন্ধ্যায় চায়ের তৃষায় ঢুকে পড়েছি বাড়ির সামনের আকবরিয়া হোটেলে। ১১ আগস্টের সন্ধ্যায় সেই মুখরিত কোনোস্থানে উল্লেখিত সাংবাদিকদ্বয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের সুবাদে সাংবাদিক হতে চাওয়ার গুপ্ত ইচ্ছাই যেন ডানা মেলতে চাইলো তাদেরই সান্নিধ্যে।
ক্যালকাটা বেকারি নামে সুপরিচিত একটি বেকারির মালিক মোজাম্মেল হক’এর বড়গোলাস্থ ক্যালকাটা বেকারির দোতলার দশ বাই বিশ ফুটের-সেই ছোট্ট পরিসরের পত্রিকা কার্যালয়ে করতোয়া প্রকাশের আগের রাতেই হয়ে গেলাম চিফ রিপোর্টার। সেই যে, সেই সন্ধ্যায় পা রাখলাম সংবাদের জগতে, আজও তার ক্লান্তিহীন পদচারণায় তাকানো হয়নি আর পেছনের পানে।
তবুও যখন কেউ কেউ জানতে চায় কেমন ছিল তখন-সংবাদপত্রের সঙ্গে আমার যাপিত জীবন? চোখের দুয়ার খুলে দিয়ে তখন অবাক হয়ে দেখি নানা বর্ণে বর্ণিল সেই সব মধুময় দিন। ঢাকা থেকে ট্রেনে করে আসা নির্দিষ্ট কিছু পত্রপত্রিকার বাইরে জেলা শহরে ছিল না তখন তেমন কোনো পত্রিকা। সেই সব দিনে ট্রেনে করে ঢাকার পত্রিকা জেলা শহরে এসে পৌঁছাতো সন্ধ্যায়। পরদিন সকালে সেই সব পত্রিকা হকাররা বাড়ি বাড়ি বা দোকানে পৌঁছে দিত। পাঠক ছিল খুবই সীমিত। স্বাধীনতার পরে বগুড়ায় দৈনিক বাংলাদেশ নামের যে পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো অগ্রজ সাংবাদিক আমানউল্লাহ খানের সম্পাদনায়, সেটিও বন্ধ তখন-নানা প্রতিকূলতার কারণে। হাতে গোনা প্রবীণ সাংবাদিকজনের মধ্যে দৈনিক আজাদ পত্রিকার প্রবীণ রিয়াজউদ্দিন আহমেদ, সংবাদের দুর্গাদার্স মুখার্জি আর ইত্তেফাকের আমানুল্লাহ খান, বাসস এর কাজি এরাদতউল্লাহ’র সঙ্গে একজন তরুণ মাহবুবর রহমান রাজা ছাড়া জুনিয়র কোনো সাংবাদিকের নাম জানে না মানুষ। এমনি এক সীমাবদ্ধ পরিসরে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে চলা দৈনিক করতোয়ার সঙ্গে থেকে মাঠ-ঘাটে রিপোর্টিং, সংবাদ সম্পাদনার পাশাপাশি বিদেশি পত্রিকার খবর-ফিচার অনুবাদ নিয়ে প্রকাশিত পত্রিকার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে থাকতে হয়েছে অচ্ছেদ্য বন্ধনে।
রাতের শেষ প্রহরে হকারদের হাতে পত্রিকা তুলে দিয়ে উত্তরজনপদের বিভিন্ন জেলায় তার সুষ্ঠু বিপণনের যাবতীয় কার্যাদির পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলের থানায় থানায় সাংবাদিক তৈরির দুরুহ কাজটিও পত্রিকার প্রসারের প্রয়োজনে ওয়াসিকুর রহমান বেচানকে সম্পাদন করতে হয়েছে। ইতোমধ্যে দুর্গাদার্স মুখার্জির সম্পাদনায় দৈনিক উত্তরাঞ্চল প্রকাশিত হলে দৈনিক করতোয়া’র বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে নানান চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করে এগোতে হয়েছে সামনের দিকে।
বেচান বলেন, সত্তর দশকের মাঝামাঝি আমি যখন সাংবাদিকতা শুরু করি তখন জাতীয় পর্যায়ে হাতেগোনা কয়েকটা মাত্র পত্রিকা যা আগেই উল্লেখ করেছি। উত্তরবঙ্গেও তেমন পত্রিকা ছিল না। আর থাকলেও সেটা চোখে পড়ার মতো ছিল না।
৭৬ এর ১২ আগস্ট বগুড়া থেকে দৈনিক করতোয়া প্রকাশ হলো। শুরুতে সাংবাদিকের আকাল ছিল। কারণ এটা পেশা হিসেবে পরিচিতি ছিল না। কারণ পত্রিকাই নেই তো পেশা হিসেবে মানুষ আসবে কিভাবে? আমি পত্রিকার জন্য গোটা উত্তরবঙ্গ ছাড়াও দেশের নানা অঞ্চলে সাংবাদিক সংগ্রহ করতাম আর সম্পাদক তাদের নিয়োগ দিতেন। যশোর, খুলনা, সিলেট, চট্টগ্রাম সর্বত্রই সাংবাদিকতা করার জন্য উপযুক্ত কর্মী খুঁজে বের করেছি। তাদের সঙ্গে কথা বলে সংবাদ লেখা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিয়েছি। তাদের প্রেরিত
খবরগুলো সম্পাদনা করে জানিয়ে দিতাম, আপনার লেখা খবরটি পত্রিকায় কীভাবে ছাপা হলো সেটা ভালোভাবে পড়ে আপনি নিজেই ঠিক করে নেবেন কিভাবে সংবাদটি লিখতে হবে। কোথায় ভুল ছিল সেটাও শুধরে নিবেন।
সারাদেশ থেকে বিভিন্ন থানার সংবাদকর্মীদের যোগাযোগ রেখে চলতাম। নতুন পেশায় তারাও উৎসাহ উদ্দীপনায় সংবাদ সংগ্রহ করতো। পত্রিকা অফিসে ডাকবিভাগের মাধ্যমে খামে ভরে সংবাদ পাঠাতো। জরুরি সংবাদ আসতো টেলিগ্রাম মারফত। এসব সংবাদকর্মীরা প্রায় সকলেই নিজ নিজ জেলা থানা থেকে বগুড়ায় পত্রিকা কার্যালয়ে আসতেন। তখন তাদের সঙ্গে রিপোর্টিং নিয়ে আমার কথা হতো। বুঝিয়ে দিতাম সংবাদ কিভাবে লিখতে হয়। এমন প্রাথমিক মাস্টারি আমাকেই করতে হতো তখন।
বেচান জানান, শুরুতে পত্রিকা সম্পাদনা সংক্রান্ত জ্ঞান আমার ছিল প্রাথমিক পর্যায়ের। ঢাকায় প্রেস ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি)-এর লাইব্রেরি থেকে আমাকে সংবাদপত্র সংক্রান্ত বিভিন্ন দেশি-বিদেশি বই সংগ্রহ করতে হয়েছে, পড়তে হয়েছে। সাংবাদিক হওয়ার ফাউন্ডেশন শিক্ষাটা আমাকে নিতে হয়েছে এ লাইব্রেরি থেকেই। পত্রিকা প্রকাশনার পাশাপাশি নব উদ্ভুত একটি সাংবাদিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে ১৯৭৮-সালে এসে গঠিত হয়েছে অবিভক্ত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের অনুমোদিত ইউনিট অবিভক্ত বগুড়া সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিইউজে)। তারই প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করতে পেরেছি বলেই না পরবর্তীর দিনগুলোতে ১৯৮২ থেকে ৮৮ পর্যন্ত পালন করতে হয়েছে সেই অবিভক্ত বগুড়া সাংবাদিক ইউনয়নের সভাপতির দায়িত্ব।
বললেন, বগুড়া প্রেসক্লাবের নির্বাচিত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছি ১৯৮৭, ৮৮, ৮৯ আর ৯২ এর কমিটিতে। এভাবেই পত্রিকা, প্রেসক্লাব আর সাংবাদিক ইউনিয়নের বিবিধ কাজের সঙ্গে জড়িত থেকেই বার্তা সম্পাদক থেকে নির্বাহী সম্পাদক হয়ে ১৯৮৯ সালে এসে প্রকাশ করেছি দৈনিক মুক্তবার্তা। সংবাদসেবীদের অকুণ্ঠ সমর্থনে সেটিকেও আন্দোলিত করতে পেরেছি জনজীবনে অভ্যন্তরে। আজও সেই পত্রিকার সম্পাদনায় পাশাপাশি ১৯৯৬ সাল থেকে মাঝখানের ৫ বছর প্রবাসজীবন বাদ দিয়ে এখনও আছি দৈনিক করতোয়ার উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে। পাওয়া না পাওয়া নিয়ে বললেন, দীর্ঘ এই সাংবাদিকতার জীবনে সংবাদপত্র সম্পৃক্ত মানুষের পাশাপাশি উত্তর জনপদের লক্ষ লক্ষ পাঠক আর সংবাদসেবীদের অজস্র ভালোবাসায় স্নাত এই জীবনে হয়তোবা অর্থবিত্তের অবারিত ঠিকানা পাইনি, তারপরেও অজস্র মানুষের সীমাহীন-ভালোবাসায় যা কিছু পেয়েছি, তার মূল্যও কিন্তু কম না। তাই বলি, চার দশক আগে নেশায় সেই যে সাংবাদিক চেয়ারে বসা সেটাই পরবর্তীতে হয়ে উঠলো পেশা। অদ্ভুত ব্যাপার হলো আজও কিন্তু ওঠা হলো না সেখান থেকে।
লিমন বাসার/এমএএস/আরআইপি