সিরাজগঞ্জের সাংবাদিকদের আদর্শ রফিকুল আলম খান
বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে রফিকুল আলম খান একটি উদাহরণ। একজন নির্ভীক সাংবাদিক হিসেবে সিরাজগঞ্জের সবার কাছে তিনি অতি প্রিয় পরিচিত মুখ। সাংবাদিকতার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, দায়িত্ব, সততা ও সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা তাকে অন্য সাংবাদিকের চেয়ে আলোকিত করেছে।
সাংবাদিকতা জীবনে কখনও তিনি অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। স্বার্থ, প্রলোভন, অর্থ, বিত্ত তাকে কোনোদিন দমাতে পারেনি। রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী হলেও পত্রিকার নীতিমালার অনুসরণে তিনি কঠোর নিরপেক্ষতা বজায় রাখতেন।
এমন আদর্শকে ধারণ করে প্রায় ৫৩ বছর ধরে মফস্বলে সাংবাদিকতা করছেন রফিকুল আলম খান। যমুনা বিধৌত উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার সিরাজগঞ্জের সমস্যা-সম্ভাবনা ও গণমানুষের কথাগুলোকে অবিরাম তুলে ধরেছেন তিনি। পাশাপাশি স্থানীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে রয়েছে তার পদচারণা।
সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ শহরের মোক্তারপাড়া মহল্লায় জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় উঠে এসেছে রফিকুল আলম খানের পারিবারিক ও ৫৩ বছরের দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনের নানান ঘটনার কথা।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, রফিকুল আলম খান ১৯৪৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার ডুমুর বড়বাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মরহুম এলাহি বখশ সেই যুগের বিশিষ্ট আইনজীবী ছিলেন। তার মাতা মরহুমা ওয়াজেদা খানম।
রফিকুল আলম খান গ্রামের পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ১৯৫৬ সালে সিরাজগঞ্জ শহরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিক্টোরিয়া হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে ১৯৬১ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালে সিরাজগঞ্জ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে বিএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন।
পারিবারিক জীবনে স্ত্রী উম্মে সালমা একজন গৃহিণী। তিনি পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মরত ছিলেন। ২ মেয়ে, বড় মেয়ে রাফিয়া সুলতানা সুমনা লন্ডন প্রবাসী। তিনি লন্ডনে বেসরকারি শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রে কর্মরত রয়েছেন। ছোট মেয়ে শারমিন সুলতানা শারমিন। একমাত্র ছেলে মাহমুদুল আলম জগন্নাথ বিশ্বদ্যিালয়ের ছাত্র ছিলেন। ৫ বছর আগে তাবলীগ জামায়াতে গিয়ে দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে পানিতে ডুবে মারা যান তিনি।
রফিকুল আলম খান ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি করতেন। ১৯৬৫ সালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সিরাজগঞ্জস্থ নিজস্ব সংবাদদাতা হিসেবে সাংবাদিকতায় প্রবেশ করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে প্রাচীনতম কাগজ দৈনিক আজাদ এর নিজস্ব সংবাদদাতা নিযুক্ত হন। ১৯৭৪ সালে দৈনিক আজাদ বন্ধ হয়ে গেলে তার সাংবাদিকতায় ছেদ পড়ে। পরবর্তীতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজশাহী থেকে প্রকাশিত দৈনিক বার্তার নিজস্ব সংবাদদাতা নিযুক্ত হন।
১৯৮২ সালে রফিকুল আলম খান দৈনিক বাংলায় যোগ দেন। সেখানে দায়িত্ব পালনকালেই দৈনিক প্রথম আলো বের হয়। সেখানে প্রতিষ্ঠানকালী সময়ে দৈনিক প্রথম আলো’র সিরাজগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। এরপর দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮৬ সাল থেকে তিনি বাংলাদেশ বেতারের সিরাজগঞ্জ সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করে আসছেন।
সাংবাদিকতা জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে রফিকুল আলম খান ১৯৭২ সালে সিরাজগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক কিষাণ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। সেখানে সুনামের সঙ্গে ৩ বছর দায়িত্ব পালন করে সাপ্তাহিক সমযুগ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন।
দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির বৃহত্তর পাবনার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও সিরাজগঞ্জ শাখার সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সিরাজগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি হিসেবেও সাংবাদিকদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কতিক ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন।
সুদীর্ঘ ৫৩ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে রফিকুল আলম সাংবাদিকতা জীবনে বিভিন্ন অসহায় মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন। সিরাজগঞ্জের নিপীড়িত, লাঞ্ছিত মানুষের ন্যায্য অধিকার নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন লিখে সহস্র মানুষের চিকিৎসার, ভাত কাপড়ের, পুঁজি, বাসস্থানের ব্যবস্থাসহ আর্থিক সাহায্য প্রদানে সহযোগিতা করাসহ মানুষের করুণ কাহিনী লিখে বিভিন্ন সময়ে তাদের চিকিৎসা বাবদ ও স্বচ্ছলভাবে চলার পুঁজি করে দিয়েছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি অনেক দুঃসাহসিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন। তার অসংখ্য অনুসন্ধানী অপরাধমূলক রিপোর্ট প্রকাশের পর অনেক সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী বদলি ও সাসপেন্ড হয়েছে। তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে অসংখ্য অনিয়ম দুর্নীতির। সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশের পর নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন ব্রিজ, কালভার্ট, রাস্তাঘাট ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভবন।
সাংবাদিকতা ও সাহিত্যাঙ্গনে বিশেষ অবদান রাখায় রফিকুল আলম খানকে ১৯৭৩ সালে যমুনা সাহিত্য গোষ্ঠী সাহিত্যরত্ম উপাধিও প্রদান করেন। ২০১৫ সালে সাংবাদিকতায় অসামান্য অবদান রাখায় ‘সাহসী জনতা গুণীজন পদক-২০০৫’, আমাদের সময় স্মারক সম্মাননা ও বাংলাদেশ বেতার সম্মাননা পদকে ভূষিত হন তিনি।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি রাজনৈতিক জীবনে সফল রফিকুল আলম খান। ছাত্রজীবনে তিনি সিরাজগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন সমিতির নাট্য ও প্রমোদ সম্পাদক ছিলেন। স্বাধীনতা পূর্ব এবং পরবর্তীতে তিনি মহকুমা আওয়ামী লীগের দপ্তর ও প্রচার সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামীলীগ গঠিত হলে তিনি সিরাজগঞ্জ জেলার যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার পূর্বে তিনি জেলা আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক এবং কৃষকলীগেরও প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
সাংবাদিক হিসেবে নিজের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে বলেন, ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ে সিরাজগঞ্জ বিভাগে যন্ত্রাংশ ও পাটর্স চুরির ঘটনা নিয়ে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় দৈনিক আজাদে। সংবাদটি দেশজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় হয়। প্রশাসন থেকে আমার ওপর চাপ আসতে শুরু করে। এক পর্যায়ে সংবাদটি মিথ্যা হিসেবে লিখতে আমার উপর চাপ দেয়া হয় অন্যত্থায় এ পেশা থেকে সরিয়ে দেয়ার ও পত্রিকা থেকে পদত্যাগ করারও হুমকি দেয়া হয় আমাকে।
তিনি আরও একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেন, ১৯৮০ দশকে সিরাজগঞ্জে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ভাঙন নিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। ওই সংবাদটিও উচ্চমহলে ব্যাপক আলোচিত হয়। বিকেলেই সেনাবাহিনীর একটি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আমাকে ডেকে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সন্ধ্যার দিকে ছেড়ে দেন। এরকম বেশ কয়েকটি স্মৃতিও তিনি তুলে ধরেন।
নতুন সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে রফিকুল আলম খান বললেন, আমি এ পেশা নিয়ে আশাবাদী। এক সময় এ পেশায় তেমন বেতন ভাতা ছিল না। এখন এ পেশায় অনেক শিক্ষিত মেধাবীরা প্রবেশ করেছেন। নতুন যারা এ পেশায় যুক্ত হচ্ছেন তাদের প্রতি আমার নির্দেশ থাকবে সংবাদপত্রের পাশাপাশি গুণীজনদের জীবনী ও প্রচুর বই পড়তে হবে। পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই।
তিনি আরও বলেন, সাংবাদিকদের লেখনি সমাজের আয়নায় পরিণত হোক। যা দেখে মানুষ সচেতন হবে। আমরা চাই, এলাকার অন্যায়, অত্যাচার, বঞ্চনা, শোষণের বিপক্ষে সাংবাদিকের কলম ও ক্যামেরা যথাযথ কাজ করুক ও ভালো কাজের প্রশংসার বাস্তব চিত্র ফুটে উঠুক। তাদের লেখা পড়ে মানুষ ভালো কিছু শিখবেন। উৎসাহিত হবেন। ভালো কাজ করতে অনুপ্রেরণা পাবেন। মফস্বল সাংবাদিকতার মাধ্যমে সমাজ উপকৃত হোক।
সিরাজগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফজল-এ-খোদা লিটন প্রবীণ সাংবাদিক রফিকুল আলম খান সম্পর্কে বলেন, তিনি একজন শিক্ষিত সৎ ও সাদামনের মানুষ। তিনি নীতি নৈতিকতা নিয়ে সাংবাদিকতা করেছেন। তিনি আমারসহ অনেকেরই সাংবাদিকতার গুরু ও আদর্শ। তারই হাত ধরে অনেকেই সাংবাদিকতায় প্রবেশ করেছেন। সর্বজন স্বীকৃত একজন ভালো মানুষ তিনি। এ কারণে সব সাংবাদিকরা উনাকে অভিভাবক মনে করেন। তিনি আমাদের চোখে একজন আইকন।
স্থানীয় দৈনিক কলম সৈনিকের সম্পাদক ও ইতিহাস গবেষক মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ বলেন, প্রবীণ সাংবাদিক রফিকুল আলম খান আমাদের সিরাজগঞ্জের সাংবাদিকদের একজন আদর্শ। সততা ও ন্যায়ের সঙ্গে তিনি সাংবাদিকতা করেছেন। তার সংবাদে অসংখ্য মানুষও উপকৃত হয়েছেন। তিনি নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। তিনি প্রকৃতই একজন দেশপ্রেমিক সাংবাদিক।
এমএএস/পিআর