সংবিধানের ‘কবর’ দেয়া সম্ভব?

আমীন আল রশীদ
আমীন আল রশীদ আমীন আল রশীদ , সাংবাদিক, কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৮:৫৭ এএম, ০৬ জানুয়ারি ২০২৫

‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে মুজিববাদী সংবিধানের কবর রচিত হবে।’ গত ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর বাংলামোটরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এই মন্তব্য করেছিলেন সংগঠনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহসহ অন্য আরও একাধিক নেতা। যদিও ৩১ ডিসেম্বর তাদের পূর্বঘোষিত এবং বহুল আলোচিত ‘জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ জারি করা হয়নি। বরং তারা কর্মসূচি পরিবর্তন করে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ পালন করেন। ফলে সংবিধান বাতিল কিংবা বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘোষণা আসতে পারে বলে যে গুঞ্জন ছিল, তা সত্য হয়নি। যে কারণে বাহাত্তরের ‘সংবিধানের কবর’ও রচিত হয়নি!

প্রশ্ন হলো, একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের সংবিধানের কবর রচনা করা যায় কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় এবং এই এখতিয়ার কাদের? একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্রের সংবিধান কবর দেয়ার কথা বলার পেছনে আসলে উদ্দেশ্য কী? সংবিধানের কি আদৌ কবর রচনা করা সম্ভব?

একটু পেছনে ফেরা যাক। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) ওপর গণহত্যা এবং একটি অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা (১৯৭০ সালের নির্বাচন) ওই  বছরের ১০ এপ্রিল নিজেদের সমন্বয়ে একটি গণপরিষদ গঠন করেন এবং বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করে ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে শপথ নেন। এই সরকারের নেতৃত্বে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী ও সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এর এক মাস সময়ের আগেই ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি যে অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি করেন, তার আলোকে গঠিত হয় ৩৪ সদস্যের খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি—যারা ৯ মাসের মধ্যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান রচনা করেন। এই সংবিধান গৃহীত হয় ওই বছরের ৪ নভেম্বর এবং কার্যকর হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ থেকে।

গণপরিষদের চতুর্থ বৈঠকে ১৯৭২ সালের ১৯ অক্টোবর দেয়া ভাষণে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বর্বর পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য আমরা বিপ্লবী সরকার গড়ে তুলেছিলাম, ইতিহাস তা অস্বীকার করবে না। আপনারা যদি সেদিন বিপ্লবী সরকার গড়ে না তুলতেন, তাহলে স্বাধীনতা সংগ্রাম করা সম্ভব হত না। জনগণের দেওয়া ম্যান্ডেট তাঁরা পালন করেছেন এবং সেই কারণে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের অধিকার তাঁদের আছে; কারণ তাঁরা জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি।’

খুলনা-৩ আসন থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য মীর সাখাওয়াত আলি দারু বলেন, ‘এই সংবিধান রক্তের আখরে লেখা হয়েছে।’ সিলেট-৩ আসন থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আবদুর রইছ বলেন, ‘এই গণপরিষদের সদস্যরা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে তাদেরকে ম্যান্ডেট দিয়েছে এই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে। কাজেই এই গণপরিষদ সদস্যদের কণ্ঠস্বর সাড়ে সাত কোটি মানুষের কণ্ঠস্বর।’ 

সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংবিধান বিলের ওপর জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব করলে তার বিরোধিতা করে কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য হাফেজ হাবীবুর রহমান বলেন, ‘যে সংবিধান আমরা পরিষদে দেখছি, এটা হঠাৎ-রচিত সংবিধান নয়। It has grown like the Constitution of England. এটা পঁচিশ বৎসরের দাবি-দাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে উঠেছে, রচিত হয়েছে। আমরা আজ গণপরিষদে জমায়েত হয়েছি শুধু এটাকে আইনগত রূপ দেবার জন্যে। যেসব মৌলিক নীতি শাসনতন্ত্রে স্থান পেয়েছে, সেগুলোর জন্যে দেশবাসী বহুদিন ধরে সংগ্রাম করে আসছে। এগুলো যাচাই করবার প্রশ্ন এখন বাহুল্য।’(আমীন আল রশীদ, সংবিধান প্রণেতাগণ, শিলালিপি/২০২৪, পৃ. ৬০)।

সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য এবং বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামও ১৯৭২ সালের ১৯ অক্টোবর খসড়া সংবিধানের ওপর যে দীর্ঘ বক্তৃতা দেন সেখানে বলেন, ‘জনমত কী সেটা জনাব হাবীবুর রহমান বিষদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। গত ২৫ বছরের সংগ্রামের ভিতর দিয়ে যে জনমত প্রতিফলিত হয়েছে, সে জনমতই আজকের জনমত।’এদিন পটুয়াখালী-৩ আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য আসমত আলী শিকদারও তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ‘হাফেজ হাবীবুর রহমান সাহেবের মতে যে শাসনতন্ত্র দিতে যাচ্ছি, গত পঁচিশ বছরের অভিজ্ঞতার পরে তা দেওয়া হচ্ছে। এই শাসনতন্ত্র দেওয়ার জন্য কতটুকু ত্যাগ ছিল,তা সবাই জানেন।’

সুতরাং, এটি ঐতিহাসিকভাবেই প্রমাণিত যে, বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ৩০ লাখ মানুষের রক্ত আর দুই লাখ নারীর সম্ভ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে। এটা হঠাৎ করে একদিনে নাজিল হয়নি।

কিন্তু গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান অংশীজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অনেক নেতা সংবিধান নিয়ে যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন, যেগুলো অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। যেমন হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, ‘বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতিগুলোর মাধ্যমে ভারতীয় আগ্রাসনের ইনস্টলমেন্ট হয়েছে।’ বাংলাদেশের সংবিধানের চার মূলনীতি হলো জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এসব মূলনীতির মধ্য দিয়ে ভারতীয় আগ্রাসনের ইনস্টলমেন্ট হলো কী করে—তা পরিষ্কার নয়।

তবে আশার সংবাদ হলো, এইসব কথাবার্তার প্রতিবাদ আসছে রাজনৈতিক মহল থেকেই। রবিবার (৫ জানুয়ারি) জাতীয় প্রেসক্লাবে গণফোরামের একটি অনুষ্ঠানে খ্যাতিমান আইনজীবী এবং বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘বাহাত্তরের সংবিধান কবর দেওয়ার ঘোষণায় দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাতের অশনি সংকেত পাওয়া যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, সময়ের প্রয়োজনে জনআকাঙ্খা পূরণে সংবিধান সংশোধন কিংবা যুগোপযোগী করা রাষ্ট্রের জন্য চলমান প্রক্রিয়া। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত ও মীমাংসিত বিষয়গুলিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলে তা আমাদের অগ্রসরমান বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বাধাগ্রস্ত করবে। এ ব্যাপারে আমাদের সকলের দায়িত্বশীল হওয়া কর্তব্য।

এদিনই লন্ডন থেকে ঢাকায় ফিরে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, সংবিধান কবর দেওয়া যায় না। তবে সংবিধানে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা যেতে পারে। এর আগের দিন, অর্থাৎ শনিবার ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং সংবিধানকে টার্গেট করা হয়েছে। এরইমধ্যে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের সংবিধানকে ‘মুজিববাদী সংবিধান’ বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। সংবিধান ‘ছুঁড়ে ফেলা’ এমনকি সংবিধানের ‘কবর রচনা’ করার কথাও বলা হয়েছে—যার মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ৩০ লক্ষ  শহীদের সম্মান ক্ষুন্ন করা হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ যেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। বাহাত্তরের সংবিধান বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশের কথাই বলে। তাছাড়া সংবিধান এমন কোনো দলিল নয় যে, চাইলেই এটি ছুঁড়ে ফেলে দেয়া যায়।

গত ৩১ ডিসেম্বর একটি জাতীয় দৈনিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের ইঙ্গিত করে বলেন, ‘ছেলেরা অনেক অবেগপ্রবণ। যুবক, তাদের তারুণ্যে সবকিছু মিলিয়ে তাদের তো একটা আকাঙ্ক্ষা থাকতেই পারে। সেভাবে তাদের মতো করে তারা বলেছে। কিন্তু বাহাত্তরের সংবিধান বাতিলের দাবি এই মুহূর্তে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। ভবিষ্যতে যদি কখনো সুযোগ আসে, সময় আসে, তখন জাতির চিন্তা করে দেখা উচিত বলে আমি মনে করি।’

এদিন দুপুরে রাজধানীর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নূরুল হক নুর বলেন, বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল নয়, আলোচনা করে সংশোধন করা যায়।

এর দুদিন আগে ২৯ ডিসেম্বর বিএনপির সিনিয়র নেতা মির্জা আব্বাস বলেন, সংবিধান বাতিল নয়, সংশোধন করা যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘শহীদের রক্তের ওপর দিয়ে লেখা সংবিধানকে বাতিল করার চেষ্টা দুঃখজনক। সংবিধান বাতিল নয়, সংশোধন করা যেতে পারে।’

সম্প্রতি এই প্রসঙ্গে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেছেন, ‘সংস্কার কার্যকর করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিতে হবে। সংবিধান বাতিল বা পরিবর্তন করা অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নয়।’ সংবিধানের কবর রচনাকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আস্ফালন দাবি করে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, এই ধরনের আস্ফালন সহ্য করা হবে না।

সুতরাং যারা সংবিধানকে কবর দেয়া, সংবিধান ছুঁড়ে ফেলে দেয়া, সংবিধান বাতিল কিংবা সংবিধান পুনর্লিখনের কথা বলছেন, তাদের মনে রাখা দরকার এই ধরনের বিপ্লবী বা অতি উৎসাহী কাজে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের কোনো উৎসাহ নেই। বিএনপি তো বটেই, জুলাই অভ্যুত্থানে অত্যন্ত সক্রিয় গণঅধিকার পরিষদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি—কেউই যে সংবিধান বাতিল চায় না বা বিদ্যমান সংবিধানকে তারা যে ‘মুজিববাদী সংবিধান’ মনে করেন না এবং এই সংবিধানের ‘কবর রচনা’ করতে হবে বা ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে বলেও মনে করে না—এটিই বাস্তবতা।

এই ধরনের কাজে সম্ভবত সেনাবাহিনীরও সমর্থন নেই। বরং তারা যে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে আগ্রহী—সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে সেই বার্তাটি দিয়েছেন স্বয়ং সেনাপ্রধান—এমনটিও শোনা যাচ্ছে। তাছাড়া সেনাপ্রধান সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিককে দেয়া সাক্ষাৎকারেও গণতান্ত্রিক উত্তরণে সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ থাকবে বলে জানিয়েছেন। সুতরাং, যে ধরনের কর্মসূচি বা কাজে বিএনপি এবং সেনাবাহিনীর সমর্থন নেই, সেই ধরনের কাজ করে ফেলা যে সম্ভব হবে না বা খুব সহজ হবে না—সেটি সব পক্ষেরই উপলব্ধি করা প্রয়োজন।

দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সংবিধান ছুঁড়ে ফেলা বা বাতিল নিয়ে সাধারণ মানুষেরও কোনো আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। বরং তারা চায় স্বস্তি, নিরাপত্তা, নিশ্চয়তা, ভরসা।

জুলাই অভ্যুত্থানে অনেক মানুষের প্রাণ গেছে। দেশের মানুষ এখন ভরসা চায় নিরাপত্তা চায়। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, বিশেষ করে বাজারে স্বস্তি চায়। থানা, আদালত থেকে শুরু করে সরকারি যেকোনো অফিসে গিয়ে বিনা হয়রানি, ঘুষ ও সময়ক্ষেপণ ছাড়াই সেবা পেতে চায়। তারা চায় একটি অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ-গ্রহণযোগ্য এবং সর্বোপরী বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ।

অরাজনৈতিক বা নির্দলীয় সরকার যে বেশিদিন দেশ চালাতে পারে না বা পারতে চাইলেও সেটা যে আখেরে দেশের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনে না, সেই উদাহরণ দেশেই আছে। তাছাড়া অনির্বাচিত তথা নির্দলীয় সরকারের সব কাজের এখতিয়ারও নেই। এই বাস্তবতাটি খোদ সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজও উপলব্ধি করেছেন। যে কারণে তিনি বলেছেন, তারা সংবিধান সংশোধন তথা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয় স্থানগুলো চিহ্নিত করে একটি সুপারিশ দেবেন—যা বাস্তবায়ন করবে নির্বাচিত সরকার।

বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে সংবিধানের একটি দাড়ি-কমাও যদি পরিবর্তন করতে হয়, তাহলে সংসদ সদস্যদের দুই তৃতীয়াংশের ভোট প্রয়োজন হয়। অতএব আগামী নির্বাচনে যদি কোনো দল দুই তৃতীয়াংশ আসন না পায় তাহলে সংবিধান সংশোধনের কী হবে? সেক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হতে পারে এবং সেখানে এমন একটি ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে যাতে যে দলই সরকার গঠক করুক না কেন, সংসদের প্রতিনিধিত্বকারী সকল দল সংবিধানের ওই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনগুলো আনার পক্ষে ভোট দেবে।

বাস্তবতা হলো, ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে এ পর্যন্ত অনেক সংশোধনী আনা হয়েছে, যার সবগুলো দেশ ও জনগণের স্বার্থে করা হয়নি। অতএব সংবিধানকে অধিকতর গণতান্ত্রিক করা এবং দেশের গণতন্ত্র সুসংহত করতে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের ম্যান্ডেড  নিয়ে  এই সংবিধানে সংশোধন ও পরিমার্জন,পরিবর্তন করতে পারেন ।  কিন্তু সংবিধান ‘পুনর্লিখন’ বা এটিকে ‘ছুঁড়ে ফেলে দেয়া’ অথবা ‘কবর দেয়া’র মতো কথা বলা কোনোভাবেই  গ্রহণযোগ্য নয়।

বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধান স্বৈরতন্ত্র তথা ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয় বলে যে অভিযোগ রয়েছে, সেই বাস্তবতাও পুরোপুরি অস্বীকার করা যাবে না। সুতরাং ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি তথা ক্ষমতা যাতে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক না হয়, সংসদে এমপিরা যাতে প্রাণ খুলে, দ্বিধা ভুলে, দেশ ও মানুষের স্বার্থে প্রয়োজনে নিজ দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও কথা বলতে পারেন—সংবিধানে সেই নিশ্চয়তা থাকলে সংবিধান বাতিল, ছুঁড়ে ফেলা কিংবা এর কবর রচনার মতো ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দেয়ার প্রয়োজন পড়বে না। বরং এই ধরনের কথাবার্তা অভ্যুত্থানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে জনমনে প্রশ্ন তৈরি করে। যারা এই ধরনের বক্তব্য দেন, তাদের জানাবোঝা নিয়েও মানুষের মনে সংশয় তৈরি হয়। এই ধরনের উগ্রবাদী কথাবার্তার মধ্য দিয়ে তারা দেশকে আরও বেশি বিভাজিত করা বা দেশে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে চান কি না—সেই প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।