ভিডিও EN
  1. Home/
  2. নারী ও শিশু

নারী সুরক্ষার প্রধান অন্তরায় ভুক্তভোগীর বিচার না চাওয়া

সায়েম সাবু | প্রকাশিত: ০৬:৪৪ পিএম, ০৮ মার্চ ২০২৪

অ্যাডভোকেট সালমা আলী। মানবাধিকার আইনজীবী। সাবেক নির্বাহী প্রধান, বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি। নারীর অধিকার ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছেন দীর্ঘদিন। বিশেষ করে নারী পাচাররোধ ও প্রবাসী নারী শ্রমিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা রাখছেন এ মানবাধিকার নেত্রী।

নারী দিবস উপলক্ষে নারীর সুরক্ষা প্রসঙ্গ নিয়ে মতামত জানান জাগো নিউজের কাছে।

নারী দিবস উপলক্ষে এমন সময়ে আপনার মতামত গ্রহণ করছি, যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে দুটি আলাদা নারী নির্যাতনের ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। নারীর সুরক্ষা নিয়ে কী বলবেন?

নারী নির্যাতন প্রতিরোধে একটি গাইডলাইন রয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে নারীর সুরক্ষা নিয়ে এ গাইড লাইনে বিস্তর বলা আছে। প্রথমত, এ গাইডলাইন নিয়ে আমরা অবগত কি না এবং একটি ঘটনা ঘটে গেলে সে অনুপাতে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি কি না?

দ্বিতীয়ত, রাস্তা-ঘাটে নারী নির্যাতনের ঘটনায় প্রায় একই ধরনের একটি গাইডলাইন রয়েছে, যা ২০১০ সালে একটি বিচারের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতকে তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়।

নারী সুরক্ষার প্রধান অন্তরায় ভুক্তভোগীর বিচার না চাওয়া। আরেকটি নতুন নির্যাতনের ক্ষেত্র দাঁড়িয়েছে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। অনেকেই জ্ঞান রাখে না তিনি কীভাবে অনলাইনে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তার পরিবারের লোকজনও এসব বিষয়ে অবগত নয়। সবাই গোপনে মুখ বুজে সয়ে যাওয়ার পক্ষে।

আমি ৩২ বছর ধরে আইন পেশায় আছি। অনেক ঘটনার মামলায় আমি লড়েছি। অনেক রায় আমরা পক্ষে নিতে পেরেছি। উচ্চ আদালতের অনেক রায় আছে যেখানে ভুক্তভোগী নারীকে কীভাবে সুরক্ষা দেওয়া যায়। তার মানে বহু আইন থাকার পরেও আমরা নারী নির্যাতনের ঘটনা দেখছি এবং অনেক ক্ষেত্রে নারী তার সুরক্ষা নিয়ে শঙ্কিত।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের মামলাটি আপনারা পরিচালনা করছেন। কী দেখছেন?

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মহিলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে পরিচালনা করছি। মহিলা মন্ত্রণালয়ের অধীন হয়ে বিষয়টি আমাদের কাছে আসে। ঘটনার পর থেকেই আমরা লিগ্যাল সাপোর্ট দিচ্ছি এবং ভুক্তভোগীর সঙ্গে সব সময় কথা বলছি।

আরও পড়ুন
ফেব্রুয়ারিতে নারী-শিশুর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে
ধর্ষণকাণ্ডে জড়িতদের বিচার দাবিতে উত্তাল জাহাঙ্গীরনগর
ধর্ষণের বিচার না হওয়ার জন্য দায়ী ধর্ষকের রাজনৈতিক পরিচয়

আমরা এই নির্যাতিতা নারীকে খুব সাহসী বলে মনে করছি এবং তার স্বামীকেও তাই দেখছি। তার স্বামী পাশে থেকে সহায়তা করছেন, যা আমরা আর দশটা ঘটনার সময় পাই না। অনেক ঘটনায় ভুক্তভোগীর বিপক্ষে চলে যায় সমাজ ও পরিবার। অনেকেই সালিশের মাধ্যমে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হন।

আপনি প্রবাসী নারী শ্রমিকদের বিষয় নিয়েও দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। এক্ষেত্রে নারীর সুরক্ষা নিয়ে কী অভিজ্ঞতা হলো?

আমার কাছে একটি কেসস্ট্যাডি আছে। ১০ বছরের একটি মেয়ে ষাট বছরের এক বৃদ্ধের নির্যাতনের শিকার হন। সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর তার পরিবার জানতে পারে। তখন তার পরিবার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। আমরা আমাদের দায়িত্বে নিয়ে আসি। এখন সেই মেয়ে অনার্স পড়ে। ইংলিশ কোর্স করছে। বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। বিদেশি একটি পরিবার তাকে সহায়তা করছে। এরকম দু-একটি কেস সামনে এলেও বেশির ভাগই কিন্তু আড়ালে থেকে যায়।

নারীর সুরক্ষা নিয়ে আমরা অনেক ভাবলাম। অনেক আইন করলাম। নীতিমালাও হলো। কিন্তু আমরা কমিটেড না। অনেক গাইডলাইন আছে। এগুলো আইনের মতো। আমরা বাস্তবায়ন দেখি না। একটি মামলায় তিনটি পক্ষ থাকে ভিকটিমকে সাপোর্ট করার জন্য। বাদী-প্রসিকিউটর, বিচারক এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ তিনটি পক্ষ আন্তরিক হয়ে সমন্বয় করে কাজ করলে অনেক ভিকটিম সুরক্ষা পাবে।

প্রবাসী নারী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আরও এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছি। ১৪ বছরের এক মেয়েকে ভুয়া পরিচয়পত্র বানিয়ে ২৭ বছর দেখিয়ে বোরকা পরিয়ে সৌদি আরবে পাঠানো হয়। তার মা নিজে এ কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল। সৌদি আরবে সে ক্রমাগতভাবে নির্যাতনের শিকার হতে থাকে। আমরা খবর পাই। হবিগঞ্জের মেয়ে। আমরা হবিগঞ্জের মেয়রের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। মেয়ের মা মামলা করতে চান না। কারণ তিনি নিজেও আসামি হবেন যদি সঠিক মামলা হয়। আসামিরা পার পেয়ে গেলো।

আরেকটি ঘটনা বলি। ২২ বছরের একটি মেয়ে নিজের টাকা দিয়ে দুবাই যায়। ট্যুরিস্ট ভিসায়। ওখানে গিয়ে চাকরি খোঁজার চেষ্টা করে। যাওয়ার আগেই এক দালালের সঙ্গে কথা হয়। সেই দালাল তাকে বিক্রি করে দেয়। এরপর প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ জন পুরুষ তাকে নির্যাতন করে। মেয়েটি খুব চালাক। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। পরে আমরা বিমানবন্দরে রিসিভ করলাম। দেশে ফেরার পরই মামলা করি এবং তিন আসামিকে ধরা হয়। সবাই প্রভাবশালী। এর মধ্যে ২ নম্বর আসামি কোনো না কোনোভাবে উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়ে যান। আমরা অবাক হয়ে গেলাম, এরকম একাটি মামলায় আসামির কীভাবে জামিন হয়! আসামিরা ভিকটিম পরিবারকে ক্রমাগতভাবে হুমকি দিয়ে আসছে। এই হলো আমাদের সিস্টেম! সবাই মুখ খুললে নারী নির্যাতনের হার অনেক কমে যেত।

ভুক্তভোগী নারীরা এখনো সামনে না আসার কী কারণ?

সমাজ, পরিবার সাধারণত ঝুঁকি নিতে চায় না। এটিই মূল কারণ। অনেক সময় ভুক্তভোগীও দ্বিমত পোষণ করছেন। নারী সুরক্ষার প্রধান অন্তরায় ভুক্তভোগীর বিচার না চাওয়া।

আরেকটি নতুন নির্যাতনের ক্ষেত্র দাঁড়িয়েছে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। অনেকেই জ্ঞান রাখে না তিনি কীভাবে অনলাইনে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তার পরিবারের লোকজনও এসব বিষয়ে অবগত নয়। সবাই গোপনে মুখ বুজে সয়ে যাওয়ার পক্ষে।

আপনার কী পরামর্শ?

নারীর সুরক্ষা নিয়ে আমরা অনেক ভাবলাম। অনেক আইন করলাম। নীতিমালাও হলো। কিন্তু আমরা কমিটেড না। অনেক গাইডলাইন আছে। এগুলো আইনের মতো। আমরা বাস্তবায়ন দেখি না। একটি মামলায় তিনটি পক্ষ থাকে ভিকটিমকে সাপোর্ট করার জন্য। বাদী-প্রসিকিউটর, বিচারক এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই তিনটি পক্ষ আন্তরিক হয়ে সমন্বয় করে কাজ করলে অনেক ভিকটিম সুরক্ষা পাবে। আসলে আমাদের আন্তরিকতার দরকার। আর এটি আসতে হয় প্রথমে পরিবার থেকে। পরিবারে নারীর সুরক্ষা থাকলে অন্য জায়গায়ও সুরক্ষা মেলে। কারণ প্রতিটি নারী কোনো না কোনো পরিবার থেকেই আসেন।

এএসএস/এএসএ/এএসএম