নারী দিবস কি জানি না বুঝিও না
পূর্ব আকাশে তখন সূর্য উঠি উঠি করছে। মঙ্গলবার ভোরে শাহবাগ মোড় থেকে দ্রুত পায়ে হেঁটে টিএসসির দিকে আসছিলেন মধ্যবয়সী এক নারী। মাথায় তার গোলাপ ফুলের বোঝা। টকটকে লাল গোলাপের বোঝাটি পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল।
জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের মাজারের সামনে এসে মাথা থেকে বোঝা নামিয়ে একটি বিশ্রাম নিয়ে আবার মাথায় বোঝা তুলছিলেন। জাগো নিউজের এ প্রতিবেদক ক্যামেরায় ক্লিক করতেই চোখেমুখে ভীত ভাব নিয়ে তিনি বললেন, ছবি তুললেন কেন? পুলিশে ধরাইয়া দিবেন? কিন্তু আমি তো ভিক্ষা করি না, ফুল বেইচ্যা সংসার চালাই।
আজ নারীদের জন্য বিশেষ একটি দিবস আপনি তা জানেন বলতে বিস্ময়ে এ প্রতিবেদকের মুখের দিকে অপরাধী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলেন, ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস কি, জানি না, বুঝিও না, খালি জানি গতর খাটাইয়া রোজগার কইরা সংসার চালাইতে অইবো আর অসুস্থ স্বামীডার চিকিৎসা করাইতে হইবো।’ তাই প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে উঠে শাহবাগ থেকে গোলাপ ফুল কিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিক্রি করেন।
ফিরোজা বেগম। গ্রামের বাড়ি ভৈরব। স্বামী রইস মিয়া আর চার ছেলেসহ ৬ জনের সংসার। টাকার অভাবে ঘরভাড়া করতে পারেন না। চানখাঁরপুলের অদূরে ছাপড়া ঘর বানিয়ে থাকেন। এ প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে ফিরোজা বেগম জানান, তিনমাস আগেও গ্রামেই থাকতেন।
স্বামী রইস মিয়া যক্ষায় আক্রান্ত হওয়ায় আয় রোজগার করতে পারে না। চার ছেলের একজন বিয়ে করে আলাদা থাকে। বাকি তিনজনের মধ্যে দুইজন রিকশা চালিয়ে তাদের পেট চালায়। ছোট ছেলে কোন কাজ করে না।
স্বামীকে সেবা করতে এসে প্রথমে ভিক্ষা করতে শুরু করেন। কিন্তু ভিক্ষা করে যে টাকা পাওয়া যেত তা দিয়ে সংসার চলছিল না। তাছাড়া পুলিশ রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যেতে পারে এমন ভয়ও ছিল। পরবর্তীতে পরিচিত এক মহিলার পরামর্শে জমানো কিছু টাকা নিয়ে শাহবাগ থেকে ফুল কিনে ব্যবসা শুরু করেন। টিএসসি থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই এলাকার মধ্যে নিয়মিত ফুল বিক্রি করেন ফিরোজা বেগম।
আজ কত টাকার ফুল এনেছেন, কত টাকা দৈনিক আয় হয় এমন প্রশ্নের জবাবে ফিরোজা বেগম জানান, ৫০০ টাকার গোলাপ কিনে আনলে দুই থেকে তিনশ’ টাকা লাভ হয়। এক দুই কথায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি জানান, ভৈরবে বাবার বাড়িতে জমিজমা ভালই ছিল। কিন্তু নদী ভাঙ্গনে সব হারিয়ে আজ পথের ফকির। চোখ মুছতে মুছতে গোলাপ ফুলের বোঝা মাথায় নিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলেন ফিরোজা বেগম।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে একজন ফিরোজা বেগমের সংগ্রামী জীবনের গল্প উঠে আসলেও সারাদেশে প্রতিদিন এ রকম হাজার হাজার ফিরোজা বেগম জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন এটা নিশ্চিত করে বলতে পন্ডিত হওয়ার দরকার নেই!
এমইউ/এমএমজেড/পিআর