সুচের ফোঁড়ে আগামীর স্বপ্ন!
স্বপ্নের শুরুটা প্রায় ৩২ বছর আগে। তখন যারা তরুণী, যুবতী আজ তারা বয়োবৃদ্ধ। এখন বয়সের ভারে ঠিকমতো চলতে না পারলেও থেমে নেই তারা। থেমে নেই তার পরিবারের অন্যান্য নারী সদস্যরাও। সুচের ফোঁড়ে তারা বুনছে আগামীর স্বপ্ন। গ্রামের নিভৃত পল্লীর অবহেলিত এই নারীদের নিপুণ হাতে তৈরি নকশি কাঁথাই ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে সমাদৃত হয়েছে। প্রতি বছর বাড়ছে বগুড়ার নকশি কাঁথার চাহিদা। সেই সঙ্গে ভাগ্য বদল হয়েছে গ্রামের শত শত নারীর।
সুচ-সুতা নিয়ে সূচি আন্দোলনের শুরুটা বগুড়ার মহাস্থানগড়ের পশ্চিমে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে ধলমোহনী গ্রাম থেকে। এই গ্রামের অশিক্ষিত, অভাবতাড়িত মেয়েদের হাতে কাজ দিয়ে প্রথমে সহযোগিতা করে পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প নামের একটি সংস্থা। এটা ৩২ বছর আগের কথা। সেই শুরু। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আশপাশের ৮/১০টি গ্রামে ছড়িয়ে গেছে এই সূচি কাজ।
ধলমোহনী ছাড়াও বিহার, আখলাজিরা, জাহানবাদ, ধাওয়াকোলা, গোকুল, ধাওয়াকান্দি, করততোলা, চাঁদপাড়া, লাহিড়ীপাড়া, পলাশবাড়ি, মহাস্থান মধ্যপাড়া, জানাপাড়া ও নামুজার প্রায় ২ হাজার মেয়ে এখন এই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা প্রত্যেকেই এখন প্রশিক্ষিত ও স্বাবলম্বী। তাদের সূচিকর্মের বিভিন্ন উপকরণ এখন যাচ্ছে ইংল্যান্ড, ডেনমার্ক, জার্মানি, ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে।
ডেনমার্কের গ্রেথা লরেসন বাংলাদেশের এই নকশি কাঁথা দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি বগুড়ার এসব গ্রামে এসে দেখে গেছেন কি করে পল্লী বধূরা এতো সুন্দর করে সেলাই করতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন দেশ থেকে ক্রেতা আসছেন বগুড়ায়। তারা তাদের চাহিদা জানিয়ে যাচ্ছেন। সেই মতো তৈরি হচ্ছে হরেক পণ্য। রফতানি ও বাজারজাতকরণের জন্য অর্ডার দিচ্ছে ঢাকার হিট অ্যান্ড ক্রাফট, জাগরণী চক্রসহ বিভিন্ন রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান।
বগুড়ার এই সূচি শিল্পীরা শুধু কাঁথা নকশা করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। তারা আরো তৈরি করছে শাড়ি, মানিব্যাগ, চাদর, কুশন, বেড কভার, কম্পিউটার কভার, চশমা কভার, ছাতা, টেবিল ক্লথ, গ্লাস-প্লেট ম্যাট, মাফলারসহ আরো হরেক রকমের পণ্য। এগুলো দেশে বিদেশে সুনাম অর্জন করেছে। এসব সূচিকর্ম করে গ্রামের যেসব নারী দক্ষ হচ্ছে তারাই আবার অন্য গ্রামে গিয়ে সাধারণ মেয়েদের প্রশিক্ষিত করছে। পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প থেকে সরবরাহ করা হয় প্রয়োজনীয় কাপড়, রঙিন সুতা, সুচ ও নকশা। এরপর তৈরি হয় সেই কাঙ্ক্ষিত পণ্য।
কথা হয় ধলমোহনী গ্রামের বৃদ্ধা রমিছার (৬৫) সঙ্গে। ৩২ বছর আগেই তিনিই প্রথম শুরু করেছিলেন এই সূচিকর্ম। তার সহযোগী হিসেবে তখন আরো ছিলেন আনোয়ারা ও মিনোয়ারা। বয়সের কারণে কর্মক্ষমতা কমে গেলেও পিছিয়ে থাকেননি এই সাহসী নারীরা। আজও তারা সমান তালে শ্রম দিচ্ছেন এই সূচি কাজে।
রমিছা জানান, হামি খালি লয়, হামার ছোলের বউ, বিটি ও লাতিনরাও একন খ্যাতা (নকশিকাঁথা) সিলাই করে। হামিই ওরকোরোক এই কামোত লাগাচি। সগলি বসে না থ্যাকা কাম করলে বাড়তি কিছু কামাই হয়। যা দিয়্যা হামরা নিজেকেরে খরচ চালাবার পারি।
বৃদ্ধা আনোয়ারা জানান, তার চোখের দৃষ্টি কিছুটা কমে গেলেও হাতের গতি কমেনি। অল্প বয়সী মেয়েদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই সে কাজ করতে পারে এখনো। এক মাসে একটি নকশি কাঁথা সেলাই করতে পারেন তিনি। যার মজুরি মেলে ১২০০ থেকে ১৮০০ টাকা।
ধলমোহনী গ্রামের নাহারা, সীমা, নুরুন্নাহার, আফরোজা ও নাসিমা জানান, আগে তাদের ঘরে অভাব অনটন ছিলো নিত্য দিনের সঙ্গী। ছেলে মেয়ের বায়না পূরণ করার মতো ক্ষমতা ছিল না তাদের। আর এখন তারা নিজেরাই সচ্ছল। অনেকেই বাড়িতে হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল পালন করেন। ছেলে মেয়ের স্কুলের বেতন, প্রাইভেট পড়ার খরচও তাদের ওঠে এই সেলাই কাজ থেকেই।
এসব গ্রামের অভাবী নারীরা এখন আর কেউই বসে থাকে না। তারা সংসারের সব কাজ করার পর অবসরে এই সেলাইয়ের কাজ করে। সুচের ফোঁড়ে তারা আঁকছে কান্তজীর মন্দির, পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার এর গায়ের টেরাকোটার বা পাথরে খোদায় করা নক্সাগুলো। এই নক্সাগুলোতে রয়েছে মৌর্য, পাল, ক্ষত্রিয় রাজাদের শাসনামলের সংস্কৃতির ঐতিহ্যের চিহ্ন। হাতি-ঘোড়া, বর্ষা-ফলক, তীর ধনুকসহ প্রাচীন পৃথিবীর যুদ্ধের উপকরণ। কাঁথায় উঠে আসছে দেব-দেবীর মূর্তি। ৪র্থ শতক থেকে ১২’শ শতক পর্যন্ত যেসব উপখ্যান এখনও এ দেশের মাটিতে প্রোথিত আছে সেগুলোও এখন ফুটে উঠছে নকশি কাঁথায়।
আখলাজিরা গ্রামের বেবি বেগম নিজেও আগে ছিলেন একজন সূচিশিল্পী। এখন তিনি গ্রামের অন্যান্য মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেন। সেলাইয়ের নিয়ম কানুন, সুতা বাছাই সম্পর্কে শিক্ষা দেন। তিনি এখন পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের ফিল্ড সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করছেন।
বেবি জানান, অশিক্ষিত মেয়েদের প্রথমে অক্ষর জ্ঞান দেয়া হয়। এরপর হাতে কলমে শিক্ষা। একটি কাঁথা সেলাই করে একজন মজুরি হিসেবে আয় করেন সর্বনিম্ন ৮০০ থেকে ১৮০০ টাকা, চাদর ২০০ টাকা, কুশন ৬০ টাকা, বেড কভার ৬০০ টাকা, মানিব্যাগ ২৫ টাকা, কম্পিউটার কভার ১০০ টাকা, চশমা কভার ৫০ টাকা, ছাতা ১০০ টাকা, টেবিল ক্লথ ৪০০ টাকা, মাফলার ৬০ টাকা, শাড়ি ১৫০০ টাকা। সব মিলিয়ে একজন নারী সংসারে সব কাজ করার পর অবসরে কাজ করেও মাসে ২ হাজার টাকা আয় করতে পারেন।
তিনি জানান, একটা সময় ছিল যখন গাঁও গেরামের মেয়েরা সূচিকর্ম দিয়ে কাপড়ের উপর ফুল-পাখি প্রভৃতি নকশা একে ফটো বাঁধাই করে রাখতো। তুলা ও রং বেরং এর ফিতা দিয়ে ফুল বানাতো কাপড়ের উপর। পুরানো অনেক বাড়িতে গেলে এসব চিত্রকর্ম এখনো চোখে পড়বে। এসব শিল্পীরাই এখন আধুনিক পদ্ধতিতে নকশি কাঁথা সেলাই করছে।
বগুড়া পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের প্রধান সমন্বয়কারী আবু হাসানাত সাইদ জানান, আগে তেমন একটা কাঁথা দেশের বাইরে যেত না। এখন সেই পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। এখন সারা বছর যে পরিমাণ কাঁথা এবং অন্যান্য সামগ্রী সেলাই করা হয় তার প্রায় ৮০ ভাগই দেশের বাইরে চলে যায়।
তিনি জানান, রাজশাহী সিল্ক কাপড় দিয়ে তৈরি করা ৯ বাই ৯ ফিট একটি নকশি কাঁথার দাম বাংলাদেশের বাজারে ২৫ হাজার টাকা। আর বিদেশের বাজারে এই কাঁথা যে দামে বিক্রি হয় বাংলাদেশি টাকায় সেটার মূল্য দাঁড়ায় প্রায় দেড় লাখ টাকা। তবে দামের তারতম্যের এই বিশাল ফারাকের কারণে লাভবান হচ্ছেন মধ্যসত্ত্বভোগী বায়াররা। কারণ পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প সরাসরি পণ্য রফতানি করে না। বায়ারদের চাহিদা মোতাবেক নির্দিষ্ট একটি দামে পণ্য সরবরাহ করে থাকে।
সুচ সুতা দিয়ে গ্রামের দরিদ্র নারীদের পুর্নবাসন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধে স্বামী হারা নারীদের কিভাবে সংগঠিত করে বাড়তি আয়ের পথ করে দেয়া যায় সেই চিন্তা থেকেই এই কাজের সূচনা। এরপর ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় হস্ত শিল্পের প্রতিষ্ঠান পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প। বর্তমানে বগুড়ার ৩টি উপজেলার ২৫টিরও বেশি গ্রামে চলছে এই সূচি কাজ। কাঁথায় নানা রকম নকশা করে এসব এলাকার দরিদ্র নারীরা আয় করছে হাজার হাজার টাকা। এখন আর অভাব কি জিনিস তা তারা জানে না।
এসএস/জেএইচ/পিআর