‘দিবস দিয়ে কী করবো, কাজ করেই পেট চালাতে হয়’
দুপুর সোয়া ১টা। বাংলাদেশ টেলিভিশন, রামপুরা ভবনের সামনে এক নারী একটি ভ্যান সামনে রেখে বসে আছেন। একটু কাছে যেতেই চোখে পড়ে ভ্যানের ওপর পানি ভর্তি একটি ফিল্টার, একটি পানির জারের সঙ্গে কিছু লেবু আর গ্লাস রয়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এখানে লেবু-পানির শরবত তৈরি করা হয়। ওই নারী হয়তো ভ্যানটির কাছে এমনিই বসে আছেন- তাকে দেখে এমনটিই মনে হবে সবার। কিন্তু কেউ আছে কি-না জিজ্ঞেস করতেই বলেন, আমিই শরবত বিক্রি করছি ভাই, খাবেন?
সরেজমিনে দেখা যায়, ভ্যানটির পাশ দিয়ে শত শত মানুষ চলে যাচ্ছে। তিনি তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করছেন। তার অপলক দৃষ্টি জানিয়ে দিচ্ছে, হয়তো কেউ এসে বলবেন, এক গ্লাস শরবত দেন।
এবার কথায় কথায় পরিচয় জানা গেল, তার নাম পারুল। এক ছেলেসন্তানের জননী তিনি। পাঁচ বছর আগে অভাবের তাড়নায় কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসেন। প্রথমে বাসাবাড়িতে কাজ করতেন। করোনায় কাজ হারান। তারপর থেকে বিভিন্নভাবে আয়-উপার্জনের চেষ্টা করছেন। চলতি মাসের এক সপ্তাহ হলো এই লেবু-পানির শরবত বিক্রি করছেন। শরবত বিক্রির আয়েই একমাত্র ছেলেকে নিয়ে তার জীবনধারণ চলছে।
কেমন আয় হয় জানতে চাইলে পারুল বলেন, ‘সকাল থেকে মাত্র ৪০ টাকার শরবত বিক্রি করেছি। রাত ১০টা পর্যন্ত বেচা-বিক্রির পর হয়তো দেড়-দুশ টাকা হবে। গরম তো এখনো তেমন পড়েনি। লোকজন বাইরের খাবার আগের মতো খায় না, করোনার ভয়ও আছে। কিন্তু আমরা চলবো কী করে?’
নারী দিবসের কথা বলতেই পারুল এ প্রতিবেদককে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ভাই এই দিবস দিয়ে আমরা কি করবো? আমাদের কাজ করেই পেট চালাতে হয়। রাস্তায় বের না হলে তো আর খেতে পারবো না, বাড়ি ভাড়াও দিতে পারবো না, তখন ঢাকায় থাকাও হবে না।’
‘মা-বাবার কষ্ট দেখে ঢাকায় আসছিলাম। জামাই নেশা-পানি করে, খোঁজ-খবর রাখে না। তাই ছেলেকে নিয়ে বাঁচার জন্য কাজ করি’ বলতেই পারুল ছলছল চোখজোড়া ওড়না দিয়ে মোছার চেষ্টা করলেন।
রাজধানীর মালিবাগ, রামপুরা ও হাতিরঝিল এলাকা ঘুরে এরকম ভ্রাম্যমাণ একাধিক নারী কর্মজীবীর সঙ্গে জাগো নিউজের কথা হয়। তাদের কেউ ওজন মাপার মেশিন নিয়ে উপার্জনের চেষ্টা করছেন, কেউ আবার হালকা খাবার বিক্রি করছেন।
তারা বলেন, আমরা কোনো দিবস বুঝি না। প্রতিদিন কাজ করলে খেতে পারি, না করলে খাওয়া হয় না। আমরা দেখি, এদিন নারীরা রাস্তায় সেজেগুজে বের হয়, ঘোরাফেরা করে কত অনুষ্ঠান হয়! আমরা তো পেটের দায়ে এসব করতে পারি না। তাই সকাল থেকেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি আর আয়-উপার্জনের চেষ্টা করি।
টেলিভিশন ভবন থেকে সামনে এগোতেই হাতিরঝিলের প্রবেশমুখে চোখে পড়ে দুই নারী শরবত বিক্রি করছেন। এর পাশে আরেকজন চা-কফি বিক্রি করছেন। একজন ক্রেতার অপেক্ষায় তাদের সময় কাটে, কখন একজন আসবেন আর কিছু কিনবেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চোখে পড়ে- হাতেগোনা কয়েকজন মাঝে মাঝে এসে শরবত কিনছেন।
শরবত বিক্রেতা সুমাইয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভাই, মা-বাবার কষ্ট হয় তাই এখানে শরবত বিক্রি করছি। পড়াশোনা করতে পারিনি, কি আর করবো? শীতের সময়ে পিঠা বিক্রি করতাম, এখন তো গরম পড়ছে তাই লেবু-পানি নিয়ে বসছি। সারাদিন বেচাকেনা হলে কোনোরকম সংসার চলে যায়। আমারও ভালো লাগে যে, মা-বাবাকে সহযোগিতা করতে পারছি।’
আজ ৮ মার্চ নারী দিবস। সারাবিশ্বে দিবসটি পালিত হচ্ছে। এ বছর বাংলাদেশে ‘করোনাকালে নারী নেতৃত্ব, গড়বে নতুন সমতার বিশ্ব’ প্রতিপাদ্যে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালন করা হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তার বাণীতে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে নারী-পুরুষ সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এওয়াইএইচ/এআরএ/এএসএম