বাল্যবিয়ে রোধে প্রয়োজন আইনের যথাযথ প্রয়োগ
বিশ্বে প্রতি সাত সেকেন্ডে ১৫ বছরের কম বয়সী একটি কন্যাশিশুর বিয়ে হয়। বাংলাদেশে ১৮ বছরের আগে ৫৯ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় যায়। ১৫ বছরের আগে বিয়ে হয় ২২ শতাংশ মেয়ের। ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের শতকরা ৩১ জন সন্তানসম্ভবা হয়। কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য ও জীবন দক্ষতা প্রশিক্ষণ বিষয়ক এক অবহিতকরণ সভায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, অবশ্যই বাল্যবিয়েকে না বলতে হবে। বাল্যবিয়ের সঙ্গে যারাই জড়িত তাদের সবাইকে আইনের আওতায় এনে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কাজি, পুরোহিত এবং জনপ্রতিনিধিদেরও শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ভবিষ্যতে যারা বাল্যবিয়ের দাওয়াত খেতে যাবে তাদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশ্বে প্রতি সাত সেকেন্ডে ১৫ বছরের কম বয়সী একটি কন্যাশিশুর বিয়ে হয়। প্রতিবেদনে বলা হয় ১০ বছর বয়সী কন্যাশিশুদের অনেক বেশি বয়সী পুরুষদের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়। আফগানিস্তান, ইয়েমেন, ভারত, সোমালিয়াসহ বিভিন্ন দেশে এ ধরনের বিয়ের ঘটনা ঘটে। তবে ভারতে এ হার সবচেয়ে বেশি। কন্যাশিশুর বিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক।
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর অন্যতম একটি। বাংলাদেশে ১৮ শতাংশ মেয়ের ১৫ বছর বয়সের মধ্যে বিয়ে হয়। ইউনিসেফের মতে, বর্তমানে বিশ্বে ৭০ কোটি মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার। এ ধারা চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা বেড়ে ৯৫ কোটিতে পৌঁছাতে পারে।
সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৫ বছরের কম বয়সী বিবাহিত মেয়েদের ২০ শতাংশ ২৪ বছর বয়স হওয়ার আগেই দুই বা ততোধিক সন্তানের মা হচ্ছেন। ফলে প্রসূতির মৃত্যুর হার এবং অপুষ্টিজনিত সমস্যা প্রকট হচ্ছে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক হেল্থ সার্ভের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এক দশক ধরে বাংলাদেশে ৬৬ শতাংশ ক্ষেত্রে ১৯ বছর বয়সের আগেই বাল্যবিয়ের শিকার নারীরা অন্তঃসত্ত্বা হচ্ছে।
বাল্যবিয়ে নিয়ে আমাদের দেশে অনেক বিতর্ক রয়েছে। যদিও বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে মানুষ অনেক বেশি সচেতন। তারপরও দেশ থেকে এই ব্যাধি পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ের হারের লজ্জা বাংলাদেশের। বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় এ হার সর্বোচ্চ। শিশুদের জীবনমানের উন্নয়ন ভবিষ্যৎকে বদলে দেয়া শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এ কথা ঠিক বাল্যবিয়ের ফলে কন্যাশিশুরা শিক্ষা, উন্নয়ন ও শিশু হিসেবে বড় হওয়ার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যদি বলা হয়, ক্যান্সার, হৃদরোগ বা অন্যান্য জটিল ও প্রাণঘাতী রোগের চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর বাল্যবিয়ে- তাহলে খুব একটা ভুল বলা হবে বলে মনে হয় না। কারণ প্রাণঘাতী রোগে একজন আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু বা ক্ষতি হয়। কিন্তু বাল্যবিয়ে একটা মেয়ে ও তার প্রজন্মকে নিঃশেষ করে দেয়।
সরকার বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধের জন্য জাতীয়, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা এবং স্থানীয় পর্যায়ের গণ্যমান্য ব্যক্তির সমন্বয়ে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটি গঠন করতে হবে। আমাদের মা-বাবাকে সচেতন হতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব, আইইএম ইউনিটের পরিচালক, লাইন ডাইরেক্টর আইইসি আশরাফুন্নেসা বলেন, আমাদের সমাজে শতকরা ৫৯ ভাগ বাল্যবিয়ে হচ্ছে। এটা একটি রাষ্ট্রর জন্য হুমকিস্বরূপ। এতে কিশোরীরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে যায়। সবসময় অসুখ লেগেই থাকে। সমাজে বাল্যবিয়ের কুফলের বিষয় জনগণকে সচেতন করছি। এ নিয়ে আমরা বিভিন্ন ক্যাম্পেইন চালাচ্ছি।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জিএম মিজানুর রহমান বলেন, দেশের প্রচলিত আইনে বাল্যবিয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দায়ীদের সর্বোচ্চ দুই বছরের জেল অথবা দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান আছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুচলেকা দিয়ে বিষয়টি মীমাংসা করা হয়। বাল্যবিয়ে রোধে প্রচলিত আইন প্রয়োগে করতে হবে। এছাড়া এ বিষয়ে আরো কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।
আইনজীবী কাজী রওশন আরা শিকদার ডেইজী বলেন, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কাজী, পুরোহিত এবং জনপ্রতিনিধিদেরও শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
তিনি বলেন, বাল্যবিয়েকে না বলতে হবে। এর সঙ্গে যারাই জড়িত তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে। ভবিষ্যতে যারা বাল্যবিয়ের দাওয়াত খেতে যাবে তাদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
জেএ/এসএইচএস/এমএস