টিলার উপর হজমটিলা
জীবন পাল
মৌলভীবাজার জেলার ৭ উপজেলার মধ্যে শ্রীমঙ্গলের আবহাওয়া যেন সব ঋতুর পালাবদলেই ভিন্ন রূপ ধারণ করে। আর তা উপভোগেই হঠাৎ করে সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম অবসর সময়টাকে কাজে লাগাতে হজমটিলায় যাব। শ্রীমঙ্গলের রাজঘাট ইউনিয়নের বিদ্যাবিল এলাকায় অবস্থিত এই হজমটিলা। যে ই ভাবা সে ই কাজ।
প্রত্যেকে যে যার বাসায় দুপুরের খাবার শেষ করে সাড়ে ৩টায় ক্যাফে লকডাউনে এসে হাজির হলো। প্রথমে রাব্বি ও রুবেল, তাদের চলে আসায় ইমনও বাসা থেকে বেরিয়ে তাদের সঙ্গে বসে বাকিদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো। এর মধ্যে আমিও গিয়ে তাদের দলে যোগ দিলাম।
কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আমরা ৪ জন হলেও মোটরসাইকেল কিন্তু একটিই। এর মধ্যে উত্তমের মোটরসাইকেলে করে রাজিব ও সুজনের মোটরসাইকেলে করে অপুর আগমণ ঘটে। ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল প্রায় ৪টা।
দেরি না করে ৩টি সাইকেলে ভাগাভাগি করে ৮ জন বসে রওয়ানা দিলাম। রাব্বির সঙ্গে রুবেল, উত্তমের সঙ্গে রাজিব ও সুজন। আর ইমনের সঙ্গে আমি ও অপু। সুজন ও উত্তম তাদের সাইকেলে তেল ভরে নিয়ে আসলেও রাব্বির সাইকেলে তেল ভরা হলো ফুলছড়া গিয়ে। তারপর টানা যাত্রা শুরু।
শ্রীমঙ্গল শহর থেকে হজমটিলার দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার হবে। রামনগর, ফুলছড়া, কালীঘাট, জানাউড়া, ফুসকুড়ি, কেজুরী ছড়া হয়ে ডিনস্টন ফ্যাক্টরির সোজা রাস্তা ধরে ছুটলাম হরিণছড়ার দিকে। হরিণছড়া ঢুকতেই প্রকৃতি যেন নিজ আয়োজনেই আমাদেরকে স্বাগত জানানো শুরু করে দিলো।
আবহাওয়ার রূপের বদলটা শুরু এখান থেকেই। চারদিকে সারি সারি চা বাগান, সবুজ ঘেরা গাছ আবহাওয়াকে শীতল করে রেখেছে। শহরের অসহ্য গরম যেন এখানে এসে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছে। কিছুদূর যেতেই একসঙ্গে দু’টি সাইনবোর্ড চোখে পড়লো। একটিতে লেখা ছিল- বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ হরিণছড়া বিওপি আর অপরটিতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ নিরালা পুঞ্জি বিওপি।
আমরা নিরালা পুঞ্জি বিওপির রাস্তা ধরে চলতে লাগলাম। এদিক দিয়েই হজমটিলা যেতে হয়। কিছু দূর যেতেই বুঝতে দেরি হলো না যে আমরা হরিণছড়া চা বাগানের চা শ্রমিক কলোনিতে প্রবেশ করে ফেলেছি। কমিউনিটি ক্লিনিকঘেঁষা মাঠের পাশের রাস্তা দিয়ে চললাম।
মোড় নিয়ে সোজা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ইমনের থেকে জানতে পারলাম, হাতের বামের রাস্তা ধরে গেলে ঝাউবন। হাতে সময় না থাকায় ঝাউবন দেখার ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারলাম না। আঁকাবাকা রাস্তা ধরে যাওয়ার সময় ডানদিকে সারি সারি কিছু গাছের মধ্যে পানপাতার মতো গাছ দেখে চোখ আটকে গেল। জানার কৌতূহল জাগলো। সামনে এগিয়েই স্থানীয় দুই চা শ্রমিককে বসে গল্পে মজে থাকতে দেখলাম।
সামনে থাকা সেই গাছ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে বসলাম- এসব গাছ কিসের? তাদের থেকে জানতে পারলাম- এসব গাছ গোল মরিচের। চা বাগান কর্তৃপক্ষ এসব গাছ লাগিয়েছেন। ইমন ও অপুর থেকে জানতে পারলাম এটাই নাকি চুইঝালের গাছ। এই গাছের শেকড় থেকেই চুইঝাল হয়ে থাকে। সেজন্য মোটরসাইকেল থেকে নেমে কয়েকটি ছবি তুলতে আর দেরি করলাম না।
সামনে দুই রাস্তার মোড়। বাম পাশের সাইনবোর্ডে লেখা ছিল নিরালা পুঞ্জি বিওপি। মানে বাম দিকে নিরালা পুঞ্জির যেতে হয়। সেদিকে না গিয়ে আমরা সোজা রাস্তা দিয়ে যাব। সেই রাস্তায় একটা খালের উপর ভাঙা সেতু। দেখলাম বাঁশ, কাঠ ও গাছের টুকরো দিয়ে পারাপারের ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে।
- আরও পড়ুন
- বৃষ্টিস্নাত দুপুরে ‘ঢাকাইয়া কাচ্চি’র ডিম খিচুড়ির স্বাদ
- নেত্রকোনা ভ্রমণে ঢুঁ মারুন মেঘালয়ের পাদদেশে
খুব সাবধানে আমরা পার হলাম। চা বাগানের ভেতরের আঁকাবাঁকা রাস্তাগুলো যে কারও নজর কাড়বে। যদিও মোটরসাইকেলের চাকা স্লিপ করছিল। সেজন্য কিছুটা পথ আমরা প্রত্যেকেই মোটরসাইকেল থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে পার হলাম। অল্প কিছু দূর পর আবার নেমে গেলাম। কেননা সামনে খাঁড়া টিলা। বাগানের ভেতর এরকম একটা টিলাও যেন প্রকৃতির জন্য বাড়তি সৌন্দর্য।
টিলাতে উঠতে রোমাঞ্চকর মনে হলেও, মোটরসাইকেলের জন্য সেটা ঝুঁকিপূর্ণ ও ভয়ানক বলতেই হবে। খুব দক্ষ চালক না হলে বাইক নিয়ে টিলার উপর উঠতে অনুৎসাহিত করবো। আমাদের সঙ্গে যারা ছিলেন, তারা প্রত্যেকেই দক্ষ চালক হওয়ায় মোটরসাইকেল নিয়ে টিলাটি উঠতে পেরেছেন খুব সহজেই।
আমরা বাকিরা হেঁটে হেঁটেই টিলার উপর উঠে পড়লাম। উপরে উঠেই যেন অন্য এক পৃথিবী আমাদেরকে স্বাগত জানালো। এ যেন সবুজের অরণ্য। চারদিকে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ ছাড়া দু’চোখে আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল। তার মধ্যে টিলার উপর পাহাড়ি রাস্তা। সবকিছু মিলিয়ে অপরুপ এক দৃশ্যের মাঝখানে আমরা উপস্থিত।
না, এখানেই শেষ নয়। মূল জায়গায় যেতে হলে আরো ২/৩ টা টিলা পাড়ি দিতে হবে। সবাই ক্লান্ত অনুভব করলেও অল্পের জন্য কেউই মনোবল হারাতে নারাজ। তাই ১০-১২ মিনিটের মধ্যে সামনের উঁচু-নিচু টিলা পাড়ি দিয়ে সবাই পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্য সেই হজমটিলায়। তখন ঘড়ির কাঁটায় ৬টা ছুঁই ছুঁই।
তখনও কিন্তু সূর্য মামা তার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছিল। তাই মোটরসাইকেলগুলো একপাশে রেখে তড়িঘড়ি করে যে যার মতো করে ছবি তোলা শুরু করে দিলাম। চারপাশের দৃশ্যটা নিজ চোখে না দেখলে আসলে লেখার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে বুঝানো সম্ভব নয়। এক কথায় দূর থেকে যতদূর চোখ যাচ্ছিল শুধু সবুজ আর সবুজ।
ভারত সীমান্ত খুব কাছেই। সন্ধ্যা নামার পর নাকি সীমান্তের ওপারের বাড়িঘরের ঝলমলে আলো এখান থেকেই স্পষ্ট দেখা যায়। জানতে পারলাম সীমান্তের ওপারের এলাকার নাম ‘মনাইবাড়ি’। আর হরিণছড়া দিয়ে হজমটিলায় আসলেও হজমটিলার এই স্থান পার্শ্ববর্তী বিদ্যাবিল চা বাগানের আওতাধীন।
কেউ চাইলে এদিক দিয়ে না এসে রাজঘাট, বিদ্যাবিল হয়ে ঘুরেও হজমটিলায় যেতে পারবেন। টিলার উপর নেটওয়ার্ক পাওয়া গেলেও স্বাভাবিকভাবে এসব সীমান্ত এলাকায় নেটওয়ার্ক পাওয়াটা সহজ নয়। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে হজমটিলা পৌঁছাতে আমাদের সময় লেগেছিল প্রায় ২ ঘণ্টা।
বিকেল ৪টায় রওয়ানা দিয়ে ৬টা নাগাদ আমরা হজমটিলা পৌঁছাতে পেরেছিলাম। প্রায় আধা ঘণ্টা টিলার প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে গিয়েছিলাম। এর মধ্যে সূর্য মামা আমাদেরকে বিদায় জানাতে বাধ্য হলো। যার কারণে আমরাও হজম টিলাকে বিদায় জানিয়ে দিলাম।
তখন ঘড়ির কাঁটায় ৬টা ৩৭ মিনিট। একে একে প্রতিটি টিলা পাড়ি দিয়ে এবার নিচে নামার পালা। টিলাগুলোতে ওঠার থেকে নামা বেশি ভয়ংকর ও ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়েছে। সাবধানতা অবলম্বন করে প্রথমে মোটরসাইকেল চালিয়ে নামানো হলো। তারপর একে একে আমরা।
অন্ধকার না নামলেও টিলার নিচে নামতেই চা বাগানের ভেতরে ঝিঁঝি পোকারা ডাকতে শুরু করে দিয়েছিল। চা বাগানের আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে ফেরার সময় মাঠ থেকে গরুর দল নিয়ে রাখাল ছেলের বাড়ি ফেরার দৃশ্য চোখে পড়লো। আরও চোখে পড়লো রান্নার জন্য লাকড়ি ও গরুর জন্য ঘাস নিয়ে ফেরা দিনমজুরের।
মাঠে খেলছিল একদল যুবক। মাঠ পেরিয়ে চা বাগানের বসতবাড়ি পার হতে হতে প্রতিটি বাড়িতে বৈদ্যুতিক বাতির আলো জ্বলে উঠলো। হারিকেন বা কুঁপিবাতির আলো এখন এরকম সীমান্ত এলাকার জন্যও অতীত হয়ে গেছে। হরিণছড়া এলাকাটি পার হতে হতে অন্ধকার আমাদেরকে ঘিরে ধরেছিল।
ফেরার পথেই সিদ্ধান্ত হলো আমরা কেজুরী ছড়া দূর্গামন্দিরের পাশে বিশ্বজিতের ডালপুরির দোকানে বিরতি নিয়ে ডালপুরি ও পেঁয়াজু খাবো। সেটাই করা হলো। আমরা যখন বিশ্বজিতের দোকানে পৌঁছায়, তখন ঘড়ির কাঁটায় ৭টা বেজে ৬ মিনিট। পাশের টিউবওয়েলে সবাই হাত-মুখ ধুয়ে ঠান্ডা পানি পান করে চেয়ারে বসতে না বসতেই গরম গরম ডালপুরি ও পেঁয়াজু হাজির।
ভেজে দিতে না দিতেই সাবাড় হয়ে যাচ্ছে। এরকম চলতে থাকলো ৪/৫ রাউন্ড। খাওয়া দাওয়া শেষ করে শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করতে করতে সময় গিয়ে দাঁড়ালো ৭টা ৫৬ মিনিটে। চারপাশে বিভিন্ন যানবাহনের হেডলাইট জ্বালিয়ে আসছে যাচ্ছে। আমরাও থেমে নেই।
একে একে কেজুরী ছড়া, ফুসকুড়ি, জানাউড়া, কালীঘাট, ফুলছড়া হয়ে রামনগর এসে থামলাম। যখন ঘড়ির কাঁটায় ৮ টা বেজে ১৬ মিনিট। এবার যে যার মতো করে নিজ নিজ বাড়ির উদ্দেশ্য রওয়ানা। আমাদের হজমটিলা অভিযান সফল।
জেএমএস/জিকেএস