মিরসরাই ভ্রমণে রূপসী-খৈয়াছড়া’সহ ঘুরে দেখুন ৮ ঝরনা
এবারের ঈদের টানা ছুটিতে ঘুরে আসুন অপরূপ পাহাড়ি ঝরনার লীলাভূমি হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ৮ ঝরনায়। বর্ষায় ঝরনাগুলো আপন রূপে ফিরেছে। ঝরনার পাশাপাশি উপজেলার অন্যান্য পর্যটন স্পটও ঘুরে দেখতে পারবে ভ্রমণপিপাসুরা।
মিরসরাই উপজেলা ঝরনার রানি হিসেবে পরিচিত। আর এ কারণে দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিন সেখানে ছুটে যান পর্যটকরা। এবারের ঈদের ছুটিতেও পর্যটকদের ভিড় বাড়ছে খৈয়াছড়া ঝরনা, রূপসী ঝরনা, হরিনাকুণ্ড ঝরনা, নাপিত্তাছড়া ঝরনা, সোনাইছড়ি ঝরনা, বোয়ালিয়া ঝরনা, সোনাইছড়ি ঝরনা ও মেলখুম ট্রেইলে।
এক খরচেই পর্যটকরা দেখার সুযোগ পাচ্ছেন পাহাড়ের ঝরনা ও সমুদ্র। এ যেন এক ঢিলে দুই পাখি শিকার। ‘রথ দেখা ও কলা বেচা’র মতোই পাহাড় দেখতে এসে দেশের দূর দূরান্তের পর্যটকরা বোনাস হিসেবে পাচ্ছেন সমুদ্র তীরে সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ।
রূপসী ঝরনা
প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের আরেক নাম বড় কমলদহ রূপসী ঝরনা। আঁকাবাঁকা গ্রামীণ সবুজ শ্যামল মেঠো পথ পার হয়ে পাহাড়ের পাদদেশে গেলেই শোনা যাবে ঝরনার পানি গড়িয়ে পড়ার অপরূপ নুপুরধ্বনি। দুই পাশে সুউচ্চ পাহাড়। উঁচু পাহাড় থেকে অবিরাম শীতল পানি গড়িয়ে যাচ্ছে ছড়া দিয়ে।
রূপসী ঝরনা প্রথম দেখেই তার রূপে পাগল হবে যে কেউ। মেঘের মতো উড়ে আসা শুভ্র এ পানি আলতো করে ছুঁয়ে দেখলেই এর শীতল পরশ মুহূর্তে ক্লান্তি ভুলিয়ে দেবে। টলটলে শান্ত পানির চুপচাপ বয়ে চলার ধরনই বলে দেবে এর উৎস অবশ্যই বিশাল কিছু থেকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পর্যটকেরা আবিষ্কার করবেন লাল-নীল রঙের ফড়িঙের মিছিল! যত দূর পর্যন্ত ঝিরিপথ গেছে তত দূর পর্যন্ত মন মাতানো ঝিঁঝি পোকার গুঞ্জন শোনা যায়। রূপসী ঝরনার পানিতে গোসল করার লোভ সামলানো কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।
বছরের পর বছর ঝরনার পানি গড়িয়ে যাচ্ছে এই ছড়া বয়ে। কয়েক বছর পূর্বেই রূপসী ঝরনা আবিষ্কার করা হয়। মিরসরাই উপজেলার সর্ব দক্ষিণে বড় দারোগারহাটের উত্তরে পাহাড়ের কোল অবস্থিত এক দৃষ্টিনন্দন, অনিন্দ্যসুন্দর এক জলপ্রপাত।
মিরসরাইয়ের অন্যান্য ঝরনাগুলোর চেয়ে এই ঝরনায় যাওয়া অনেকটাই সহজ। সৌন্দর্যে কোনো অংশেই খৈয়াছড়া, নাপিত্তাছড়া ঝরনার চেয়ে কম নয় এটি।
রূপসী ঝরনায় যাবেন কিভাবে?
দেশের বিভিন্ন স্থান হতে যে কোনো বাসযোগে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বড়দারোগাহাট বাজারে নামবেন। এরপর সিএনজি বা অটোরিকশা নিয়ে বাজারের উত্তর পাশের ব্রিকফিল্ড সড়ক দিয়ে পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত যাবেন।
এরপর পায়ে হেঁটেই ঝরনা পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। অথবা যে কোনো বাস থেকে ব্রিকফিল্ড সড়কের মাথায় নেমে অটোরিকশা ছাড়াই আধা কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে পৌঁছাতে পারবেন রূপসী ঝরনায়।
আরও পড়ুন
খৈয়াছড়া ঝরনা
ঝরনা বা জলপ্রপাতের কলকল শব্দ মনে এক শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। বর্ষায় ঝরনার আকর্ষণ অন্য সময়ের তুলনায় বাড়তি থাকে। তাই পর্যটকদেরও ঢল নামে। এবারের ঈদে অনেক পর্যটক খৈয়াছড়া ঝরনা দেখতে আসবেন বলে আশাবাদী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নুর উদ্দিন।
আকার আকৃতি ও গঠনশৈলির দিক দিয়ে বেশ বড় এই ঝরনা। এর মোট ৯টি মূল ধাপ ও অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন ধাপ আছে। প্রকৃতির নান্দনিক তুলিতে আঁকা সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছে দেশের ভ্রমণপিপাসুরা।
অনেকে রাতের বেলায় চাঁদের আলোয় ঝরনার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পাহাড়ের পাদদেশে তাবু টাঙিয়ে অবস্থান করেন। প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি সেতুবন্ধন করে, সবুজের চাদরে ঢাকা বনানী রূপের আগুন ঝরায়। যেখানে প্রকৃতি খেলা করে আপন মনে।
ঝুম ঝুম শব্দে বয়ে চলা ঝরনাধারায় গা ভিজিয়ে মানুষ যান্ত্রিক জীবনের অবসাদ থেকে নিজেকে ধুয়ে সজীব করে তোলে। খৈয়াছড়ায় আছে অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন ধাপ, যা বাংলাদেশের আর কোনো ঝরনাতে এখনো পর্যন্ত দেখা যায়নি। তাই খৈয়াছড়াকে বলা হয় বাংলাদেশের ঝরনার রানি।
মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া গ্রামের সবুজ শ্যামল আঁকাবাঁকা মেঠো পথ পেরিয়েই দেখা মিলবে বিস্ময়কর ঝরনার। খৈয়াছড়া এলাকার পাহাড়ে অবস্থান বলে এর নামকরণ করা হয়েছে খৈয়াছড়া ঝরনা। মিরসরাই উপজেলার খৈয়াছড়া ইউনিয়নের বড়তাকিয়া বাজারের উত্তর পাশে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ৪.২ কিলোমিটার পূর্বে ঝরনাটির অবস্থান।
এর মধ্যে এক কিলোমিটার পথ গাড়িতে যাওয়ার পর বাকি পথ যেতে হবে পায়ে হেঁটে। বাঁশের সাঁকো, ক্ষেতের আইল, আঁকাবাকা পাহাড়ি পথ, ছড়া, অন্তত ৪টি পাহাড় পেরিয়ে যখন ঝরনার পানিতে গা ভেজাবেন, তখন মনে হবে পথের এই দুরত্ব খুব সামান্য। টলটলে শান্ত পানির চুপচাপ বয়ে চলার ধরনই বলে দেবে এর উৎস অবশ্যই বিশাল কিছু থেকে।
সেখানে আশপাশের বহুদূর বিস্তত পাহাড় আর জঙ্গলের অপূর্ব দৃশ্য কিছুক্ষণের জন্য হলেও আপনাকে ভুলিয়ে দেবে আপনার পরিশ্রম আর নিরাপদে নিচে ফিরে যাওয়ার ভাবনার কথা। ঝরনায় যাওয়ার সড়কটি দারুণ মনোমুগ্ধকর। গাড়ির রাস্তা পার হয়ে যখন হাঁটা শুরু করবেন এর চারপাশের দৃশ্য দেখে আপনি মুগ্ধ হতে বাধ্য হবেন। খানিকক্ষণ উঁচু-নিচু রাস্তা পার হয়ে একসময় এসে পড়বেন পাহাড়ি ঝিরিপথে।
এরপরই শুরু হবে আপনার আসল অ্যাডভেঞ্চার। আপনাকে ঝিরিপথ ধরেই এগিয়ে যেতে হবে। কখনো হাঁটুপানিতে পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটবেন, তো সেই পানিই কখনো কখনো আপনার কোমর ছাড়িয়ে বুক পর্যন্ত উঠে আসবে। আনুমানিক দেড় ঘণ্টার মতো হাটার পর আপনি ঝরনার কাছে পৌঁছে যাবেন।
এরপর যখন খৈয়াছড়ার দর্শন পাবেন, তখন বিস্ময়ে অভিভূত না হয়ে পারবেন না। এই ঝরনার পানিতে গোসল করার লোভ সামলানো কারো পক্ষেই সম্ভব না। সুতরাং দেরি না করে নেমে পড়তে পারেন ঝরনার শীতল পানিতে। ঝরনার বাম দিক থেকে ডানদিক অপেক্ষাকৃত গভীর।
কীভাবে যাবেন খৈয়াছড়া ঝরনায়?
ঢাকার যে কোনো বাস কাউন্টার থেকে চট্টগ্রামগামী বাসে উঠবেন। যাওয়ার পথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাই পৌরসদর পার হয়ে বড়তাকিয়া বাজারের আগে খৈয়াছড়া আইডিয়াল স্কুলের সামনে নামবেন।
ঢাকার ফকিরাপুল, সায়দাবাদ থেকে সোহাগ পরিবহন, গ্রীণ লাইন পরিবহন, সৌদিয়া পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, টি আর ট্রাভেলসের বাস যায় চট্টগ্রাম। এছাড়া শ্যামলী, হানিফ, সৌদিয়া, ইউনিক, এস আলম ইত্যাদি পরিবহনের নন এসি বাসও চলে এ পথে।
বারৈয়ারঢালা রেঞ্জের সবগুলো ঝরনার ইজারা পেয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এএইচ এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধায়ক নাজমুল হাসান বলেন, ‘এবারের ঈদের ছুটিতে ঝরনাগুলো ভালো পর্যটক আসবেন বলে আশাবাদী। তবে পর্যটকদের কাছে অনুরোধ থাকবে তারা যেন সঙ্গে গাইড নিয়ে যান। গাইড ছাড়া গেলে হয়তো অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সব পর্যটককে সঙ্গে গাইড নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি, ঝরনার ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে না যাওয়া, বিকেল ৫টার মধ্যে ঝরনা থেকে নিচে নেমে আসাসহ বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকি।’
এছাড়া এবারের ছুটিতে পর্যটকদের আগমন বাড়বে হরিনাকুণ্ড ঝরনা, নাপিত্তাছড়া ঝরনা, সোনাইছড়ি ঝরনা, বোয়ালিয়া ঝরনা, সোনাইছড়ি ঝরনা ও মেলখুম ট্রেইলে।
জেএমএস/জিকেএস