মেলখুম ট্রেইলে পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ হলো যে কারণে
এম মাঈন উদ্দিন
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রামের মিরসরাই। এখানকার পাহাড়ে আছে অসংখ্য প্রাকৃতিক ঝরনা। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভ্রমণপ্রিয় মানুষ এখানে ছুটে আসছেন। সর্বশেষ বছর দুয়েক আগে আবিষ্কার হয় মেলখুম ট্রেইলের।
উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের সোনাপাহাড়ের গহীন পাহাড়ের এ গিরিপথ নিয়ে রহস্যের যেন শেষ নেই। কি আছে সেখানে? কেন এতোটা কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয় সেখানে যেতে হয়? কেন এতোটা আকর্ষণীয় এ গিরিপথ? সত্যিই কি সেখানে জ্বিন বসবাস করে?
আরও পড়ুন: যে দেশে কনে যায় বিয়ে করতে, ধূমপান করলেই হয় জেল
এমন সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই গহীন পাহাড়ের আঁকা-বাঁকা, বেশ পিচ্ছিল, গভীর খাদের ঝিরিপথ, অন্ধকারাচ্ছন্ন ও বিপজ্জনক সুউচ্চ পাহাড়ের কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে মেলখুমে পৌঁছায় দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসা পর্যটকরা। তবে দিনে দিনে সেখানে ঘটছে নানা অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা। প্রায়শ পর্যটকরা সেখানে আটকা পড়ছেন। হারিয়ে যাচ্ছেন।
৯৯৯ এ কল করে জানাচ্ছেন হারিয়ে যাওয়ার কথা। দীর্ঘ ৭-৮ ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে পুলিশকে পর্যটকদের উদ্ধার করছেন। আবার অনেকে সেখান থেকে ফেরার পর নাকি শরীরে জ্বিন আছর করছে। যাদের জীবনে নেমে আসছে এক দূর্বিসহ যন্ত্রণা।
এসব কারণে এবার মেলখুম ট্রেইলে পর্যটকদের প্রবেশ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে সেখানে প্রবেশ না করতে পর্যটকদের নিরুৎসাহিত করতে শুরু করেছে মিরসরাই রেঞ্জ বন বিভাগের কর্মকর্তারা।
আরও পড়ুন: রেমা-কালেঙ্গা ঘুরে আসুন মাত্র ১৫০০ টাকায়
এই স্থানের নামকরণ সম্পর্কে স্থানীয়রা জানান, পাহাড়ি ছড়ায় মেল গাছের লতা কেটে দিলে মাছ মারা যেত। পরদিন সকালে সেই মাছ কুড়িয়ে নিত শিকারিরা। মেল গাছের লতা ছড়ার পানিতে যতদূর ছড়িয়ে পড়ত ততদূর সব মাছ মারা যেত। এভাবেই জায়গাটির নাম মেলখুম বা মেলকুম হিসেবে পরিচিত পায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের সোনাপাহাড় এলাকায় গহীন পাহাড়ে অবস্থিত মেলখুম ট্রেইল। মেলখুমে যেতে সমতল ভূমি থেকে আড়াই থেকে তিন কিলোমিটারের পথ পাড়ি দিতে হয়। যেতে সময় লাগে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। এ পথটি অত্যন্ত বিপজ্জনক।
মেলখুমে প্রবেশের পথটি আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা এ পথটি অত্যন্ত পিচ্ছিল, ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন, আছে গভীর খাদও। সেখানে সূর্যের আলো পৌঁছায় না। স্থানীয়রা এটিকে মৃত্যুকূপ হিসেবে অভিহিত করেছে। এটির প্রবেশ পথের দু’পাশে অন্তত ২০০ ফিট উঁচু পাহাড় আড়াআড়িভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
আরও পড়ুন: ৫২ প্রজন্ম ধরে চলছে বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো হোটেল
চলার পথটি বেশ সরু। সেখানে একবার কেউ পড়ে গেলে বা আটকা পড়লে তাকে সহজে উদ্ধার করা সম্ভব নয়। এছাড়া মেলখুম কূপে দিনের বেলায় ঘন অন্ধকার থাকে। অত্যন্ত গভীর হওয়ায় কূপটি বেশ ভয়ানক।
স্থানীয়ভাবে এ কূপটি নিয়ে লোকমুখে নানা কথা প্রচলিত আছে। অনেকের মতে, সেখানে জ্বিন বসবাস করে। কূপটিকে জ্বিনের আস্তানাও বলা হয়। প্রচলিত আছে, সেখানে যাতায়াত করা মানুষদের উপর জ্বিন আছর করে। পরবর্তী সময়ে তাদের জীবনে দুঃখ-কষ্ট নেমে আসে।
আবার অনেকের মতে মেলখুম কূপে মানুষ হারিয়ে যায়। এমন অনেকেই আছেন যাদেরকে আর পাওয়া যায়নি। তবে বাস্তবে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা এসব কথার ভিত্তি মজবুত করেছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মেলখুমে ঘুরতে এসে ভয়াবহ ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতির শিকার হওয়ার কথা একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান পর্যটক মো. রাকিব ও রাকিবুল হাসান।
তারা জানান, মেলখুমে গিয়ে তারা একাধিকবার অশরীরী আত্মার মতো কিছুর দেখা পেয়েছেন। তারা মানুষ সদৃশ্য এমন কিছু দেখেছেন, যা আজও ভুলতে পারছেন না। বেশ কয়েকবার সেটিকে ভাই বলে ডাক দিলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। সেখানে গিয়ে তারা বেশ ভয় পেয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: অবিশ্বাস্য ‘লাল নদী’ দেখলেই জুড়াবে চোখ
ভয়ে তারা পুরো গিরিপথ অতিক্রম না করেই ফিরে আসেন। যেখানে তাদের ব্যাগটি রেখেছিলেন ফেরার পথে দেখেন ব্যাগটি অনেক দূরে কাদায় ছুড়ে মারা হয়েছে। তাদের মতে, কেউ যদি চুরির উদ্দেশ্য তাদের ব্যাগটি ধরেন ,তাহলে তা নিয়ে যাবেন না হলে ব্যাগের মূল্যবান জিনিসপত্র হাতিয়ে নিবেন।
তবে তা না করে অত্যন্ত বাজেভাবে ব্যাগটিকে অনেক দূরে ছুড়ে মারা হয়েছে। রাকিবরা আরও জানান, মেলখুম অত্যন্ত ভয়ানক ও অন্ধকারাচ্ছন্ন। সেখানে সূর্যের আলো পৌঁছায় না। বন্যপ্রাণি আক্রমণের শিকার হওয়ার সম্ভবনাও আছে। এসব ঘটনা তাদের ক্যামেরায় ধরা পড়েছে বলেও জানান তারা।
কেবল রাকিবরাই নন, মিরসরাইয়ের মেলখুম ট্রেইলে গিয়ে বিপদগ্রস্থ হয়েছেন আরও অনেক পর্যটক। এই ঈদুল ফিতরের ছুটিতে মেলখুমে ঘুরতে এসে দুই দফায় আটকা পড়েন ১৩ পর্যটক। পরে জোরারগঞ্জ থানা পুলিশ ৮ ঘন্টা অভিযান চালিয়ে তাদেরকে উদ্ধার করে।
আরও পড়ুন: কালের সাক্ষী ৬০০ বছর পুরোনো ‘ডিভোর্স মন্দির’
মিরসরাই বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা শাহ নেওয়াজ নওশাদ বলেন, ‘মেলখুম ট্রেইল বিপদজনক বিধায় সেখানে পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অনেক পর্যটক সেখানে গিয়ে বিপদে পড়ছেন। এরই মধ্যে আমরা মেলখুমের বিভিন্ন প্রবেশ পথে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি, সাইনবোর্ড টাঙিয়েছি।’
‘পর্যটকদের বারবার সতর্ক করা হচ্ছে মেলখুমে না যেতে। পাহাড়ে আমাদের নিরুৎসাহিতকরণ অভিযান অব্যাহত আছে। এরপরও কিছু পর্যটক ভিন্ন পথ অবলম্বন করে মেলখুম গিরিপথে যাচ্ছেন। কেউ যদি সেখানে গিয়ে কোনো বিপদে পড়েন তাহলে আমরা তার দায় নিব না। চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ও উপ বন সংরক্ষক মোজাম্মেল হক শাহ চৌধুরী এ আদেশ দিয়েছেন।’
লেখক: ভ্রমণ লেখক
জেএমএস/জিকেএস