দুবাইয়ের লাভ লেকে সযত্নে গড়া ভালোবাসা
ভালোবাসা একটি আদিম, অকৃত্রিম ও পবিত্র অনুভূতি। এ ভালোবাসার কারণেই মানুষ হাসে, কষ্টে ভাসে কিংবা বেঁচে থাকার প্রেরণা পায়। ভালোবাসা নিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘ভালোবেসে সখি নিভৃত যতনে আমার নামটি লিখ তোমার মনেরও মন্দিরে’। শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন, যুগে যুগে যত জ্ঞানী-গুণী, কবির আবির্ভাব হয়েছে; তারা সবাই কবিতার মাধ্যমে প্রেম-ভালোবাসার স্লোগান ধরেছেন।
ভালোবাসাকে সদা জাগ্রত রাখতে মানুষের চেষ্টার অন্ত নেই। সে রকমই এক চেষ্টার সফল ও আশ্চর্যজনক মানবসৃষ্টি দুবাইয়ের মরুভূমির মধ্যে ‘লাভ লেক’ বা ভালোবাসার হ্রদ। এর পাশেই আছে ফ্লেমিংগো লেক, আল কুদ্রা লেক, এক্সপো লেক। প্রতিটি লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে দুই-তিন দিন সময় লাগবে। তাই আজ শুধু লাভ লেক নিয়েই লিখব। সেখানে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। অন্য লেক ঘোরার সময় পাইনি।
চারপাশে জলে ভাসমান দুটি বড় বালুকাময় হৃদয় নিয়ে এটি মানুষের তৈরি সেরা সৃষ্টিগুলোর মধ্যে একটি। শীতকালে সারাদিন আর গরমকালে বিকেলে ও রাতে পরিবারসহ বাইরে বেড়াতে যাওয়ার জন্য এটি সেরা গন্তব্য। লাভ লেকের মোহনীয় এবং শ্বাসরুদ্ধকর সৌন্দর্য অনুভব করার জন্য হাজার হাজার পর্যটক সেখানে ভিড় করছেন। এ ছাড়া সেখানে বসবাসরত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষও পরিবার-পরিজন কিংবা একান্ত ভালোসাবার মানুষ নিয়ে বেড়াতে যান।
দুবাই গেলে বুর্জ আল খলিফা তো সবাই দেখেন। সাথে আছে ঝা চকচকে সব অট্টালিকা। সুন্দর সমুদ্রসৈকত, আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাইক্লিং ল্যানসহ বড় বড় শপিংমল। রেস্টেুরেন্টে আছে মজাদার সব খাবার। রাতের বেলা উদ্দাম নাইট ক্লাব। এসবের বাইরে যারা একটু শান্ত দৃশ্যের সন্ধান করতে চান, যেতে চান প্রকৃতির কোলে; তাদের জন্য উৎকৃষ্ট স্থান লাভ লেক। তাই এটি দুবাইয়ের একটি জনপ্রিয় ইকো-পর্যটন গন্তব্য।
এখানকার গাছের ওপরে, পাথরে, দেওয়ালে, এমনকি পানিতেও ভালোবাসা বিরাজমান। এটিকে আরও দৃষ্টিনন্দন করার জন্য ফুল এবং গাছপালার অসাধারণ সংগ্রহ আছে। ১৬ হাজারেরও বেশি গাছপালা লাভ লেককে ঘিরে আছে। গাছের ডালপালা, গুল্ম এবং সবকিছুই হৃদয়ের আকার ধারন করে আছে। এখানে ক্যাম্পিং করার ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। ২৪ ঘণ্টাই খোলা। পর্যায়ক্রমে পুলিশ পাহারা দেয়। যে কোনো সময় ক্যাম্প করা নিরাপদ। তবে শুধু নির্দিষ্ট জায়গায় ক্যাম্প ফায়ার ও বারবিকিউ পার্টি করা যায়। নেই কোনো প্রবেশ ফি।
বিস্তৃত এ হ্রদে বহু পরিযায়ী পাখিসহ একশরও বেশি প্রজাতির পাখি বাস করে। কাছাকাছি সোয়ান লেক অনেক বহিরাগত পাখির বাসস্থান। যেখানে আছে হরিণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বন্যপ্রাণী ও নানা প্রজাতির পাখি। এরমধ্যে অনরবত ঘুঘুর ডাক আপনাকে নস্টালজিয়ায় নিয়ে যাবে। সেখানে শত শত কালো এবং সাদা রাজহাঁস আছে। যারা হ্রদের শান্ত জলে সাঁতার কাটতে ব্যস্ত। এ ছাড়াও আছে ঈগল এবং বাজপাখি। লেকে নানা দেশ থেকে সংগ্রহ করা বিভিন্ন রঙের মাছও আছে। যা আপনার পায়ের কাছ দিয়ে হাঁটাহাঁটি করবে। লাভ লেক মূলত পর্যটক এবং প্রকৃতির সাথে সংযোগ। যা মন-প্রাণকে নির্মল করে তুলবে।
হ্রদের একটি ছোট অংশ রঙিন সমুদ্রের সঙ্গে যেন মিশে আছে। যেখানে গোল্ডফিশ এবং অন্যান্য মাছের প্রজাতিকে আনন্দের সাথে সাঁতার কাটতে দেখা যায়। এটি আল মারুম মরুভূমি সংরক্ষণ রিজার্ভের একটি অংশ। সাইহ আল সালাম মরুভূমির টিলার মধ্যে হ্রদগুলো কৃত্রিম হতে পারে। কিন্তু আশেপাশের এলাকাটি অকৃত্রিম। মানে আগের মতোই রাখা হয়েছে। কংক্রিটের রাস্তার পর লেকে প্রবেশের সময় কয়েক কিলোমিটার রাস্তা পাকা করা হয়নি। মনে হবে যেন মরুভূমি দিয়ে যাচ্ছি। সাধারণত মরুভূমিতে গাড়ি চালানোর অনুভূতি দেওয়ার জন্যই সুপরিকল্পনার আরেকটি দৃষ্টান্ত এটি।
পথে ফুল এবং গাছপালা দিয়ে সজ্জিত হৃদয় আকৃতির কাঠামো দেখা যায়। যদি গ্রাউন্ড লেভেল থেকে লাভ লেক উপভোগ করা যায়, তবে সম্পূর্ণ ছবি দৃষ্টিপটে ভেসে উঠবে। আপনি যদি ফিটনেস সচেতন হন, তবে সাইটে একটি রানিং ট্র্যাকও আছে। লাভ লেক ও আল কুদরা সাইক্লিং ট্র্যাকের খুব কাছাকাছি।
ভবিষ্যতের জন্য লাভ লেক দুবাইয়ের পরিবেশবান্ধব দৃষ্টিভঙ্গির একটি সাক্ষী। লাভ লেকের প্রতিটি ইঞ্চি পরিবেশবান্ধব। টিস্যু বক্স থেকে শুরু করে পার্কের বেঞ্চগুলো বায়োডিগ্রেডেবল বা পচনশীল উপকরণ দিয়ে তৈরি। এমনকি বাঁশ এবং গাছের তৈরি বেসিনও দেখতে পাবেন। টয়লেট বা ওয়াশরুমের ঘরগুলোও পরিবেশবান্ধব।
দুবাই লাভ লেক আল সালাম মরুভূমির টিলাগুলোর মধ্যে লুকানো একটি রত্ন। দুবাইয়ের আল কুদরা হ্রদ থেকে ১০ মিনিটের একটি মনোরম ড্রাইভ। ২০১৮ সালের নভেম্বরে সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় এটি। এ লেক দেখতে গেলে অবশ্যই দুবাইয়ের অন্যান্য ট্যুরিস্ট স্পটের মতো ব্যক্তিগত গাড়ি কিংবা ভাড়া গাড়ি নিতে হবে। তাহলে লেকের চারপাশ গাড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়ানো যাবে। ট্যাক্সিক্যাব নিলেও যেতে সুবিধা হবে।
এইচএস/এসইউ/জিকেএস