হারিয়ে যাচ্ছে গাইবান্ধার যত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
গাইবান্ধার প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এসব নিদর্শনের মধ্যে আছে কয়েকশো বছরের পুরনো মসজিদ, রাজ প্রাসাদ, জমিদার বাড়ি ও জোতদার বাড়ি।
১৩টিরও অধিক ঐতিহাসিক নিদর্শনের মধ্যে মাত্র ৩টি পুরাকীর্তির তালিকায় নাম তুলেই দায়িত্ব সেরেছে প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তর। সংরক্ষণের অভাবে নিঃশ্চিহ্ন ও দখল হয়ে গেছে বেশ কিছু স্থাপনাও।
প্রচার-প্রচারণাও না থাকায় গুরুত্ব হারিয়েছে প্রত্মতাত্ত্বিক সংরক্ষণের নিদর্শনগুলো। ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে হারিয়ে যাচ্ছে এ জেলার পুরনো ইতিহাস। জায়গাগুলোর বিষয়ে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরকেও চিঠি দিয়ে জানানোর কথা জানালেন জেলা প্রশাসক।
গাইবান্ধা জেলা প্রশাসন সূত্র ও সরেজমিনে দেখা গেছে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত পলাশবাড়ী উপজেলা শহরের নুনিয়াগাড়ী এলাকার এক গম্বুজবিশিষ্ট কাদিরবক্স মন্ডলের মসজিদে ইমামসহ মাত্র চারজন নামাজ আদায় করতেন।
ব্রিটিশ শাসনামলে রাজা-বাদশাহ বা জমিদাররা গাইবান্ধা পৌরসভার পূর্বপাড়ায় অবস্থিত লোন অফিস থেকে লোন দিতেন ও আদায় করতেন। এর নির্মাণশৈলী সহজেই আকৃষ্ট করে মানুষকে।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রাজাহার ইউনিয়নের রাজা বিরাট এলাকায় রাজপ্রাসাদসহ তিনটি স্থাপনা দীর্ঘদিন আগেই মাটির নিচে অনেকটাই দেবে গেছে। দেবে যাওয়া রাজপ্রাসাদ ও অন্য দুটি স্থাপনার উপরের অংশ এখন মাটিতে পরিণত হওয়ায় দেখে বোঝা যায়, এসব শুধু এখন উঁচু মাটির ঢিবি বা স্তুপ।
সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই রাজা-বাদশাহদের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে পরিচিত গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভার বর্ধনকুঠি। এখানকার দুটি ভবনের দেওয়াল ও কক্ষের ভেতর জন্মেছে আগাছা।
অন্যদিকে সাদুল্লাপুর উপজেলার নলডাঙ্গা ইউনিয়নের কালীবাড়ী পাড়া গ্রামে উপমহাদেশের প্রখ্যাত নাট্যকার-শিল্পী, চলচ্চিত্রকার তুলসী লাহিড়ীর জমিদার বাড়িও নিঃশ্চিহ্ন হওয়ার পথে।
এছাড়া ১৩০৮ সালে আবিষ্কার করা সদর উপজেলার ঘাগোয়া ইউনিয়নের মীরের বাগান গ্রামে তিন গম্বুজবিশিষ্ট মীরের বাগান ঐতিহাসিক শাহ সুলতান গাজীর মসজিদ, ঢাকা-রংপুর জাতীয় মহাসড়কের গোবিন্দগঞ্জের কামারদহ ইউনিয়নের মাস্তা গ্রামে মোঘল আমলে ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত তিন গম্বুজবিশিষ্ট প্রাচীন মাস্তা মসজিদও হারাতে বসেছে।
এমনকি ব্রিটিশ শাসনামলে সাদুল্লাপুরের জামালপুর ইউনিয়নের বড় জামালপুর গ্রামে তিন গম্বুজবিশিষ্ট জামালপুর শাহী মসজিদ, ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মিত সুন্দরগঞ্জের ধোপাডাঙ্গা ইউনিয়নের উত্তর রাজিবপুর মধ্যপাড়া গ্রামে তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ, সাঘাটা উপজেলার মুক্তিনগর ইউনিয়নের হাট ভরতখালী এলাকায় জমিদার বাড়িও সংরক্ষণের অভাবে নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে।
এ তালিকায় আরও আছে সাদুল্লাপুরের কামারপাড়া ইউনিয়নের পূর্ব কেশালীডাঙ্গা গ্রামের জোতদার প্যারিমাধব সরকারের বাড়ি, সুন্দরগঞ্জের রামজীবন ইউনিয়নের কাশদহ গ্রামের জোতদার ইয়াকুব উদ্দিন সরদারের বাড়ি।
এসব নিদর্শন এখন শুধু টিকে আছে কালের স্বাক্ষী হয়ে। এরই মধ্যে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে থাইল্যান্ডের রাজকন্যা মাহা চাক্রী শিরিনধর্ন জোতদার প্যারিমাধব সরকারের বাড়িটি পরিদর্শন করেছেন।
এদিকে প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তর রংপুর বিভাগের সংরক্ষিত ঘোষিত পুরাকীর্তির তালিকায় পলাশবাড়ির দরিয়ার দুর্গ মাউন্ড ও ধ্বংসপ্রাপ্ত দরগাহ, কাদিরবক্স মন্ডলের মসজিদ ও গোবিন্দগঞ্জের বিরাট রাজার ঢিবি।
এসব স্থাপনার তথ্য নেই গাইবান্ধা জেলার জাতীয় ওয়েব পোর্টালে। এমনটি স্থানগুলো সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগও নেই জেলা প্রশাসনের। ফলে এসব স্থাপনা ও তথ্য অজানায় থেকে যাচ্ছে সুস্থ বিনোদন ও ভ্রমণপ্রেমী মানুষের কাছে।
ঐতিহাসিক স্থাপনার নির্মাণশৈলী ও নকশা সহজেই নজর কাড়ে জানিয়ে প্রবীণ ব্যক্তি কবি সরোজ দেব বলেন, ‘প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন সরকারিভাবেই সংরক্ষণ করে বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা উচিত। আর তা হলে একদিকে যেমন এসব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সম্পর্কে জানা যাবে তেমনই সুস্থ বিনোদনেরও ব্যবস্থা হবে।’
‘এসব প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখতে দেশের নানান প্রান্ত থেকে ভ্রমণপ্রেমী মানুষের পদচারণা ঘটবে। ফলে এসব এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়নও ঘটবে।’ স্থানীয় প্রশাসনকে এসব স্থাপনার বিষয়ে সাইনবোর্ড তৈরি করে প্রচার-প্রচারণাও তাগিদ দেন কবি সরোজ দেব।
গাইবান্ধা পাবলিক লাইব্রেরি অ্যান্ড ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল হক জনি বলেন, ‘বিনোদন ও ভ্রমণপ্রেমী মানুষ নেটদুনিয়ায় খুঁজে থাকেন ঐতিহাসিক স্থাপনা সম্পর্কে। আর তা খুঁজে না পাওয়ায় যুব সমাজ সুস্থ বিনোদন থেকে বঞ্চিত হয়ে বিপথগামী হচ্ছে। আর অজানা ও অদেখা থেকে যাচ্ছে স্থাপনাগুলো।’
‘এজন্য জেলার প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণের বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করা উচিত। এই কমিটি দখল হয়ে যাওয়া স্থাপনা উদ্ধার, সংরক্ষণ ও জনসাধারণের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করবে।’
এ বিষয়ে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক মো. অলিউর রহমান বলেন, ‘যেসব প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণ করা প্রয়োজন বা সংরক্ষণের সুযোগ আছে সেসব নিদর্শন সংরক্ষণ করা হবে। আমরা এ বিষয়ে একটি উপকমিটি করবো।
এই কমিটি এসব প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণের বিষয়ে উদ্যোগ নেবে। বিষয়টি নিয়ে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরকেও চিঠি দিয়ে জানানো হবে।
জাহিদ খন্দকার/জেএমএস/জিকেএস