একদিনের শ্রীমঙ্গল ভ্রমণে যা যা দেখবেন
মো. মাইদুল ইসলাম
পড়ন্ত বেলা দু’পাশে বিলের মাঝে সরু পিচঢালাই রাস্তা। গ্রামবাংলার চিরচেনা নয়নাভিরাম দৃশ্য এটি। বাইক্কা বিল যাওয়ার সময় মনে আপনা আপনি গেয়ে উঠে ‘গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ আমার মন ভুলায় রে’।
এ ছাড়াও চা বাগান, টিলা, লেক, রাবার ও লেবু বাগান সব মিলিয়ে সবুজের ছড়াছড়ি চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গলে। প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষেই বন্ধুরা মিলে মোট ২১ জনের বড় টিম তৈরি হলে শ্রীমঙ্গল যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হই ১৭ জন। নির্ধারিত হলো শনিবার (২৩ জানুয়ারি) আমরা সারাদিন শ্রীমঙ্গল ঘুরবো।
পরিকল্পনা ছিলো শুক্রবার রাতে উপবন এক্সপ্রেসে শ্রীমঙ্গল যাবো। তবে বিপত্তি হলো রাত দেড় টা নাগাদ স্টেশনে পৌঁছে যাবে ট্রেন। এত রাতে পৌঁছালে ঝামেলা তাই সিদ্ধান্ত হলো সিলেটগামী সুরমা মেইলে আমরা যাবো।
২১ জানুয়ারি রাত ৯টায় সুরমা মেইলে শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। ট্রেন কমলাপুর স্টেশন থেকে বের হতেই শুরু হলো আড্ডা-গান।
শেষ রাতে একটু সবাই ক্লান্তি দূর করতে আড্ডা ঝিমিয়ে পড়ে। তবে শায়েস্তাগঞ্জ পার হতেই কুয়াশাচ্ছন্ন শ্রীমঙ্গলে অপরুপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সবাই।
রাস্তার দু’পাশের প্রকৃতি দেখতে দেখতে সকাল সাড়ে ৬টার দিকে আমরা পৌঁছালাম শ্রীমঙ্গল। আগে থেকেই দুটো গাড়ি ঠিক করে রাখা হয়েছিল। তারা স্টেশনেই ছিলো।
চাঁদের গাড়িতে উঠেতেই সবার সে কি উল্লাস! প্রথমেই আমরা চলে গেলাম পানসী রেস্টুরেন্টে। সেখানে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা সেরে আমরা রওনা হলাম লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে।
লাউয়াছড়া যাওয়ার পথ আমাদেরকে রীতিমত অবাক করে দিয়েছিলো! সকাল সকাল তেমন কোনো গাড়ি বা মানুষ ছিলো না। দু’পাশে গাছ উঁচু-নিচু রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছিলো। হীম শীত উপেক্ষা করে আমরাও গাড়ির উপরে উঠে বসে শুরু করলাম গান, সঙ্গে ছবি তোলা, ভিডিও করা।
এত চমৎকার রাস্তায় ছুটে বেড়ানো হয়তো এর আগে আমাদের কারো হয়নি। সাড়ে ৮টার দিকে আমরা নামলাম উদ্যানের সামনে। নেমেই সেখানে সবাই সকালের চা পান সেরে নিলাম। উদ্যানে প্রবেশ শুরুর সময় ৯টা, তাই আমরা বাইরেই ছবি তুলতে শুরু করলাম।
এরপর টিকিট মাস্টার আসলে আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম। আমরা যেহেতু সবাই শিক্ষার্থী তাই আইডি কার্ড দিয়ে ২০ টাকা করে আমাদের প্রবেশ মূল্য দিতে হয়েছে। যাদের নিরিবিলি জায়গা ভালো লাগে, উদ্ভিদ নিয়ে জানার আগ্রহ তাদের সময় নিয়ে লাউয়াছড়া ঘুরতে ভালো লাগবে।
তবে আমাদের টিম বড় হওয়ায় ও একদিনে অনেকগুলো জায়গা ঘুরবো তাই বেশি ভেতরে যাইনি। গেট দিয়ে প্রবেশ করলেই দেখা মিলবে বড় বড় গাছ। বিরিল প্রজাতির গাছের দেখা মিলবে এখানে। একটু সামনে গেলেই দেখতে পাবেন রেল লাইন।
এখানেই হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র ‘আমার আছে জল’এর শুটিং হয়েছিলো। রেললাইনের বাম পাশ দিয় সামনে গেলেই দেখা মিলবে গবেষণা কেন্দ্র। আমরা ঘণ্টাখানেক সময় সেখানে থেকে রওনা হই মাধবপুর লেকের উদ্দেশ্যে।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে যা যা দেখবেন
জীববৈচিত্রের অভয়ারণ্য লাউয়াছড়া ১২০০ হেক্টরের বনাঞ্চলজুড়ে অবস্থিত। সেখানে প্রায় আড়াই হাজারেরও অধিক বন্যপ্রাণী আছে। যার মধ্যে দূর্লভ ও বিলুপ্তপ্রায় ৪৬০ প্রজাতির উদ্ভিদও রয়েছে।
সেখানে বিলুপ্তপ্রায় উল্লুক, হনুমান, শকুন, লজ্জাবতী বানর, মায়া হরিণসহ নানা প্রাণীর দেখা মিলে এই উদ্যানে। এ ছাড়াও প্রায় ৬৮ হাজার উদ্ভিদ রয়েছে লাউয়াছড়া উদ্যানে।
মাধবপুর লেক
চা বাগানে ঘেরা উঁচু টিলা আর মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে লেক। মাধবপুর লেকে প্রবেশ করতেই চোখে পড়লো লাল পদ্মের দিকে! লেকের পাড়ে বসে লাল পদ্ম দেখতে দেখতে-দেখতে কিছু সময় বিশ্রাম নেওয়া হলো।
লেকের পাড় দিয়ে সামনে গেলেই শুরু টিলা। একের পর এক টিলা সবগুলোর বুকে সবুজ চা বাগান ভ্রমণপিপাসুদের মনে নাড়া দেবে। টিলার উপর থেকে লেকের সৌন্দর্য যেন আরও বেশি মনে হয়।
লেক, টিলা আর চা বাগানের মিশেল পেয়ে ক্যামেরায়বন্ধী করতে ব্যস্ত হয়ে গেলো সবাই। পুরো টিম মেম্বাররাও এক ফ্রেমে বন্দি হলাম এখানে।
এর মাঝেই দেখা হলো এক চা শ্রমিকের সঙ্গে। তিনি জানালেন চা শ্রমিকেদের কষ্টের কথা। সারাদিনে চা পাতা তুলে বা চা গাছ কেটে একজন শ্রমিক আয় করে মাত্র ১২০ টাকা! খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে এসব চা শ্রমিকদের।
নৈসর্গিক সৌন্দর্যের টিলার উপরে উঠে মনে হচ্ছিলো এখানেই যদি থেকে যেতে পারতাম আহা কতই না সুন্দর আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি। আমরা মোট ৪টি টিলা পর্যন্ত উঠি এরপর ফিরে আসি। লেক থেকে বের হওয়ার সময় দেখা মিলে পাহাড়ি পেঁপের।
স্কুল বন্ধ থাকায় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছেলে এসেছে পর্যটকদের কাছে পেঁপে বিক্রি করতে। দাম একটু বেশি চাইলেও বন্ধু অহিদুল দামাদামিতে পাক্কা শেষ পর্যন্ত সুলভ মূল্যেই পেঁপে খেলাম আমরা। পাহাড়ি পেঁপের স্বাদও ছিলো দারুণ। মাধবপুর লেকের পর আমাদের গন্তব্য ছিলো লাল পাহাড়।
লাল পাহাড়ের সৌন্দর্য
লাল পাহাড় যাওয়ার পথেই আমরা দেখলাম নূর জাহান টি গার্ডেন ও রাবার বাগান। চায়ের রাজধানী যে শ্রীমঙ্গল তা অনুভব করা যায় মাধবপুর লেকের টিলাগুলোতে ও লেক থেকে লাল পাহাড় যাওয়ার পথে। এই পথের দু’ধারে যত দূর চোখ যায় দেখা মেলে শুধু সবুজ চা বাগানের।
সতেজ সবুজ পাতায় পূর্ণ চা বাগানের ভেতর দিয়ে গাড়ি চলছে আর আমদের গলা ফাটানো গান ও চলছে। সত্যিই সে এক অন্যরকম এডভেঞ্চার ছিলো আমাদের জন্য। এই রাস্তায় চা বাগানের পাশাপাশি দেখা মিলবে লেবু ও আনারস বাগান।
লাল পাহাড়ে সড়ক থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার হেঁটে উঠতে হয়। পাহাড়ে যাওয়ার আগে আমরা হালকা নাস্তা সেরে নিলাম। তারপর হাঁটা শুরু, একটু বেশি উঁচু হওয়ায় কেউ কেউ যেতে চাচ্ছিলো না। শেষ পর্যন্ত একজন বাদে সবাই ট্রেকিং শুরু করলাম।
চা বাগান পেরিয়ে লাল পাহাড়ের উপরে উঠলাম আমরা। উপরে একটি মন্দির আছে। চারদিকের দৃশ্য মনোমুগ্ধকর। সেখানে আরও একটি পাহাড় আছে। সময় কম থাকায় আমরা ফিরে আসি গাড়িতে। এরপর রওনা হই বধ্যভূমি’৭১ এ।
বধ্যভূমি’৭১
শহরের ভানুগাছ সড়কে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সেক্টর হেড কোয়ার্টার সংলগ্ন ভুরভুরিয়া ছড়ার পাশে অবস্থিত বধ্যভূমি’৭১ পার্কটি। এখানে আছে ‘সীমান্ত ৭১ ফ্রেশ কর্নার’সহ মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ‘মৃত্যুঞ্জয়ী ৭১’।
এ ছাড়াও আছে নানা রকম চায়ের সমাহার। ৩,৭,১০সহ বিভিন্ন লেয়ারের চা পাওয়া যায় সেখানে। শুধু লেয়ার চা নয়, সেখানে এখানে প্রায় সব ধরনের চা পাওয়া যায়।
বাইক্কাবিলে পরিযায়ী পাখির মেলা
আমাদের সর্বশেষ গন্তব্য ছিলো শহর থেকে বেশ দূরে বাইক্কাবিল। বিলের জলরাশির ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা মেঠোপথ পার হয়ে গাড়ি থামতেই শোনা যায় পাখির কিচিরমিচির শব্দ।
আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির ওড়াউড়ি আর পানিতে মাছের লুকোচুরি খেলা মাতিয়ে রেখেছে এই বিলটিকে। শীতের সময় পরিযায়ী পাখির অভয়ারণ্যে পরিণত হয় এই বিল। শীত মৌসুমের পুরোটা সময় পাখির কলকাকলীতে মুখর থাকে চারপাশ।
শীতের কুয়াশা ভেদ করে অতিথি হয়ে এখানে এসেছে নানা জাতের সৈকত পাখি। এখানে আসা মধ্যে গেওয়ালা বাটান, মেটেমাথা চিটি আর কালাপঙ্খ ঠেঙ্গী, ধলা বালিহাঁস, পাতিসরালী।
রাজসরালী, মরচেরং, ভূতিহাঁস, গিরিয়াহাঁস, ল্যাঙ্গাহাঁস, গুটি ঈগলসহ ইত্যাদি অন্যতম। বিলের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য সেখানে তৈরি হয়েছে একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার।
আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ, সারি সারি টিলা আর তার বুকে চা বাগান সতেজ সবুজ পাতায় পূর্ণ হয়ে আছে শ্রীমঙ্গলের নিসর্গশোভা। সব মিলিয়ে ভ্রমণপিপাসুদের মন কাঁড়বে চায়ের রাজধানী।
মো. মাইদুল ইসলাম, শিক্ষার্থী সরকারি তিতুমীর কলেজ।
জেএমএস/এমএস