কুমিল্লায় ক্যাম্পিং করবেন যেখানে
ইসতিয়াক আহমেদ
খাদি কাপড় ও রসমালাইয়ের জন্যে বিখ্যাত কুমিল্লা জেলা। এর পাশাপাশি শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতির পাদপীঠ কুমিল্লা। প্রাচীন ঐতিহ্যসমৃদ্ধ এই জেলা প্রাচীনকালে সমতট জনপদের অন্তর্গত ছিল ও পরবর্তীতে ছিল এটি ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ।
নতুন বর্ষবরণে আমরা কয়েকজন মিলে ছুটলাম কুমিল্লায়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার বাসে রওনা দিয়েই কুমিল্লা কোট বাড়িতে যখন পৌঁছালাম, তখন রাত ৯টা প্রায়।
আমাদের বাস ছিল মায়ামি এয়ারকন। তুলনামূলক নতুন বাস ও অস্থির তার সার্ভিস। নেমেই সিএনজি নিয়ে ছুটলাম আমাদের জন্য পূর্ব নির্ধারিত ক্যাম্পিং সাইট ময়নামতি অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্পে।
পৌঁছেই ফ্রেশ হয়ে টেন্ট/তাবু বুঝে নিয়ে একটু আড্ডা দিতে না দিতেই ডাক পড়লো ডিনারের। চিকেন কারি, সবজি, ডাল ভাত ভর্তায় অস্থির একটা ডিনার শেষে টিম ঘুরুঞ্চির আড্ডা দেওয়ার পালা।
এদিকে নতুন বর্ষবরণে কেক কাটা হবে। কেক কাটা শেষে ফানুস উৎসব। তারপর আড্ডা দিয়েই খানিক বাদে ভরপুর বার-বি-কিউ এর আয়োজন।
ময়নামতি অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্প মূলত কুমিল্লার কোটবাড়িতে শালবন বিহারের পাশের শালবনে ঘেরা নীলকুঞ্জ রিসোর্টে অবস্থিত।
সেখানে আছে রাতে টেন্টে ক্যাম্পিং করে থাকার অসাধারণ আয়োজন। একই সঙ্গে আছে পর্যাপ্ত পরিচ্ছন্ন ওয়াশরুম। আছে বার-বি-কিউ ও অন্যান্য বেলার খাবারের আয়োজন করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা।
নব শালবন বিহার বা ওয়ার্ল্ড পিচ প্যাগোডার সঙ্গেই লাগোয়া টিলা ঘেরা ও টিলার উপরেই অবস্থিত এই ময়নামতি অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্প। নিরাপত্তা, সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ অন্যান্য সব সুবিধায় ভরপুর এক স্থান।
আর তাই তো টিম ঘুরুঞ্চির নিউ ইয়ার সেলিব্রেশনের ক্যাম্পিং ট্রিপে আয়োজনের জনে বেছে নিয়েছিলাম স্থানটি। রাতে চেক ইনের পর সকালের নাস্তা করেই যখন আমরা চেক-আউট করলাম তখন প্রায় সকাল সাড়ে ১১টা।
এবার পালা প্রথমেই নব শালবন বিহারে যাওয়ার। যা কি না প্রথম দর্শনে মনে হতে পারে নেপালের ওয়ার্ল্ড পিস প্যাগোডা, কিন্তু না- এই অসাধারণ স্থাপত্যকীর্তিটির অবস্থান বাংলাদেশেই।
নেপালের ওয়ার্ল্ড পিস প্যাগোডার সঙ্গে অনেকটা সাদৃশ্যপূর্ণ। এই প্যাগোডার নামও ‘ওয়ার্ল্ড পিস প্যাগোডা’। অবশ্য লোকে মুখে শালবন বিহার বৌদ্ধ মন্দির নামেই বেশি পরিচিত।
কুমিল্লার কোটবাড়ির ময়নামতি শালবন বিহারে। ওয়ার্ল্ড পিচ প্যাগোডায় ভিডিও ভিডিও ক্যামেরা ব্যবহার জন্য জন্য ১০০ টাকা ও নরমাল ক্যামেরা ব্যবহার এর জন্য ৫০ টাকা ফি দিতে হয়। যদিও মোবাইল ব্যবহারে কোনো ফি নেই।
প্রায় আড়াই একর জায়গার উপর ১৯৯৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর নব শালবন বিহার ও বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট কালচারাল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়। শৈল্পিক এই বৌদ্ধ উপাসনালয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ‘শান্তি বিহার’ হিসেবে পরিচিত।
২০১৪ সালে থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ ধর্মীয় ফাউন্ডেশনের উপহার হিসেবে পাওয়া ধাতব পদার্থে তৈরি প্রায় ৬ টন ওজনের ৩০ ফুট উচ্চতার বৌদ্ধ মূর্তি স্থাপন করা হয় বিহারে।
শালবন বৌদ্ধ বিহারশালবন বৌদ্ধ বিহার কুমিল্লা জেলার কোটবাড়িতে অবস্থিত। যা বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন হিসাবে সুপরিচিত। তৎকালীন সময় এই অঞ্চলে শাল ও গজারির বন ছিল বলে বিহারটি শালবন বিহার নামে পরিচিতি লাভ করে।
শালবন বিহার অনেকটা পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের মতো তবে আকারের দিক দিয়ে পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার থেকে কিছুটা ছোট। কোটবাড়ি এলাকায় ১৮৭৫ সালে রাস্তা তৈরির সময় একটি ইমারতের ধ্বংশাবশেষ সবাই প্রত্যক্ষ করেন। তখন এটিকে প্রাচীন দূর্গের অংশ হিসাবে ধারণা করা হচ্ছিল।
১৯১৭ সালে ঢাকা জাদুঘরের অধ্যক্ষ নলিনী কান্ত ভট্টাশালী শালবন বৌদ্ধ বিহারটিকে পর্যবেক্ষণ করে পট্টিকেরা নগর বলে মতামত পোষণ করেন। তবে ধারণা করা হয়, বিহারটি ৭ম শতাব্দীর শেষ সময়ে দেববংশের চতুর্থ রাজা শ্রীভবদেব নির্মাণ করেন।
বিভিন্ন সময় শালবন বিহারের ৬টি স্থাপনা নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণের কথা জানা যায়। মনে করা হয়, ৮ম শতাব্দীর মধ্যে ৩য় বারের মত কেন্দ্রীয় মন্দির নির্মাণ ও বিহারের সার্বিক সংস্কার হয়।
শালবন বিহারটি দেখতে আয়তকার, এর প্রত্যেক বাহুর দৈর্ঘ্য ১৬৭.৭ মিটার। চতুর্দিকে বিহারের দেয়াল প্রায় পাঁচ মিটার পুরু এবং বিহারের কক্ষগুলো চারপাশের বেষ্টনী দেয়ালের সাথে পিঠ করে নির্মিত। বিহারে প্রবেশের জন্য একটি দরজা দেখা যায় যা উত্তর ব্লকের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত।
বিহারে সর্বমোট কক্ষের সংখ্যা ১৫৫টি ও ঠিক মাঝখানে কেন্দ্রীয় মন্দিরকে চিহ্নিত করা যায়। এসব কক্ষে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বসবাস ও ধর্মচর্চা করতেন বলে জানা যায়।
প্রত্যেক কক্ষের দেয়ালে প্রতিমা বা তেলের প্রদীপ রাখার ৩টি করে কুলুঙ্গি আছে। অন্যপাশে ৪টি বিশাল স্তম্ভের ওপর নির্মিত একটি হলঘর দেখা যায়। ধারণা করা হয়, হলঘরটি ভিক্ষুদের খাবারের জন্য ব্যবহার করা হত।
বিভিন্ন সময় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যক্রমের মাধ্যমে শালবন বৌদ্ধ বিহার থেকে প্রায় ৪০০টি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, ব্রৌঞ্জ ও মাটির মূর্তি, আটটি তাম্রলিপি, সিলমোহর, অসংখ্য পোড়া মাটির ফলক বা টেরাকোটা উদ্ধার করা হয়। এসব নিদর্শনের সিংহভাগই ময়নামতি জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে।
কীভাবে যাবেন?
ঢাকা, চট্টগ্রাম বা বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে কুমিল্লা যেতে হবে। সেখান থেকে এরপর যাবেন টমসম ব্রিজ। সেখান থেকে রিজার্ভ বা জনপ্রতি ভাড়ার অটো বা টমটমে যেতে পারবেন ওয়ার্ল্ড পিস প্যাগোডা বা শালবন বিহার বৌদ্ধ মন্দির।
সেখানেই আছে ময়নামতি যাদুঘর, শালবন বিহার, ওয়ার্ল্ড পিচ প্যাগোডা ও একটু পায়ে হাঁটা পথেই ময়নামতি অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্প। এন্ট্রি টিকিট শালবন বিহারে জনপ্রতি ২০ টাকা ও ওয়ার্ল্ড পিচ প্যাগোডায় জনপ্রতি ২০ টাকা।
জেএমএস/জিকেএস